প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২২, ০০:০০
বাল্যবিবাহ, বাল্যবিয়ে বা শিশুবিবাহ শব্দগুলোর সাথে আমরা বাংলাদেশিরা অনেক আগে থেকেই পরিচিত। নিউইয়র্ক টাইমস্রে প্রতিবেদন অনুসারে ভারতবর্ষে বাল্যবিবাহের উৎপত্তি ১০০০ বছরের আগে থেকে। বাল্যবিবাহের শাব্দিক অর্থ অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মেয়েদের সাধারণত বয়ঃসন্ধি আগেই বিয়ে দেয়া হতো, তবে শিল্প-বিপ্লবের আগে ভারতবর্ষের নারীরা তাদের মধ্য কিশোর বয়সে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পর পরই বিয়ে করার প্রবণতা ছিলো। বাংলাদেশে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছর। তবে ২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ বিলে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ১৮ বছরের নিচে বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উইমেন ও ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি ৩টি বিয়ের ২টিই বাল্যবিবাহের অন্তর্ভুক্ত। বাল্যবিবাহের সাধারণ নিয়মে ছেলে-মেয়ে উভয়ের অপ্রাপ্তবয়স এ বিয়ের ধারণাকে বোঝালেও, যেহেতু বাংলাদেশে মেয়েদের অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ের হার বেশি, তাই মেয়েদের বাল্যবিবাহ কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব বিষয়টিই আজকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বাল্যবিবাহ নির্মূল করতে হলে প্রথমে আমাদের এর কারণ সম্পর্কে জানতে হবে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা কার্যক্রম তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর তথ্য মোতাবেক, যে সকল কারণ বাল্যবিবাহের জন্যে দায়ী তার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র এবং অস্থিতিশীলতা, লিঙ্গ-বৈষম্য, জমি-জমা বা সম্পদের চুক্তি, পরিবারের সম্মান রক্ষা, প্রচলিত প্রথা বা চর্চা, নিরাপত্তাহীনতা, যৌতুক, ধর্মীয় ও সামাজিক চাপ, অবিবাহিত থাকার শঙ্কা, নিরক্ষরতা ও নারীদের বা মেয়েদের উপার্জনে অক্ষম ভাবা। যেহেতু আমরা এখন বাল্যবিবাহের কারণ জানি, তাই এর নির্মূলের পদ্ধতি বের করাও এখন খুব সহজ।
এক. নারীদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে। এই শিক্ষা যেনো শুধু তথাকথিত পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান না হয়ে বাস্তব ও সচেতনতামুখী হয়, তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। ১৯৯১-২০০৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহের হার কমার ক্ষেত্রে চিন্তাবিদরা শিক্ষার হার বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে বিবেচনা করছে। ২০০৮ সালে এক সমীক্ষা অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে কোনো মেয়ের প্রতি বাড়তি বছর অবিবাহিত থাকার ফলে সে গড়ে ০.২২ বছর বাড়তি পায় শিক্ষা গ্রহণের জন্যে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে তাদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ের সম্ভাবনা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ আবার একেবারেই নিরক্ষর মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েদের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি। তাই বাল্যবিবাহ রোধে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ শিশুর যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করা।
দুই. মেয়েদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, যতো দেরিতে মেয়েদের বিয়ে হয়, ততো তারা প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পায়। নারী-পুরুষ উভয়কেই পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতন করা গেলে মাতৃমৃত্যুর হার কমে এবং পরিবারের অবস্থার উন্নতি ঘটে। বাল্যবিবাহর কুফলস্বরূপ যে সকল স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে তা সম্পর্কে আগে থেকে মানুষ অবগত থাকলে বাল্যবিবাহ নির্মূল সহজতর হবে।
তিন. বাল্যবিবাহের কারণে নারীরা যেই পারিবারিক সহিংসতা, শিশু যৌন নির্যাতন ও বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয় সেই সম্পর্কে সকলকে সচেতন হতে হবে। উন্নয়নশীল বিশ্বে ১৫-১৯ বছর বয়সী নারী মৃত্যুর প্রধান কারণ গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব। এক্ষেত্রে পুরো সমাজ যদি এ সকল বিষয়ে সচেতন হয় তবে দেশে ধর্ষণ বা নির্যাতনের মতো সহিংস কাজের মাত্রা অনেকাংশেই কমে যাবে।
চার. ধর্মের অপব্যাখ্যা ও ধর্মীয় চাপের ভুল প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। গবেষকদের মতে, গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহের হার তুলনামূলক বেশি হওয়ার প্রধান কারণ সেখানের কুসংস্কার। ধর্মের সঠিক ব্যাখার প্রচলন নিশ্চিত করলে গ্রামীণ পর্যায়ে বাল্যবিবাহ রোধ বেশি দুষ্কর নয়।
পাঁচ. বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে আরেকটি বড় পদক্ষেপ হতে হবে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। অনেক অভিভাবকের ধারণা যে অল্প বয়সে শিশুর বিয়ে মানে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই রাষ্ট্র যদি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে নিরাপত্তাজনিত আমাদের সমাজে ঘটতে থাকা বাল্যবিবাহ রোধ করা যাবে।
ছয়. প্রত্যেক নারীকে স্বনির্ভর বা আত্মনির্ভর করে তোলা। আজ একবিংশ শতাব্দীর এক কালো সত্য এই যে, আজও মেয়ে সন্তানকে সমাজের অনেক মানুষ বোঝা বলে মনে করে। এমন নয় যে মেয়ের ভরন-পোষণে তাদের আর্থিকভাবে কোনো সমস্যা আছে, কিন্তু মেয়ের বিয়ে যে সমাজের সকলের এক মহাচিন্তা তা অস্বীকার করা ভুল হবে। আত্মনির্ভর না হলে নারীকে বিয়ের পূর্বে তার পিতার উপার্জনের উপর চলতে হয়, এতে করে সে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমানোর চিন্তা করেন অভিভাবকেরা। সেজন্যে সমাজের সকল নারীকে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে হবে।
সাত. আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারগুলোকে সাহায্য প্রদান, যাতে করে সেই পরিবারের মেয়েরা পণ্যের মতো ‘বিয়ে’ নামক কেনা-বেচায় জড়িয়ে না পড়ে। আজও বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো কিছু নগদ অর্থ বা জমিজমা জোগাড় করার সাথে সাথেই মেয়ের বয়স বিবেচনা না করে বিয়ে দিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যদি অনুদান বারে তাহলে এ অস্বচ্ছলতা দূর হয়ে সেই পরিবারের নারীগুলোও সঠিক মানবাধিকারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে।
আট. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের উন্নয়ন। মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সুবিধা ছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থাকরণ অভিভাবকদের তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করে। এতে করে মেয়েদের শিক্ষার হারের পাশাপাশি বাড়বে সচেতনতা।
নয়. বাল্যবিবাহ সম্পর্কে যে সকল আইনসমূহ আছে তার সঠিক বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ রয়েছে, যার সঠিক বাস্তবায়ন শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, গ্রাম ও মহল্লাতে সম্ভব। এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ, Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CEDAW) I Convention on the Rights of the Child (CRC)-এর নির্ধারিত আইনসমূহের যথাযথ প্রয়োগ করলে।
ফারাহ আদিবা : শিশু গবেষক, এনসিটিএফ, চাঁদপুর।