প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৩
আমার স্কুলের প্রথম দিন
‘কেমন ছিল আপনার স্কুলে প্রথম দিন?’
এ কথার জবাবে বেশির ভাগ মানুষই বলবেন, ‘ওহ, দারুণ! প্রথম দিনেই কত বন্ধু হলো।’
আমার অভিজ্ঞতা আবার অন্য রকম। সে কথায় পরে আসছি।এখন অবশ্য বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তির সময়টাই পাল্টে গেছে। অনেকের কাছে শুনেছি, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সবার সঙ্গে প্ল্যান শুরু হয়ে যায়, প্রথম মন্টেসরি, সেখানে ট্রেনিং দিয়ে তারপর একখানা জম্পেশ স্কুলে ভর্তি করাটাই বাবা-মায়ের জীবনের অন্যতম মোক্ষ!
পথেঘাটে দেখি, দুধের বাচ্চা, কচি কচি মুখ, বড়জোর আড়াই-তিন বছর বয়স, ঢাউস ব্যাগ, ওয়াটার বটল নিয়ে গুড়গুড় করতে-করতে বাবা-মার হাত ধরে চলেছে প্রথম স্কুলে! এখন তো আড়াই-তিন বছর বয়স থেকেই স্কুলে ভর্তি হতে হয়। ফলে বাচ্চাদের সড়গড় হতে বেশি সময় লাগে না।
আমাদের সময় কিন্তু অত ছোট থেকে স্কুলে পুরে দেওয়ার চল ছিল না। ছেলেমেয়েরা ক্লাস ওয়ান কি টু থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করত।
ব্যতিক্রম ছিলেন আমার বাবা। জীবনে কোনো দিন স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি। বলা ভালো, দাদু তাকে মাড়াতে দেননি। প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল। তারপর বাবার গ্র্যাজুয়েশন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, এমএ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাবার আদরের ‘ছোট পুত্তুর’ হিসেবে আমারও স্কুলে যাওয়ার একটুও তাগিদ ছিল না। বাবা-মা-ঠাকুমার, দিদির গায়ে লেপ্টে থেকে দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে বলে যৌথ পরিবারের কাকা-দাদাদের লাগামছাড়া আদর। বাড়িতেই পড়ার বই, গল্পের বই, পাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা।
কিন্তু চারদিকে চাপ ক্রমে প্রবল হয়ে উঠল। যা হয়, আত্মীয়স্বজন বাবাকে চেপে ধরলেন, ‘কী হলো? প্রায় সাত বছর বয়স হতে চলল, ওকে স্কুলে ভর্তি করবেন না?’
সে চাপ আমার আপাত-রাশভারী বাবার পক্ষেও নেওয়া অসম্ভব। বাবা এক ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমায় ডেকে বললেন, ‘বাবাঠাকুর! তোমায় সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। ৫ জানুয়ারি স্কুল খুলছে। ক্লাস টু-তে তুমি পড়বে।’
শরীর কেঁপে উঠল। বাবা বলছেন কী! আমায় বাড়ি ছেড়ে একা-একা থাকতে হবে। বললাম, ‘কতক্ষণ স্কুল বাবা?’ ‘ওই চার-পাঁচ ঘণ্টা। মাঝে আধা ঘণ্টা টিফিন ব্রেক।... না-না। এ কী! তুমি কাঁদছ কেন? বাড়ির কাছেই। মন খারাপ করলে চলে আসবে।... ওই কলেজ স্ট্রিটেই আমাদের অফিস। খবর পেলে ঠিক নিয়ে আসব। তারপর দেখবে, কত বন্ধু হবে, খেলাধুলা হবে, গল্পগুজব হবে। তখন তুমি বাড়িতে ফিরতেই চাইবে না। দেখে নিও।’
বাবা গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। ৭ বছরের আদুরে বালক-পুত্র ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। তার মধ্যেই সে ঘাড় গোঁজ করে ফাইনাল জানিয়ে দিল, ‘দিদিমণিকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। তবেই আমি যাব।’
‘বেশ, বেশ। ডলিকে আমি বলে দিচ্ছি।’ দিদিমণি ছিলেন আমার একমাত্র দিদি। বাড়ির একমাত্র মেয়ে, আমাদের সব খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইদের মধ্যে সবার বড়। আমার সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান মাত্র ১৮ বছরের।
দিদিমণির অসম্ভব ন্যাওটা আমি। আমার যা কিছু আবদার সব দিদিমণির কাছে। এমনকি স্নান করানো, খাওয়ানো, পড়ানো, ঘুম পাড়ানো, গল্প বলাÑদিদিমণিকে পেলে আমি শান্ত, বাধ্য ছেলে। দিদি তখন এমএ ফাইনাল দেবেন।
