প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
আমার স্কুল জীবন
গাজী সালেহ উদ্দিন
পাঞ্জাবিলেনের রেলের বাসার লাগোয়া পাহাড়তলী গার্লস স্কুল, স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সালেহা চৌধুরী আমার বন্ধু কামালের মা। আমার মা একদিন নিয়ে ভর্তি করে দিলেন স্কুলে, সম্ভবত ১৯৫৪-৫৫। কিন্তু আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না, এটি মেয়েদের স্কুল বলে কি-না জানি না তবে মা যতোক্ষণ থাকতেন ততোক্ষণ থাকতাম, তারপর মায়ের সাথে বাসায় চলে আসতাম। আমার কান্নাকাটিতে মহাবিরক্ত হয়ে স্কুল ছাড়িয়ে আনলেন। আমার নাম দিলেন লেবা অর্থাৎ বোকা। এর দ্বারা লেখাপড়া হবে না, সে ঘরে থাকুক। লেখাপড়া প্রতি অনিহা ছিলো খেলাধুলা করতে ভালোবাসতাম বেশি। ঘুড়ি ওড়ানো, মার্বেল খেলা, ডাণ্ডাগুলি, লাট্টু, চোর পুলিশ। কিন্তু বিপদ কাটেনি। আমার বাবা ছোট ভাই গাজী শামছু উদ্দিন ও আমাকে পাহাড়তলী পিই রেলওয়ে স্কুলে ১ম (শিশু শ্রেণী) ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেই লেখাপড়া শুরু। দুভাই একই ক্লাসে পড়তাম, ক্লাস নাইন পর্যন্ত একসেট বই, কারণ বাবার আর্থিক ক্ষমতা ছিলো না। সাত ভাই এক বোন, তারপর দেখেছি বাবার আত্মমর্যাদা। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন স্কুলে পুওর ফান্ডের জন্যে আবেদনপত্র আহ্বান করছিলো। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা বুঝে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম পুওর ফান্ডের জন্যে আবেদন করবো কি-না? বাবা আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন ‘তুই হইরনি’ (তুই ফকির নাকি)। কিন্তু আশির দশকে আমি পাহাড়তলী গার্লস্ স্কুলের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় দেখেছি অনেক ছাত্রী অবস্থাপন্ন পরিবারের নিজস্ব গাড়িতে করে স্কুলে আসা যাওয়া করে তাদের অভিভাবকরা ও পুওর ফান্ডের জন্যে আবেদন করে।
ষাটের দশকে শিক্ষকগণ খুব একটা প্রাইভেট টিউশনি করতেন না, যেমন একজন বোরহান স্যার ছিলেন। তিনি অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়াতেন। তবে প্রত্যেক ছাত্রকে হারিকেন নিয়ে যেতে হতো, কারণ তখনও বিদ্যুৎ বাসায় আসেনি। আমি কখনো প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়িনি। কারণ বাবার আর্থিক অবস্থা। জ্যামিতি আলজাব্রা মাথায় একদম ঢুকতো না। এসএসসিতে পরীক্ষা দিয়েছি মুখস্থ করে, তাই স্পষ্ট মনে আছে ৬৪ পেয়েছিলাম। এরপর বিদঘুটে এ বিষয়ের ধারে-কাছে ছিলাম না।
ছোটবেলায় প্রত্যেকের ভিশন থাকে ভবিষ্যতে কী করবে কী হবে। আমার ধারণা এই অভিলাষ হয় তার পারিপার্শ্বিকতার অভিজ্ঞতার উপর, আমার ইচ্ছা ছিল রেলইঞ্জিনের ড্রাইভার হওয়া। কারণ রেললাইন পাশে দাঁড়িয়ে যখন দেখতাম লম্বা রেল গাড়ি হুস হুস করে একজন ব্যক্তি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে শাবল দিয়ে কয়লা বয়লারে ফেলছে, দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠা-তখন তাকে আমার কল্পনায় সবচেয়ে শক্তিধর হিরো মনে হতো। একটু বড় হলে যখন এইট/নাইনে পড়তাম তখন মনে হতো দস্যু মোহন অথবা কিরিটি রায় হবো। শশধর দত্তের ‘দস্যু মোহন’ এবং নীহাররঞ্জন রায়ের ‘কিরিটি রায়ের’ চরিত্র মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো। তবে শিক্ষক হবো এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা বা আগ্রহ কখনো ছিলো না।
পাহাড়তলী রেলওয়ে রিক্রেশন ক্লাব থেকে বই নিয়ে লুকিয়ে ক্লাসে পড়তাম, ক্লাবের একজন কর্মকর্তা আবেদ সাহেব, তিনি আমাদের পাড়ায় থাকতেন। তাই আমি আর আমার বন্ধু শামসুল হুদা ক্লাবে সদস্যগণ আসার পূর্বে পত্রিকা পড়তাম, বই সংগ্রহ করতাম। কারণ তখন পত্রিকা বাসায় বিক্রি হতো না, কোনো স্টলে অথবা ক্লাবে পাওয়া যেতো।
