বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩১

রোবট শিক্ষক এবং মানব শিক্ষক

ড. এম মেসবাহ উদ্দিন সরকার এবং ড. মো. বিল্লাল হোসেন
রোবট শিক্ষক এবং মানব শিক্ষক

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বর্তমান সময়ে এমন একপর্যায়ে পৌছেছে যা ইতিমধ্যেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানাক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির এই অগ্রগতি এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। শিক্ষা প্রশাসন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সময় ও অর্থ সাশ্রয়সহ অনেক সুবিধা ইতিমধ্যে চলমান রয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে মূল্যায়ন ও পাঠদানে সুবিধা পাচ্ছেন শিক্ষকগণ। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে কৌতূহলী শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের পাঠগ্রহণে আকৃষ্ট হচ্ছে।

প্রযুক্তি এখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি রোবট শিক্ষক এখন বিভিন্ন দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে রোবট শিক্ষক কি আসলেই মানবশিক্ষকের বিকল্প হতে পারবে, নাকি সহায়ক হবে। রোবট শিক্ষক মূলত একটি প্রোগ্রামযোগ্য যন্ত্র। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এই রোবট শিক্ষকেরা জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, শিক্ষার্থীর শেখার ধরন বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে উপযোগী পদ্ধতিতে পাঠদান করতে পারে। রোবট শিক্ষক শিক্ষার্থীর দুর্বল বিষয় শনাক্ত করে সেই বিষয়ের ওপর বেশি মনোযোগ দিতে পারে। এরা ক্লান্ত হয় না, বিরক্ত হয় না, বিরতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না এবং এর তথ্যভান্ডার থেকে অসংখ্য তথ্য প্রদান করতে সক্ষম। তথ্য বিশ্লেষণ এবং নির্ভুল উত্তর প্রদান করতে পারে। এরা নিরপেক্ষ ও দীর্ঘ মেয়াদে সাশ্রয়ী। এদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন নেই।

রোবট শিক্ষকরা পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত এবং সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে। তারা দ্রুত ভুল শনাক্ত করতে পারে এবং পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পাঠের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। রোবট শিক্ষকরা শুধু শিক্ষাবিদ নন, তারা স্মার্ট ডেটা সংগ্রহকারীও। এরা সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারে শিক্ষার্থী ক্লাসে কেমন করছে এবং তার কী সাহায্য দরকার। সব প্রতিষ্ঠানে একই রকম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানবশিক্ষক না-ও থাকতে পারে। সাধারণত কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা একটু কম সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু রোবট শিক্ষক একই মানের হওয়া সম্ভব। অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে ভয় পায়। কারণ, তারা মনে করে, স্যার কী না কী মনে করেন। কিন্তু রোবটকে প্রশ্ন করতে শিক্ষার্থীদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী প্রথম বারেই শিক্ষকের পড়ানো বুঝতে পারে না। তারা ক্লাস শেষে রোবটের সহযোগিতা নিয়ে অনেকবার একই টপিক নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। একই টপিক শিক্ষকদের প্রতি বছর পড়াতে হয়। এতে মানবশিক্ষকের একঘেয়েমি লাগতে পারে কিন্তু রোবট এই একঘেয়েমি থেকে মুক্ত।

অন্যদিকে মানবশিক্ষক কেবল পাঠদান করেন না, তারা শিক্ষার্থীদের জীবনে মানসিক ও নৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মানবশিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও দলগত কাজের গুরুত্ব বোঝাতে পারদর্শী। এমনকি তাদের কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুপ্রেরণামূলক আচরণ শিক্ষার্থীদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই ধরনের আন্তঃসম্পর্ক ও মূল্যবোধ শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য, যা রোবট শিক্ষকের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়াতে মানবশিক্ষক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধু শিক্ষাদান করেন না, বরং শিক্ষার্থীর ভেতর আত্মাবিশ্বাস ও মানবিক গুণাবলি জাগত করেন। রোবট শিক্ষক প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, যেমন সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যারের ত্রুটি, ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যা অথবা সিস্টেম আপডেটের কারণে অস্থিরতা ইত্যাদি। মানবজীবনকে আরো সহজ করতে দৈনন্দিন কাজে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি মানুষের পরিশ্রম কমিয়ে দেওয়ার কারণে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হতে পারে। এআই ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহের ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুন্ন হতে পারে। এআই মেশিনের সিদ্ধান্ত মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সব সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে।

