প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩০
বই হোক একমাত্র সম্মাননা স্মারক
বিশ্ববিনোদনের প্রাণকেন্দ্র হলিউড আজ শক্তিশালী দাবানলের আগুনে পুড়ে কঙ্কালসারের মত দাঁড়িয়ে আছে। আমেরিকার ক্যার্লিফোর্নিয়ার লসএঞ্জেলসের চারদিকে শুধু আগুনে পোড়া মাটির দগদগে ক্ষত, গন্ধ আর ছাইভস্মের ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। অথচ কিছু দিন সেখানে ছিল কত না হৈ চৈ, প্রাণচাঞ্চল্যে সারাক্ষণ গমগম করত আমেরিকার এই ২য় বৃহত্তম শহরটি। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিগুলো দেখে পৃথিবীবাসী থমকে গেছে, কেউ কেউ মন্তব্যে লিখছেÑতামাম দুনিয়ার কোন শক্তি যদি সুপার পাওয়ার আমেরিকার এত বড় ক্ষতি করত আজ নিঃসন্দেহে এতক্ষণ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেত। কিন্তু হায়! এই মহাশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা যে, তাদের হাতের নাগালের বাইরে। তাই বাধ্য হয়ে মুখ বুঁজে, মাথা নিচু করে সব সহ্য করছে। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে পুড়ে তাদের সকল অহঙ্কার তছনছ করে দিয়েছে। অথচ দমকল বাহিনীর কর্মীরা পাশের মহাসাগর থেকে পানি না নিয়ে অন্যত্র বা দূর অঞ্চল থেকে পানি বহন করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু কেন? এর কারণ হলো, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি দ্রুত মাটির সাথে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দিবে। তখন বহু বছর ধরে সেখানে কোন ফসল চাষ করা যাবে না। খাদ্যের অভাব দেখা দিলে হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। আবার সমুদ্রের পানি দমকলের বিভিন্ন যন্ত্রকেও অকেজো করে দিতে পারে। লোহার যন্ত্রে লবণ যে পরিমাণ মরচে ধরে ফলে সেগুলো আর ব্যবহার করা যাবে না। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে তারা আগুন নিভানোর জন্য সমুদ্রের পানি ব্যবহার না করে নিজেদের পরিবেশ রক্ষা করেছে।
দৈত্যের মত বিশাল বড় দেশ আমেরিকার ভূখণ্ড অনেক বড়, আর আমাদের ভূখণ্ড তাদের তুলনায় অনেক ছোট্ট। আমরা প্রতিনিয়ত জেনে-শুনে, বুঝে-না বুঝে সর্বনাশা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে আমাদের সকল স্তরের পরিবেশের অপূরণীয় মহাক্ষতি করছি। অবৈধ প্লাস্টিক, পলিথন-এর অপব্যবহারে শহরের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ সবকিছুই অচল করে দিচ্ছে। বর্তমান সরকারে অবৈধ প্লাস্টিক পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করার সৎ সিদ্ধান্ত নিতে না নিতেই হাজার হাজার মানুষ বেকারত্বের শ্লোগান তুলছে। দেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে পরিবেশের বিপর্যয় জনতা অব্যাহত রেখেছে। শত শত নদ-নদীগুলো আজ মুমূর্ষু। নেই নদ-নদীগুলোর স্রোত, ঢেউ আগেই হারিয়ে গেছে। এরপর মরার উপর খরার খা হয়ে দেখা দিয়েছে দখল আর দখল। ভূমি খাদকরা নদীর উপর হামলে পড়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলন, বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কর্তন যেন নিত্যকার সঙ্গী।
