প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
পথশিশু, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার একটি নাম। পথশিশু নামটি মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমাজের ভাসমান এক পরিস্থিতির দৃশ্য। ওরা সাধারণ শিশুর মতো নয়। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর ওদের ভাগ্যে কমই জোটে। কেউ হয়তো জন্মের পরই দেখেনি বাবাকে। একটু বুঝে ওঠার পর থেকে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে জীবিকার খোঁজে। আরেকটু বড় হলে মা এক পথে, ওরা অন্য পথে ঘুরতে থাকে পেটের দায়ে। এভাবে জীবন তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। এরাই আমাদের সমাজের পথশিশু। এ শিশুদের কাছে রাস্তাই স্বাভাবিক বাসস্থান এবং জীবিকা নির্বাহের উৎস হয়ে উঠেছে। তারা দায়িত্বশীল কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কর্তৃক সুরক্ষিত নয়, পথনির্দেশনাপ্রাপ্ত নয়।
এই পথশিশুরা স্কুলে যায় না; বরং এর পরিবর্তে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে বা অন্য কাজ করে। এর কারণ তাদের বাবা-মা কাজ করতে অক্ষম বা তাদের উপার্জন অতি সামান্য, যা তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে যথেষ্ট নয়। এই পথশিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য পুষ্টিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের নেই নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা। খোলা আকাশ, পার্ক, ফুটপাত, রেলস্টেশন, ফেরিঘাট-লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা বাস স্টেশনেই এদের থাকার জায়গা।
বাংলাদেশের অনেক পথশিশু কম বয়সে মারা যায়, তারা প্রয়োজনীয় যত্নও পাচ্ছেন না। প্রতি বছর জলবাহিত রোগে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। পথশিশুরা স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে অক্ষম, যা অনেক সময় তাদের স্বাস্থ্যের জন্যে উপযুক্ত নয় এমন খাবার খেতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশে পথশিশুদের উপর কোনো সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান উপলব্ধ নয়। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ কর্তৃক পরিচালিত ‘এস্টিমেশন অফ দ্য সাইজ অফ স্ট্রিট চিলড্রেন এন্ড দেয়ার প্রজেকশন ফর মেজর আরবান এরিয়াস অফ বাংলাদেশ, ২০১০’ নামক এক অনুসন্ধানকে ভিত্তি করে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, সারা বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি এবং একই অনুসন্ধানে বলা হয়েছে যে শুধু ঢাকাতেই প্রায় ৬ লাখ ৭০ হাজারের বেশি পথশিশু বসবাস করছে। অর্থাৎ এদের ৭৫ শতাংশই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে। মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৮তম স্থানে থাকা একটি দেশ, যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সেখানে এই শিশুরা সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের জনসংখ্যা এখন বেড়েছে, আর পথশিশুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ২৫ লাখে।
গত ৩০ জুন, চাঁদপুর বড় স্টেশন মোলহেডে গিয়ে দেখতে পেলাম, ছাউনি দেয়া দোকানগুলোর পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৪ শিশু। ওদের বয়স ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ওদের এক হাতে বস্তা, অন্য হাতে পলিথিন। ওরা কী যেনো ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত! এ চারজনের একজন সর্দারের ভূমিকা নিয়ে একেকজনের পলিথিনে ঢেলে দিচ্ছে সেই উপকরণ। কাছে গিয়ে নিশ্চিত হলাম, কোনো এক হোটেলের দুপুরের খাবারের যে বাকি অংশ ছিলো ওইটাই তারা পেয়েছে। এরা রাতে নৌকার নিচে কোনোরকমে জায়গা করে নেয় ঘুমোনোর জন্যে। দিনে এরা বিভিন্ন জায়গায় বোতল, প্লাস্টিকের টুকরো, ভাঙারি সংগ্রহ ও বিক্রি করে।
এই পথশিশুরা কি মানুষ নয়? হ্যাঁ, এরাও মানুষ। কিন্তু এরাও আমাদের প্রচলিত সমাজ থেকে পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার কারণে পরিবার হতে ছিটকে ভাসমান পরিবেশের ছিন্নমূল শিশুতে পরিণত হয়েছে। আর দশটা সাধারণ শিশুর মতো তাদেরও উচিৎ শিশু হিসেবে সকল মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়া। তারাও সকল মানবাধিকার প্রাপ্য। তাদেরকে এই অধিকারগুলো দেয়ার এবং নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে পথশিশুদের শিক্ষার আগে থাকাণ্ডখাওয়ার নিশ্চয়তা দরকার। শিশুদের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এই বাধ্যতামূলক শিক্ষা মানে হলো, কোনো শিশুকে যদি তিন বা চার ঘণ্টার জন্যে স্কুলে আসতে বলা হয়, শিশুটি সেখানে আসতে বাধ্য। কিন্তু এই শিশুরা স্কুলে আসতে গেলে তাকে প্রথমত পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে আসতে হবে। পেট ভরে খেয়ে আসতে হবে। যেখানে একটি শিশুর থাকার জায়গা নেই, ভালো একটা কাপড় নেই, খাবারের কোনো নিশ্চয়তা নেই, তার জন্যে পড়তে আসা বাধ্যতামূলক করা বাস্তবসম্মত নয়। তার জন্যে সেখানে শিক্ষার অবস্থান অনেক নিচে। তার যদি বাকি চাহিদাগুলো পূরণ করা যায়, তার যদি একটি থাকার জায়গা থাকে, খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে এবং একটি পরিচ্ছন্ন পোশাক থাকে, তখন আমরা শিক্ষার কথাটা গুরুত্বের সাথে তাকে বলতে পারি। আমাদের সকলের মতে, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে সারাদেশের যেখানে যতো পথশিশু রয়েছে, তাদের জন্যে নিরাপদ আবাসন করা দরকার। প্রথমেই থাকার ব্যবস্থা, তাদের বয়সোপযোগী শিক্ষা এবং তারা যেনো একটা বয়সে যখন বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ আছে, সেখানে সেই বয়স হলে তাদের ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে একটা কর্মক্ষেত্র, যা কোনোরকম ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত করা। সরাসরি বলতে গেলে বর্তমানে করণীয় হচ্ছে, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনসহ অন্যান্য যে বিষয়গুলো রয়েছে; সেটি নিশ্চিত করা এবং সকলের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। আর এভাবেই আমরা আশা করতে পারি বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের পথশিশুকে মৌলিক অধিকারের আওতায় আনার পরিকল্পনায় লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে যাবে।
জোবায়েদা জোয়া : শিশু সাংবাদিক, ন্যাশনাল চিলড্রেন টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ), চাঁদপুর।