শিক্ষক যখন ক্লাস নেন, তখন শুধু পড়ান না, বরং ক্লাস ম্যানেজ করার ব্যাপার থাকে। কেউ ক্লাসে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে কি না, এগুলো দেখা এবং প্রয়োজন হলে শাস্তি দেওয়া। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা। সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদব শেখানো।

কেরালার একটি স্কুলে রোবট 'আইরিস' নামে ভারতের প্রথম এআই শিক্ষক চালু করা হয়েছে। চীনে 'স্কুইরেল এআই' নামে একটি এআই টিউটরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যক্তিগতকৃত উচ্চ-মানের শিক্ষা লাভ করছে। চীনের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোয় শিক্ষকের সহকারী হিসেবে কাজ করছে রোবট। রোবট স্ক্রিনে নানা দৃশ্য দেখিয়ে শিশুদের পড়াচ্ছে এবং শিশুদের নানা ধাঁধার উত্তর মেলানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় শেখাচ্ছে। চীনে প্রায় ৬০০ কিন্ডারগার্টেনে 'কিকো রোবট' ব্যবহার শুরু হয়েছে। চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে এর ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন নির্মাতারা।

জাপানে ইতিমধ্যে রোবট শিক্ষকের পরীক্ষামূলক ব্যবহার পরিচালিত হয়েছে। ব্রিটেনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও কয়েক শ স্কুলে এই রোবট শিক্ষক দিয়ে পড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। রোবটের পাশাপাশি ড্রোনকেও এ কাজে লাগানো নিয়ে গবেষণা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার আটলান্টায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে জিল ওয়াটসন। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার কাজ। জিল ওয়াটসন মূলত একটি রোবট। সে কতটা দক্ষ, তা যাচাইয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে জিলের পরিচয় গোপন রাখা হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বুঝতেই পারেনি যে জিল মানুষ নয়, রোবট! তবে অন্যদের চেয়ে জিল যে অনেক দ্রুত ও শুদ্ধভাবে উত্তর দিতে সক্ষম, তা ধরা পড়ে। আইবিএম-এর রোবটিক প্রযুক্তিতে অনলাইন কোর্স ও স্বয়ংক্রিয় গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থাও রয়েছে। রোবট শিক্ষকদের দক্ষতা দিন দিন বাড়ছে।

পড়াশোনায় শিশুদের মনোযোগী করে তুলতে কেরালার সরকারি স্কুলে 'পুপি' নামের এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে চলা হিউমানয়েড রোবট শিক্ষককে নিযুক্ত করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। খুদে পড়ুয়াদের সুরে সুরে গান গেয়ে রাইমস, ছড়া, কবিতা, গল্প শোনাচ্ছে ঐ রোবট শিক্ষক। ধৈর্য ধরে পড়ুয়াদের হরেক রকমের প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছে সে। পড়ুয়াদের মধ্যে এর মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ঐ 'পুপি' নামের এআই প্রযুক্তিতে চলা রোবট শিক্ষক। রোবট শিক্ষকের এত সফলতা থাকা সত্ত্বেও বলতে হবে, রোবট শিক্ষক ও মানবশিক্ষক উভয়েরই নিজস্ব সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় রোবট শিক্ষক ও মানবশিক্ষকের সমন্বিত প্রয়াসে হতে পারে একটি টেকসই ও কার্যকরী শিক্ষা উপযোগী পথ। প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে মানবিকতার চর্চার মাধ্যমে আমরা শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন করতে পারি। শিক্ষা শুধুই জ্ঞানগত বিষয় নয়, বরং এটি আবেগগত এবং সামাজিক দক্ষতা গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে যে অভূতপূর্ব সম্ভাবনার জগৎ উন্মোচিত হতে যাচ্ছে, তা বিশ্বকে আরো কার্যকর এবং সহজ করে তুলতে পারে এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় করে টেকসই ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করার কোনো বিকল্প নেই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়