প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:১০
জ্বরের সাতকাহন
এ জীবনে জ্বরে ভোগেননি তেমন কেউ কি আছে? খুঁজে পাওয়া নিশ্চয়ই বিরল। জ্বর আসলে কোন রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। যখন কোন মানুষের দেহে জীবাণুর সংক্রমণ হয় কিংবা ব্যথাজনিত কারণে প্রদাহ হয়, তখন শরীরের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। ফলে দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। একে জ্বর নামে অভিহিত করা হয়। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হলো ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে তাকে জ্বর বলে।
রোগের সর্বাধিক পুরোনো লক্ষণ হলো জ্বর। সভ্যতার সূচনালগ্ন হতেই এর সংশ্লিষ্টতা। সাধারণ মানুষ সভ্যতার সূচনার দিকে জ্বরকে অশুভ আত্মার দন্ড হিসেবে দেখতো এবং মৃত্যুর পরোয়ানা হিসেবে চিন্তা করতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রাচীন গ্রিসের পন্ডিতেরা রোগের ওপর জ্বরের প্রভাবকে জীবনের জন্যে উপকারি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উনিশ শতকের দিকে জ্বরকে জীবনের জন্যে ক্ষতিকর চিন্তা করা হয় এবং বিংশ শতকের সূচনায় জ্বর নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়।
জ্বর বিষয়ে জানতে হলে কয়েকটা বিষয়ে জানা জরুরি । জ্বর কখন আসে, কখন যায়, কীভাবে ওঠে, কীভাবে পড়ে, কাঁপায় বা শীত শীত করে কি না, ঘাম দেয় কি না, জ্বর কখন বাড়ে, কখন কমে, কত ঘন্টা পর পর উঠে এ বিষয়গুলো জানা জরুরি হয়ে পড়ে।
জ্বরের কিছু নাম আছে। যেমন : বাতজ্বর, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া জ্বর, টাইফয়েড জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর, ভাইরাস জ্বর, চোরা জ্বর, টিকার জ্বর, ব্যথার জ্বর ইতাদি।
জ্বরের চিহ্ন
* শীত শীত করা, কেঁপে কেঁপে ওঠা
* সারা গায়ে ব্যথা বোধ হওয়া
* ঘাম দেওয়া
* ত্বক তপ্ত হয়ে ওঠা
* হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া
* খেতে অরুচি
* পিপাসা বৃদ্ধি পাওয়া
পাঁচ বছরের নিচ শিশুদের কেউ কেউ অত্যধিক জ্বরে ভুগে খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়। এটাকে জ্বরজনিত খিঁচুনি বলে।
জ্বরের কারণ
* জীবাণুর সংক্রমণ যেমন : ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস
* কোভিড ১৯
* অন্ত্রে সংক্রমণ
* মূত্রনালী ও মূত্রথলিতে সংক্রমণ
* ত্বকের ইনফেকশন
* কতিপয় ঔষধ সেবনের প্রতিক্রিয়া
* টিকার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
* ক্যান্সার
* অটো ইমিউন অবস্থা
জ্বর মাপার স্থান ও কৌশল
জ্বর পায়ুপথ, বগলের নিচে এবং জিভের তলে থার্মোমিটার রেখে মাপার রেওয়াজ আছে। বগলের নিচে পাওয়া মানের সাথে এক যোগ করে কিংবা পায়ুপথের অভ্যন্তরে থার্মোমিটার রেখে পাওয়া মান থেকে এক বাদ দিয়ে অথবা মুখে জিহ্বার নিচে পাওয়া তাপমাত্রাকে হুবহু ধরে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর মাপা হয়।
জ্বর কমানোর কৌশল
* অ্যাসিটামিনোফেন বা প্যারাসিটামল সেবন
* প্যারাসিটামল বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় সাপোজিটরি ব্যবহার
* মাথায় জলপট্টি দেওয়া
* মাথায় ঠাণ্ডা পানির ধারা ব্যবহার