অপরিকল্পিত নগরায়ন দিনের পর দিন বাড়ছেই। গ্রামের মানুষ একটুখানি সুখশান্তির আশায় আজ শহর-নগরমুখী হচ্ছে। আপত্তি নেই শহর-নগরমুখী হওয়ার। মানুষ বসবাসের পরিবর্তন চাইবে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে অবৈধ পরিবর্তন চাইবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। কিছু কিছু পরিবর্তন মনেপ্রাণে মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। যেমন আশি ও নব্বই দশকে বই ছিল আমাদের বিনোদনের ভাণ্ডার। আজকের মত এত বেশি টিভি, টেলিফোন, খবরের কাগজ তথ্যপ্রযুক্তির সেবা সেসময় ছিল না। ছিল বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠীদের মধ্যে বইয়ের অবাধ বিনিময়। ঠাকুরমার ঝুলি, বীরবলের গল্প, ঈশপের রূপকথা রাক্ষসপুরী অজানা কাহিনি আর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্পভরা বইগুলো এখনও হৃদয়ে দোলা দেয়। আমরা ম্যাকাইভারের মেধা দেখে মুগ্ধ হতাম, হারকিউলিসের শক্তি, সিন্দবাদের অভিযানে শিহরিত হতাম, আলাদীনের গালিচার কার্পেটে ঘুরতাম, টম এন্ড জেরি দেখে কুটি কুটি করে হাসতাম। কল্লকথা, রূপকথা আর উপকথার রঙিন শব্দগুচ্ছের বই প্রকাশ পেলেই আমরা যে যেভাবে পারি কিনতাম অথবা জোগাড় করে পড়তাম। সরকারি, বেসরকারি পাঠাগারে গিয়ে চুপচাপ বই পড়ে তা তাদের বড় খাতায় এন্ট্রি করে দিয়ে চলে আসতাম।
এক একটি বই, এক একজন জ্ঞানী-গুণী মানুষের নীরব ভাষা। জ্ঞানী-গুণী মানুষের চিন্তার ফসল। বই পাঠকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রকৃত পাঠকেরা বই পাঠে সুখ উপভোগ করে। মানুষ স্বভাবতই সুখ প্রত্যাশী। ভবিষ্যৎ সুখী জীবনযাপনের জন্য মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বা জীবন গড়ার সময় হলো ছাত্রজীবন। সুখের সাথে শরীর ও মনের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই শরীর ও মনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শরীরচর্চা, খেলাধুলা, শারীরিক পরিশ্রম। সুশিক্ষার অংশ হিসেবে খেলাধুলা বা ব্যায়ামের বিকল্প নেই। এখন সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা চলছে, চলুক অসুবিধা নেই। কিন্তু আমরা ইদানীং দেখতে পাচ্ছি খেলাধুলায় বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে থালা, বাটি, মগ, গ্লাস, প্লেট ইত্যাদি। ভালো ফলাফলে, বিজয়ে, সাফল্যে বা অভিবাদনে দেওয়া হচ্ছে ক্রেস্ট। মেটাল ক্রেস্ট, ক্রেস্টাল ক্রেস্ট বা প্লাস্টিকের ক্রেস্ট, সম্মাননা স্মারক, মেডেল ইত্যাদি। যা শো-কেশের সৌন্দর্য বাড়াবে। কিন্তু আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ক্রেস্ট কি বইয়ের বিকল্প হতে পারে? কালের পরিবর্তনে কি আমাদের মন মানসিকতার সাথে রুচিরও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখাদেখি বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, ক্লাব, ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রেস্ট প্রদান করছে। আমি উপহার হিসেবে ক্রেস্ট প্রদানের বিপক্ষে নই। তবে কোমলমতী শিক্ষার্থীদের উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য, আত্মবিশ্বাসী ও জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বইয়ের বিকল্প ক্রেস্ট প্রদান সমর্থন করি না। যদি ক্রেস্ট প্রদান করতেই হয় তবে কমপক্ষে পুরস্কারের একটি বইয়ের সাথে সাথে একটি ক্রেস্ট দিতে পারেন।
যে কোন অনুষ্ঠানে হোস্ট বা গেস্টদের একটি কথা বিনয়ের সাথে বলতে চাই, ক্রেস্ট যদি হয় মানব শরীরের অলঙ্কার তবে বই হবে শরীরের অর্গান। অলঙ্কার সৌন্দর্য বাড়ায় আর অর্গান না থাকলে আপনি প্রতিবন্ধী। অর্গান এবং অলঙ্কার কোনটা শ্রেষ্ঠ, সে বিচার আপনার? সুপার পাওয়ার আমেরিকা তাদের পরিবেশ রক্ষায় বদ্ধপরিকর আর আমরা সর্বত্র পরিবেশ ভাংগার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শিক্ষানুরাগী বা বিদ্যোৎসাহী মহানুভব মানুষদের শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার বই বাধ্যতামূলকভাবে প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি বা আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা দেখতে চাই। বই হোক একমাত্র সম্মাননা স্মারক এবং স্টুডেন্টদের অ্যাওয়ার্ড, অন্য কিছুই নহে।