বাংলা ভাষা আন্দোলন বা একুশে ফেব্রুয়ারি সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো না। কিন্তু একটা ব্যাপার ছিলো সেটি হচ্ছে যে আগের রাতে বিভিন্ন বাসা থেকে ফুল চুরি করে, নগ্ন পায়ে কলোনি হেঁটে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিতাম এবং গান গাইতাম আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। সম্ভবত সেটা থেকে আমাদের দেশপ্রেম, বাংলাপ্রীতি মনে জাগরুক হয়।
পাহাড়তলী রেল স্কুল চট্টগ্রাম শহরের তিনটি স্কুলের মধ্যে অন্যতম অন্য দুটি কলেজিয়েট ও মুসলিম হাই স্কুল, শিক্ষা ও ক্রীড়ার মান নিয়ে সবসময় প্রতিযোগিতা চলতো। আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন বর্তমান নওগাঁ জেলার এসএ লতিফ, যেমন রাশভারী, দাম্ভিক, দক্ষ প্রশাসক, শিক্ষক হতে ছাত্ররা সবাই যমের মতো ভয় করত। তাঁর মুখে হাসি দেখেছে এমন শিক্ষক-ছাত্র ছিলো না বললেই চলে। স্যারের দুটো বিষয় এখন আমি অনুকরণ করি। ১৯৬৬ সাল, আমি ক্লাস টেনের ছাত্র। আমি ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন। আন্তঃস্কুল ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতায় আমরা এবং কলেজিয়েট স্কুল ফাইনাল, জানতে পেরেছিলাম কলেজিয়েট স্কুল প্লেয়ার ভাড়া করেছে, সে সময়ে এর চল ছিলো। আমাদের ড্রিল শিক্ষক বারী স্যারের পরামর্শে দুরু দুরু বক্ষে আমিসহ কয়েকজন হাজির হলাম স্যারের রুমে। আমাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তিনি বক্তব্য দিলেন, নিজের স্বকীয়তা চলবে, নিজের যোগ্যতায় খেলবে এবং লড়বে, ভাড়া করা খেলোয়াড় দিয়ে জয় পেলেও তাতে আনন্দ নেই। আমরা যদিও এক গোলে হেরে গিয়েছিলাম। তারপরও যে আনন্দে আমরা খেলেছিলাম সেটা এখনো মনে আছে। তাই সমাজতত্ত্ব বিভাগের অথবা ছাত্রছাত্রীরা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে আমি কখনো বাহির থেকে কোনো শিল্পী ভাড়া করার উদ্যোগ নিতে নিরুৎসাহিত করতাম। আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের কয়েকজন ছাত্র সিএমই রেলওয়ে বাংলোতে গিয়ে গাছ থেকে বরই পেড়েছিল। সেটি সিএমই স্ত্রী টেলিফোনে অভিযোগ করেছিলো আমাদের প্রধান শিক্ষকের কাছে। তখন রেলওয়ে অফিসারদের সম্মান ও দাপট ছিলো। তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন যে আমার ছাত্ররা এ ধরনের কাজ করতেই পারে না। কিন্তু পরে সে ছাত্রদেরকে তিনি শাস্তি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ বাইরে স্কুলের সম্মান রেখেছেন এবং ছাত্রদেরকে শাসন করেছেন। সকাল পৌনে দশটায় ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে আমরাও লাইন করে স্কুলের সামনে এসেম্বলিতে লাইনে দাঁড়াতাম, স্কাউটদের ড্রামের তালে তালে শরীরচর্চা করতাম। দুপুরবেলা টিফিন প্রত্যেক ক্লাসের ক্যাপ্টেন বিলি করতো। বৃষ্টির সময় ছাতা ছিলো আমাদের বড় কচু গাছের পাতা, এই টান কচুগাছ অনেকের বাসার পিছনে প্রচুর হতো। প্রত্যেক বছর খেলাধুলা প্রতিযোগিতা ব্রতচারী হতো। স্কুলের কঠিন আইনের মাধ্যমেও আমরা খুব আনন্দ পেতাম।
আমাদের সময়ে কোনো ক্লাস শিক্ষক নেননি এমন খুব কম ছিলো, কোনো কারণে একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকতেন পরিবর্তে আরেকজনকে পাঠাতেন প্রধান শিক্ষক। সন্ধ্যায় আজানের সাথে সাথে ঘরে ফেরার নিয়ম ছিলো, পড়াশোনা তাগিদ দিতেন মা। সন্ধ্যার পর পাঞ্জাবি লেইনে রাস্তায় হাঁটলে শুধু গুনগুন শব্দ আসতো পড়াশোনার। বর্তমানে যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। স্কুলের জন্যে শুধুমাত্র এক সেট পোশাক ছিলো। কোনো কারণে ময়লা হয়ে গেলে স্কুল থেকে এসে কেঁচে দেয়া হতো। পিপাসা লাগলে পানি খেতাম রাস্তার পাশে টেপে।
বর্তমান ছাত্রদের লেখাপড়ার মান, লেখাপড়া নিয়ে পোশাক নিয়ে কথা বললে অনেক কথা চলে আসে। আমাদের অবস্থা শুনলে তারা হয়তো বিশ্বাস করবে না। হয়তো হাসবে।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক;
সাবেক অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।