বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ০৯:৩৪

বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া।...

বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা কমেছে। বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার যে বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শিক্ষা খাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। খরচ করা ওই টাকার পরিমাণ ছিল সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশ। অথচ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। শিক্ষামানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমার বিষয়টি কিছুটা হতাশার। কারণ যেকোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হলো ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কীভাবে আশা করব?

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে শুধু ভবিষ্যতের মানবসম্পদই গড়ে তোলা হয় না; একই সঙ্গে জাতির উন্নয়ন কাঠামোর ভিত্তিও নির্মিত হয়। আজকের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে জনশক্তিকে দক্ষ ও উপযোগী করে তুলতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে উন্নত বিশ্ব এই বিনিয়োগ শুধু জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশগুলো কীভাবে শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়ে জাতীয় উন্নয়নে ব্যবহার করছে, তা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, এ নীতি কেবল একটি খাত নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গতিশীল করার মূল হাতিয়ার।

জার্মানি পৃথিবীর অন্যতম উদাহরণ, যারা ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম’-এর মাধ্যমে শিক্ষাকে সরাসরি কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এখানে শিক্ষার্থীরা স্কুলে পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের বাজেটে বিশাল অংশ বরাদ্দ থাকে এ কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। জার্মান সরকার প্রতি বছর শিক্ষা খাতে প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে, যার বড় অংশ পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষায়। ফলে জার্মানির যুব বেকারত্বের হার ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন ২০২৪ সালে যা ছিল মাত্র ৫.৭ শতাংশ। এখানকার শিক্ষার্থী মাত্র ১৮ বা ১৯ বছর বয়সেই চাকরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং শিল্পক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে।

ফিনল্যান্ড সরকার বিশ্বাস করে, শক্তিশালী জনশক্তি গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হলো মানসম্পন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। ফলে ফিনল্যান্ডে ১৫-২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত। এ ধারাবাহিকতা দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করেছে এবং উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় ফিনিশ যুবসমাজের অংশগ্রহণ অনেক বাড়িয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার উঠে আসার অন্যতম রহস্য শিক্ষায় অগ্রাধিকার। ১৯৬০ সালে যেখানে দেশটির সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৯৯ শতাংশে। বর্তমান বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়। সরকার শিক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। এ বিনিয়োগ সরাসরি ফল দিয়েছে: স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই-এর মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে দক্ষ কোরিয়ান কর্মীর মাধ্যমে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কোরিয়ান শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাহিদা ক্রমবর্ধমান।

কানাডা শিক্ষা খাতে প্রতি বছর গড়পড়তা ৪০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেয়। দেশটির বিশেষত্ব হলো- শিক্ষাকে তারা শুধু জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখেই না, বরং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, অভিবাসী- সবার জন্য উচ্চশিক্ষায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে।

ফলস্বরূপ, কানাডায় বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মানুষ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। এখন কানাডার অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মী।

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া। বাংলাদেশ যদি এ দিকগুলো মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করে, তাহলে কর্মসংস্থানের সংকটও কমবে এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত হবে দৃঢ়ভাবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের প্রসঙ্গটি কীভাবে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব হবে তা খুঁজে দেখার ন্যায্যতা অনেক বেশি। বেকারদের আগামীর জীবন অনিশ্চয়তা থেকে কাটিয়ে তুলতে কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক ভাবনা অধিকভাবে বাড়ানোর ন্যায্যতা অতিমাত্রায় অনুভূত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশার বাণী হলো, দেশের উন্নয়নে তরুণদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদ্যাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এমন তহবিল এবারই প্রথম।’ আমরা জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই তরুণ। যারা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশাল এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন নীতি থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি।

শুধু তরুণ উদ্যেক্তাদের জন্য নয়, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কীভাবে শিক্ষা কাঠামোকে কর্মসংস্থানমুখী করে তোলা যায়- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানোর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য বাজেটের প্রসঙ্গ নিয়ে পুনরায় ভেবে দেখার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট কাটিয়ে উঠতে কীভাবে শিক্ষাব্যস্থাকে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব করে তোলা যায়- সে বিষয়ে একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বরাদ্দের বিষয়টি বিশেষভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়