* সারা শরীর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া
কিছু কিছু জ্বর চেনার কৌশল
* জ্বর সাথে কাশি : সম্ভাবনা : নিউমোনিয়া
* নির্দিষ্ট সময় অন্তর কেঁপে কেঁপে জ্বর : সম্ভাবনা : ম্যালেরিয়া
* সিঁড়ির ধাপের মতো জ্বর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া : সম্ভাবনা : টাইফয়েড
* দুপুরের পরে জ্বর ও ঘুষঘুষে কাশি : সম্ভাবনা : যক্ষা
* উচ্চ মাত্রার জ্বর ও মাথাব্যথা, সারা শরীর ব্যথা : সম্ভাবনা : ডেঙ্গু
* জ্বর, পেটে ব্যথা ও বমি : সম্ভাবনা : অন্ত্রের সংক্রমণ
* গায়ে গায়ে জ্বর, খেতে অরুচি, ওজন হ্রাস : সম্ভাবনা :
* ক্যান্সার
* কেঁপে কেঁপে জ্বর ও প্রস্রাবে যন্ত্রণা : সম্ভাবনা : মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ
* জ্বর, বমি ও খাবারে গন্ধ : সম্ভাবনা : জন্ডিস বা ভাইরাল হেপাটাইটিস।
* জ্বরে র্যাশ ও গুটি হলে মিজলস্ বা চিকেন পক্সের সংক্রমণ হতে পারে।
জ্বর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার ছেলেবেলা’ শীর্ষক আত্মজৈবনিক গ্রন্থে খুব চমৎকার করে স্মৃতি চারণ করেছেন। স্কুল কামাই দেওয়ার জন্যে যাতে জ্বর ওঠে সেজন্যে তিনি বহু চেষ্টা করেছেন। মোজা ভিজিয়ে পায়ে দিয়ে সারাদিন রোদে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু জ্বর তাতে আসেনি। আবার তখনকার দিনে জ্বর হলে ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ানো হতো, একথাও তিনি বলেছেন। তবে জ্বর যেদিন ভালো হতো সেদিন মৌরলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে দিতো। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রকে রবীন্দ্রনাথ প্রবল জ্বরে ভুগিয়েছেন। জ্বর এমন মাত্রায় ছিলো যে, ফটিক জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিল, ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না’, ইত্যাদি। জ্বরের ঘোরেই সে মাকে বলেছে, ‘মা, আমার ছুটি হয়েছে, আমি বাড়ি যাচ্ছি’।
বাংলা বাগধারাতে অনেকে জ্বরকে নিয়ে এসেছেন অবলীলায়। তাই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া বললেই বিপদ হতে মুক্তি বুঝানো হয়। কেউ কেউ জ্বর হলে টক টক আনারস খেতেন দাঁতে কামড়িয়ে। এতে নাকি জ্বর চলে যেতো অনেকটা বিষে বিষ ক্ষয়ের মতো। আগেকার দিনে জ্বর হলে স্নান করতে বারণ ছিলো বটে। তবে এখন জ্বর হলে যাতে তাপমাত্রা বেশি না উঠে সেজন্যে স্নান বা গোসল করাকে উৎসাহিত করা হয়। আগে জ্বর মাপতে পারদের থার্মোমিটার বগলে বা মুখে জিহ্বার নিচে চাপতে হতো। কিন্তু ওটা ছিল অস্বাস্থ্যকর। তাই আজকাল বাজারে এসেছে ডিজিটাল থার্মোমিটার যা কপালে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ধরলেই জ্বর মেপে দিতে পারে সহজে। অনেকে বাড়াবাড়ি অনুরাগ বোঝাতে জ্বর শব্দটা ব্যবহার করেন। যেমন : বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে বাংলাদেশ। এমনি করেই বিতর্কপ্রাণ এক অগ্রজ নিজেকে বিতর্কের জ্বরে আক্রান্ত বলতে ভালোবাসতেন। যাদের জ্বর অল্প থাকে তাদের জ্বরকে বলে ভালুক জ্বর। আসলে অলীক জ্বর বুঝাতে ‘ভালুক জ্বর’ কথাটির অবতারণা। অনেককেই বলতে শোনা যায়, বগলের নিচে রসুন রাখলে নাকি গায়ের তাপমাত্রা বাড়ে। কথাটা আসলে কতটুকু সঠিক তা বলা যায় না। কেননা, আমাদের দেহে জ্বরের কেন্দ্র হলো হাইপোথ্যালামাস যা মস্তিষ্কে অবস্থান করে।