বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০১

মাদার তেরেসা : সেবায় ব্রত এক হৃদয়

রেহানা ফেরদৌসী
মাদার তেরেসা : সেবায় ব্রত এক হৃদয়

মাদার তেরেসা নামটি শুনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুসকিল। নামটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠে নীলপাড়-সাদা শাড়ি পরিহিত এক খ্রিস্টান নারীর কথা, যিনি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছেন মানবতার আলো জ্বালাতে। যার সারাটা জীবন কেটেছে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে। মাদার তেরেসার জন্ম ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট, আজকের ম্যাসেডোনিয়ার রাজধানী স্কপিয়োতে। আসল নাম আগ্নেস গঞ্জে বয়াজু। বাবা ছিলেন আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত এক ব্যবসায়ী। সচ্ছল এক পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বড় হয়ে ওঠেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্বদেশ ত্যাগ করে আয়ারল্যান্ডের সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায় মিশনারি হিসাবে যোগ দেন তিনি। ১৯২৮ সালে প্রথমবারের মত ভারতে যান মাদার তেরেসা এবং দার্জিলিং-এর লোরেটো কনভেন্টে সন্নাসী হওয়ার দীক্ষা নিতে শুরু করেন।

মাদার তেরেসা অনাথ শিশুদের জন্য একটি অনাথ আশ্রম তৈরি করেছিলেন এবং তাকে সাহায্য করার জন্য স্থানীয় শিশুদের সেখানে কাজ দিতেন। মাদার তেরেসা একজন ধর্মযাজিকার সঙ্গে নিয়মিত গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোতে যেতেন আর বালতিতে ফেলে দেওয়া শিশুদের কুড়িয়ে আনতেন। নান-রা বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করতেন এবং কাপড়ে মুড়ে তাদের নিয়ে আসতেন দেখাশোনা করার জন্য।

মাদার তেরেসা মনে করতেন, সমাজে জীবনভর অবাঞ্ছিত মানুষগুলোকে জীবনের শেষ মুহূর্তে এটুকু বোঝানো যে, তাদের প্রতি কোথাও ভালবাসা ও মমতা আছে। তিনি আরও মনে করতেন, কষ্ট পাওয়াটা যিশু খ্রিস্টেরই নির্দেশ। সেই কষ্ট ধারণ করে তা ঈশ্বরের পায়ে নিবেদন করাই তাঁর আদর্শ। দরিদ্রদের সাহায্য করার কাজটা প্রথম দিকে খুব সহজ ছিল না মাদার তেরেসার পক্ষে। অর্থের জন্য ধনী ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। হতাশাও পেয়ে বসেছে কখনও। তবে মিশনারিজ অফ চ্যারিটি অচিরেই দেশ বিদেশের দাতা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়িয়ে দেন অনেকে সাহায্যের হাত। মাদার তেরেসা নিজেকে কখনও সমাজকর্মী হিসাবে দেখেননি। তাঁর মতে ঈশ্বরের নির্দেশে তিনি দরিদ্রদের সেবায় ব্রতী হয়েছেন। ‘কাজটা তাঁর জন্য যেন উপাসনা’।

তাঁর অসংখ্য অনুসারী ও স্বেচ্ছাসেবী যারা তাঁর অনাথ আশ্রমে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মারি মারসেল থেকেকারা। মারি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ‘তাদের বাসা থেকে মাদার তেরেসার আশ্রম ছিল মাত্র ৫ মিনিটের পথ। প্রতিদিন সকালে স্কুল যাবার সময় মাদরকে দেখতেন মারি। ছোটখাট চেহারার মানুষÑখুব পরিশ্রম করতে পারতেন’।

বর্তমান ম্যাসেডোনিয়ার স্কপিয়েতে জন্ম নেওয়া ধর্মযাজিকা মাদার তেরেসা তাঁর দাতব্য কাজ প্রথম শুরু করেছিলেন কলকাতার রাস্তায়। তাঁর কাজের পরিধি বিস্তৃত ছিল বিশ্বের শতাধিক দেশে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সাড়ে চার হাজার ধর্মযাজিকা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সাড়ে চার হাজার ধর্মযাজিকা। তবে কলকাতার বস্তিবাসীদের নিয়ে তাঁর কাজ তাকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তুলেছিল এবং বিশ্বের মানুষের কাছে তাঁর আদর্শের প্রতীক হয়ে গিয়েছিল তাঁর নীলপাড় সাদা শাড়ি। ‘যেসব জায়গায় দেখা যেত অসুস্থ মানুষ তাদের বমি এবং মূত্রের মধ্যেই পড়ে আছে, তাদের নোংরা কাপড়চোপড়Ñউকুনের বাস সারা শরীরে। সেখানে মাদার তেরেসা বা তাঁর অনুসারীরা যে এ ধরনের মানুষকে নিজে হাতে তুলে আনছেন, তাদের পরিষ্কার করে তাদের আশ্রয় দিচ্ছেনÑসেটা ছিল তাদের অনেক দয়ামায়ার প্রকাশ’, বলছিলেন মারি।

