বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৫০

সৌদিতে দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের মর্যাদা হ্রাসের কারণ

মোহাম্মদ সানাউল হক
সৌদিতে দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের মর্যাদা হ্রাসের কারণ

সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শ্রমবাজার, যেখানে ১০০টিরও বেশি দেশের প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ বিদেশি কর্মী বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং পেশায় নিয়োজিত। সাম্প্রতিক জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা ৫০ লাখের অধিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে অবস্থান করেন, যার সংখ্যা প্রায় ২.১২ মিলিয়নের উপরে।

১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিশ্বের নানা দেশে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ সৌদি আরবেই তাদের যাত্রা শুরু করে। এদের ভিতরে অনেকেই কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও দালালি, শ্রম বাণিজ্য ও ফুটপাতে দোকানদারিসহ বিভিন্ন কাজে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। পাশাপাশি নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা, কৃষিকাজসহ বহুমুখী ক্ষেত্রগুলোতে নিঃস্বার্থ পরিশ্রম করে তারা নিজেদের এবং পরিবারের জীবনের মান উন্নত করেছেন। তবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই সম্মানিত অবদানের পরও সৌদি সমাজে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মর্যাদা তাদের কৃতিত্বের তুলনায় এখনও যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সৌদি নাগরিকদের দৃষ্টিতে অনেক সময় বাংলাদেশি প্রবাসীরা বিরক্তিকর ও অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে কিছু প্রবাসীর অনৈতিক কর্মকাণ্ড, প্রতারণা বা আইনভঙ্গের ঘটনা, যা গোটা কমিউনিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ সময় ধরে সৌদি আরবে অবস্থান করলেও, সম্মান ও স্বীকৃতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এক ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের মুখোমুখি।

এছাড়া সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তারা এখনও অনেকক্ষেত্রে স্থানীয় নাগরিকদের অবহেলার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব পেশায় আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্থির কাজ, সেসব কাজে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োজিত। ট্রাফিক সিগনালে হেঁটে হেঁটে পানি বিক্রি, গাড়ি ধোয়া-মোছা থেকে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়ায় তাদের সামাজিক মর্যাদা আরও ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং সৌদি সমাজে তাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হয়ে উঠছে।

সৌদি প্রবাসীদের মতে, অনেক বাংলাদেশি প্রবাসীর মধ্যে ভাষাজ্ঞান ও স্থানীয় সংস্কৃতি বোঝার অভাবও একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। আরবি ভাষায় দক্ষতা না থাকায় তারা প্রায়ই নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না, ফলে চাকরির শর্তাবলি, আইনি নোটিশ বা নিয়মাবলী নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অনেক সময় দালাল বা অসাধু নিয়োগকর্তারা তাদের শোষণ করে। আবার ভাষাজ্ঞান না থাকায় স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়, যা সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করে এবং সামাজিকভাবে প্রবাসীদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা আরও পোক্ত হয়।

এছাড়া অনেক প্রবাসী অতিরিক্ত আয়ের আশায় ভাড়া করা দোকানে অনুমোদনহীন ব্যবসা পরিচালনা কিংবা মজুরি ছাড়া অতিরিক্ত কাজ করার মতো অবৈধ পথে জড়িয়ে পড়েন। এসব কর্মকাণ্ড ধরা পড়লে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশি কমিউনিটির সার্বিক ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। সৌদি আইন অমান্য করে কোনো কাজ করলে তা শুধু আর্থিক জরিমানা বা কারাদণ্ডের কারণ হয় না, বরং বহিষ্কারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে দীর্ঘ সময়ের শ্রম ও স্বপ্ন এক মুহূর্তেই ধুলিসাৎ হয়ে যায়।

আরেকটি দোষত্রুটি হলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যের অভাব। একই দেশের প্রবাসীদের মধ্যে হিংসা, প্রতিযোগিতা ও অসহযোগিতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কোনো একক ঘটনার জন্য পুরো কমিউনিটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে একে অপরকে দায়ী করার প্রবণতা দেখা দেয়, কিন্তু সমস্যা সমাধানে একত্রিত হয়ে কাজ করার মানসিকতা কম। এর ফলে স্থানীয় প্রশাসন ও নিয়োগকর্তাদের কাছে বাংলাদেশি শ্রমিকরা অনির্ভরযোগ্য ও অসংগঠিত হিসেবে পরিচিত হয়, যা তাদের প্রতি সামাজিক সম্মান কমিয়ে দেয়।

অন্যদিকে, অন্যান্য দেশের অভিবাসীরা সাধারণত সৌদি শ্রমনীতির সীমাবদ্ধতার মধ্যেই স্বল্প বেতনে চাকরি করেন অথবা প্রয়োজনীয় আইনি অনুমোদন নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করেন। ফলে তারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে সক্ষম হন।