অবশেষে এল সেই ভয়ানক দিন। দিদিমণির হাত ধরে আমি স্কুলে হাজির। আমার স্পষ্ট কথা, যতক্ষণ আমি স্কুলে থাকব, দিদিমণি আমার কাছে থাকবেন। ক্লাসরুমের বাইরে তাকে থাকতে হবে, যাতে আমি তাকে দেখতে পাই।
ক্লাস শুরু হলো। স্যার আলাপ-পরিচয় করছেন, হেসে হেসে কথা বলছেন। আমি প্রায় কিছুই শুনছি না। ক্ষণে ক্ষণে দেখছি, দিদিমণি বাইরে আছেন তো? স্যারের নজরে পড়েছে, দু-একবার ধমকও দিলেন। গায়ে মাখলাম না। শেষে হেড স্যারকে বলে দিদিমণি দুটো ক্লাস পরে আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
দ্বিতীয় দিন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কোনো বন্ধু-টন্ধুর বালাই নেই, কারও সঙ্গে কথাই বলিনি, আলাপ-পরিচয় তো দূরের কথা। দেখলাম, স্কুলের দারোয়ান দয়াপরবশ হয়ে একটা চেয়ার দিয়ে গেল। ঠায় বসে আছেন দিদিমণি। প্রতি ক্লাসের ঘণ্টা পড়তেই এক ছুট্টে দিদিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরছি।
কানে আসছে শিক্ষকদের মন্তব্য, ‘কী বেয়াড়া ছেলেরে বাবা!... ওর দিদিটার কী কষ্ট!... বেচারিকে কিছুতেই ছাড়ছে না।’
তৃতীয় দিন। স্যারদের সঙ্গে বোধহয় দিদির আগেই কথা হয়ে গেছিল। কতদিনই বা তারা বেয়াড়াপনা সহ্য করবেন! পুঁচকে স্কুলের ডিসিপ্লিনের দফারফা করে ছাড়ছে।
ক্লাসে কিশলয় পড়ানো হচ্ছিল। গল্প করে করেই বলছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার খগেনবাবু। খগেন্দ্রনাথ সরকার। মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
হঠাৎ! হঠাৎ কী মনে হলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এ কী! চেয়ার ফাঁকা কেন?
ব্যস্! বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে ‘দিদিমণি! দিদিমণি!’ চিৎকার করতে করতে বই-খাতার ব্যাগ তুলে একলাফে বেঞ্চি থেকে নেমেছি। ছুটতে শুরু করেছি পাগলের মতো।
সবাই হতভম্ব। বিমূঢ়! তার মধ্যেই ডায়াস থেকে নেমে খগেনবাবু ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও’ বলতে বলতে আমায় তাড়া করলেন। বড় বড় পায়ে জাপটে ধরেও ফেললেন।
‘ওরে অ্যাই, শোন্। তোর দিদি কোথাও যায়নি। আসছে! যাস্ না, দ্যাখ্... গল্প বলছি তো... আরও বলব... আঁঃ-আঁঃ উঁঃ উঃ!’
হাত চেপে ধরে বসে পড়েছেন খগেনবাবু স্যার। ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিয়েছি যে! সে কী কেলেঙ্কারি! স্কুলজুড়ে তোলপাড়।
দিদিমণি নিচেই দাঁড়িয়েছিলেন। বালক-ভাই তার কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘আমি বাড়ি যাব।’
না, পাঠকদের নিশ্চিন্ত করি, প্রথম স্কুল ছাড়তে হয়নি আমায়। দাদা-দিদি শলাপরামর্শ করল।পরদিন থেকে দিদিমণির বদলে বড়দা দিলীপ বাবার অনুমতি নিয়ে আমায় স্কুলে পৌঁছতে গেলেন। আসলে আদ্যন্ত রসিক মানুষ হলেও বড়দা এমন এক গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকতেন, ছোটবেলায় তাকে ভয় পেতাম খুব।
নতুন ব্যবস্থা হলো। বড়দা আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ইউনিভার্সিটি চলে যেতেন। তখন তিনি এমএ প্রথম বছরে। ফেরার সময় তার সঙ্গেই আমায় আসতে হতো।
বড়দা-ভীতিতে আমার স্কুল-ভীতি তো কাটলই, উল্টো কিছুদিনের মধ্যে যত রাজ্যের দুষ্টু ছেলেদের পান্ডা হয়ে উঠলাম।
এরপর ক্লাস ফাইভ থেকে হিন্দু স্কুল। টানা হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত। সেখানেও এমন কত যে দুষ্টুমির গল্প, মনে পড়ে যায়... শিক্ষকদের অদ্ভুত নাম দেওয়া, তাদের বিব্রত করা... এখন ভাবলে নিজেরই লজ্জা লাগে।
দেখেশুনে তাই এখন মনে হয়, ছোট বয়স থেকে স্কুলে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো। তাতে কোনো স্যারকে আমার মতো বিদ্ঘুটে বাচ্চার কামড় খেতে হয় না!