ভারতে মাদার তেরেসার প্রথম কাজের ক্ষেত্র ছিল দার্জিলিং। লরেটো কনভেন্টে প্রথমে শিক্ষিকা ও পরে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিন্তু ১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি কোনো এক কাজে কলকাতা গিয়ে সেখানকার দারিদ্র দেখে ঠিক করেন তাঁর বাকি জীবন তিনি ‘হতদরিদ্রের’ সেবায় নিয়োজিত করবেন। ঐ দারিদ্র্য দেখার পরই তিনি তাঁর মিশনারিজ অফ চ্যারিটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

মিশনারিজ অফ চ্যারিটি একটি ক্যাথলিক ধর্মীয় সংস্থা, যা ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর মাদার তেরেসা কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য পরিচিত, যারা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল এবং অসহায়। সংস্থাটি মূলত চার ধরনের ব্রত পালন করে, যার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, সতীত্ব ও আনুগত্যের ব্রত, এবং সমাজের দরিদ্রদের মধ্যে বসবাস করে তাদের সেবা করার একটি বিশেষ ব্রত।

সংস্থার উদ্দেশ্য সবচেয়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের সেবা করা। তাদের আশ্রয় দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য করা। মাদার তেরেসার দেখানো পথে দরিদ্রদের মধ্যে বসবাস করে তাদের দেখাশোনা করা।

প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম ১৯৫০ সালে মাদার তেরেসা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা প্রথমে কলকাতায় শুরু হয়। সংস্থাটির কার্যক্রম দ্রুত ভারত ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মাদার তেরেসা ১২ জন সন্ন্যাসিনীর সাথে প্রথম এই সংস্থা শুরু করেন, যারা দরিদ্রদের সেবা করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।

সদস্য ও ব্রত

মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সদস্যরা দরিদ্রদের সেবা করার জন্য চারটি ব্রত পালন করে। এই ব্রতগুলির মধ্যে দারিদ্র্য, সতীত্ব, এবং আনুগত্য অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও সদস্যরা দরিদ্রদের মধ্যে বসবাস করে তাদের সেবা করার অঙ্গীকার করে, যা তাদের কাজের একটি মূল বৈশিষ্ট্য।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

২০২৩ সাল পর্যন্ত, এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫,৭৫০ জন সন্ন্যাসিনী সদস্য রয়েছেন। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি মাদার তেরেসার ‘দাতব্য’ বা ‘ওহংঢ়রৎধঃরড়হ ড়ভ ঈযধৎরঃু’ ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ১৯৮৩ সালে পোপ জন পল ২ এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোট গ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করে। অগত্যা তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে ফেলেন। আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তার বাম হৃৎপিণ্ডের নিলয়ে রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং ৫ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিজ অফ চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪,০০০; এবং ৩০০ জন ব্রাদারহুড ছিল। আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১০০,০০০ এর উপর। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে মোট ৬১০টি কেন্দ্রে ধর্মপ্রচারণার কাজ পরিচালিত হচ্ছিল। এসব কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ছিল এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র। সুপ কিচেন, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয়।

যেখানেই কোন মানুষের বিপদ সেখানেই তিনি সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভালবাসা দিয়ে মানুষের মাঝে কাজ করে যাওয়া মাদার তেরেসা কখনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি মূখ্য করে দেখেননি। তাই সব ধর্ম, বর্ণ, দেশ, জাতি নির্বিশেষে তাকে ‘মাদার’ বলে ডাকেন। সেবাকর্মের মহান ব্রত নেয়া মানুষটি ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে ১৯৮০ সালে দেশটির সর্বোচ্চ পদক ভারতরত্ন পদকে ভূষিত হন। জীবনের কোন পুরস্কারের অর্থ তিনি নিজের জন্য ব্যয় করেননি। তিনি তার নোবেল পুরস্কারের অর্থ দান করেছিলেন সেই সাথে তার জন্য নোবেল কমিটির ভোজনসভা বাতিল করে তার অর্থ ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মাদার তেরেসা তার সমগ্র জীবন শুধু মানুষের সেবাই করেননি, সেই সাথে মানুষকে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে অনুপ্রাণিতও করেছেন সর্বদা। এই মহান মহীয়সী নারীকে তাইতো সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়