প্রবাসী আলি আহমেদ জানান, অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী কাজের পরিবেশ বা বেতনে অস্থির হয়ে পড়েন, যার ফলে অনেকে অনুমোদনহীন পথে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে বেশ কিছু রয়েছে, চাকরি ছেড়ে রাস্তার পাশে আলু, পেঁয়াজ, শাকসবজি বা মৌসুমি ফল বিক্রির মতো নিষিদ্ধ কাজ শুরু করেন। সৌদি আরবে এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইনত দণ্ডনীয়। ফলে তারা নিজে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন এবং দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়। এই প্রবণতা রোধে প্রবাসীদের সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও আইনি জ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে।

সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরের রাস্তার দুপাশে যেসব ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা দেখা যায়, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি। সৌদিতে অবস্থানরত প্রায় ১০০ দেশের মধ্যে এ ধরনের কাজে অন্য কোনো দেশের প্রবাসীদের খুব কমই দেখা যায়। পাশ্ববর্তী ইয়েমেনের কিছু নাগরিকের মধ্যেও এ প্রবণতা থাকলেও, বাংলাদেশিরাই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সৌদি নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বুঝে গেছেন যে বাংলাদেশি প্রবাসীরা এসব কাজে অত্যন্ত দক্ষ ও অভ্যস্ত।

রাজধানী রিয়াদের বাথা-হারা অঞ্চলে সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের আলু, পটল, তরি-তরকারির জমজমাট বাজার বসে। তবে শুক্রবার এলেই যেন পুরো এলাকা রূপ নেয় বাংলাদেশের এক খণ্ড হিসেবে। এখানে প্রবেশ করলে বোঝা কঠিন হয় যে এটি ভিন্ন কোনো দেশ। চারপাশে বাংলা ভাষা, দেশীয় পণ্য আর জনসমাগমে তৈরি হয় স্বদেশের এক প্রতিচ্ছবি। যদিও এই চিত্র অনেক সময় স্থানীয় ও অন্যান্য বিদেশি নাগরিকদের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সৌদি আরবে যেসব পেশায় প্রবাসীদের জন্য বিধিনিষেধ রয়েছে, সেসব ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ কাজেই বাংলাদেশি প্রবাসীদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়। রাজধানী রিয়াদের বাথা-হারা অঞ্চলে প্রতিদিনই এসব কর্মকাণ্ড চলে, যেখানে নিয়মিত পুলিশের অভিযান হয়। নিষিদ্ধ এই কাজের কারণে প্রতিদিন শত শত প্রবাসী আটক হন। অনেক সময় পুলিশের উপস্থিতির খবর পেয়ে তারা দ্রুত তরি-তরকারির ঝুড়ি ফেলে পালিয়ে যান। না দেখলে বোঝা কঠিন হবে যে, এই এলাকায় প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটে।

সৌদি প্রবাসী নাইম বলেন, সৌদি আরবে যদি কারো কর্মদক্ষতা থাকে, তাহলে কোনো দিন ভাতের অভাব হয় না। ভাষা জানা থাকলে যে কোনো স্থানে বৈধ উপায়ে কাজের সুযোগ থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক কম-বেশি হতে পারে, তবুও যদি কেউ দক্ষতা ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করে, তাহলে অন্তত পুলিশ প্রশাসনের হয়রানি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

বাংলাদেশি প্রবাসীদের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরিক্ত লোভ ও দ্রুত লাভের আকাক্সক্ষা। সৌদি আরবের হারা-বাথা অঞ্চলে ফুটপাতে তরি-তরকারি, আলু-পটল বিক্রি করে স্বল্প সময়ে বেশি আয় করার সুযোগ থাকলেও, অনেকেই ১২০০ থেকে ১৫০০ রিয়াল বেতনে বৈধভাবে কাজ করতে চান না। ফলে যথাযথ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তারা শ্রমবাজারে অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন, যা দেশের ভাবমূর্তিকেও নেতিবাচক প্রভাবিত করছে।

সৌদি নাগরিক ও প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি অবজ্ঞা ও অপমানের আরও একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শ্রমিকদের পরিবেশ সচেতনতার অভাব। অনেক শ্রমিক যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা ও পাবলিক স্থানে মলত্যাগ করার মতো কুপ্রবৃত্তি সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই অশুচিতা ও পরিবেশ দূষণ স্থানীয় জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য ও অবজ্ঞার মাত্রা বাড়ায়।

পরিবেশ দূষণের এই প্রবণতা শ্রমিকদের নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। সৌদি সমাজে পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কঠোর আইন পালন করা হয়। শ্রমিকদের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের অভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তা তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। এর ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দের কাছে তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।

রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব (প্রেস) আসাদুজ্জামান খান জানান, “সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সরকার সবসময় আন্তরিকভাবে কাজ করছে। অবৈধ কর্মকাণ্ড বা আইন লঙ্ঘনের সঙ্গে কেউ যুক্ত থাকলে, তার দায়ভার গোটা কমিউনিটির ওপর এসে পড়ে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা প্রবাসীদের নিয়মনীতি মেনে চলা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং বৈধপথে জীবিকা নির্বাহের বিষয়ে নিয়মিতভাবে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, “সৌদি সমাজে মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকতে হলে আমাদের শ্রমিকদের নিজ নিজ দায়িত্ববোধ, পরিবেশ সচেতনতা এবং পেশাগত নৈতিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।”

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়