প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯
প্রবীণদের মোবাইলে আসক্তি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির। মোবাইল ফোন এখন কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি বিনোদন, শিক্ষা, খবর ও সামাজিক সম্পর্কের এক বিশাল জগত। প্রবীণরাও এর বাইরে নন। অনেক প্রবীণ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খবর দেখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানো, গেম খেলা বা ইউটিউবে ভিডিও দেখায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, তা একধরনের আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই মোবাইল আসক্তি নীরবে প্রবীণ জীবনের স্বস্তি, স্বাস্থ্য ও মানসিক ভারসাম্যকে নষ্ট করছে।
প্রথমত, শারীরিক ঝুঁকি। প্রবীণ বয়সে চোখ, হাড় ও মাংসপেশির স্বাভাবিক শক্তি অনেকটাই কমে যায়। দীর্ঘক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা, নিদ্রাহীনতা এবং হাত কাঁপার সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত ব্লু-লাইট চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা বয়সজনিত দৃষ্টিশক্তি হ্রাসকে আরও দ্রুত ঘটায়। আবার সারাক্ষণ বসে থেকে মোবাইল দেখা প্রবীণদের মধ্যে স্থূলতা, রক্তচাপ, ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
দ্বিতীয়ত, মানসিক ঝুঁকি। মোবাইল আসক্ত প্রবীণরা ধীরে ধীরে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। তারা একা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনে ডুবে থাকেনÑফলে সামাজিক সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীর সঙ্গে মেলামেশা কমে যায়, যার ফলে একাকীত্ব ও বিষণ্নতা বাড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যদের বিলাসবহুল জীবন বা সুখী ছবিগুলো দেখে প্রবীণদের মধ্যে তুলনামূলক হীনমন্যতা বা অসন্তুষ্টি তৈরি হয়। অনেকে নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েন, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তৃতীয়ত, জ্ঞানগত ঝুঁকি। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ কমে আসে। কিন্তু মোবাইলে একটানা ভিডিও, নোটিফিকেশন, তথ্য প্রবাহ মস্তিষ্ককে বিশ্রাম নিতে দেয় না। এই অতিরিক্ত উদ্দীপনা প্রবীণদের মনোযোগ বিভ্রান্ত করে, চিন্তাশক্তি কমিয়ে দেয় এবং স্মৃতি দুর্বল করে। ফলে তারা সহজেই ভুলে যান, কথায় গুলিয়ে ফেলেন, এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে যায়Ñযা ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।চতুর্থত, সামাজিক ঝুঁকি। মোবাইল আসক্ত প্রবীণরা প্রায়ই বাস্তব সম্পর্ক থেকে সরে গিয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েন। কখনো কখনো অচেনা মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত বিশ্বাস বা অর্থনৈতিক প্রতারণার ঘটনাও ঘটে। অনলাইন প্রতারণা, মিথ্যা খবর, কিংবা অশালীন কনটেন্টে প্রবেশ এসবের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ফলে প্রবীণরা সহজেই মানসিক চাপ ও সামাজিক বিপদের মধ্যে পড়ে যান।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ। মোবাইল ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা, বাস্তব জীবনের আড্ডা, হাঁটাহাঁটি, বই পড়া, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকা এসব অভ্যাস মোবাইল নির্ভরতা কমায়। পরিবারের সদস্যদেরও প্রবীণদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, সময় কাটানো উচিত, যেন তারা মোবাইলের একাকী জগতে হারিয়ে না যান।
সবশেষে বলা যায়, মোবাইল ফোন প্রবীণ জীবনে আশীর্বাদও হতে পারে, অভিশাপও। এর ব্যবহার যদি নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে এটি জ্ঞানের ও যোগাযোগের জানালা খুলে দেয়; কিন্তু আসক্তি হলে তা এক নীরব বিষের মতো জীবনের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। তাই প্রবীণদের জন্য মোবাইলের ব্যবহার হওয়া উচিত সংযত, সচেতন ও সীমাবদ্ধÑযাতে প্রযুক্তি জীবনের সহায়ক হয়, বাধা নয়।







