প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৫৩
চাঁদপুর শহরে আবারো হত্যাকাণ্ড
দধি ব্যবসায়ী নারায়ণ ঘোষকে জবাই করে হত্যা
সেলুন কর্মচারী রাজু একাই কী হত্যা করেছে?
চাঁদপুর শহরে নারায়ণ ঘোষ (৬০) নামে এক দধি ব্যবসায়ীকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটে বুধবার দিবাগত রাতের কোনো এক সময়। ঘটনাটি ঘটেছে চাঁদপুর শহরের বিপণীবাগ বাজার এলাকায়। আর এ খুনের ঘটনায় স্থানীয় এক সেলুন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। নারায়ণ ঘোষকে গলা কেটে খুন করে ঐ সেলুনের পাশে বাজারের পাবলিক টয়লেটের পরিত্যক্ত স্থানে বস্তাবন্দি অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। পরদিন সকালে পাশের দোকানদার দোকান খুলতে এসে বস্তাবন্দি লাশ দেখার পর ঘটনাটি জানাজানি হয়।
|আরো খবর
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর শহরের নতুনবাজারস্থ ৮নং ওয়ার্ডের ঘোষপাড়ার ঘোষ বাড়ির বাসিন্দা নারায়ণ ঘোষ (৬০) বংশগতভাবে দধি ব্যবসা করে আসছেন। শহরে একজন দধি ব্যবসা হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। তিনি শহর ও শহরতলীতে বিভিন্ন দোকানে পাইকারি দধি সরবরাহ করতেন। নিরীহ এবং শান্ত প্রকৃতির লোক হিসেবেই তাকে সবাই চিনে। জানা গেছে, তিনি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দধি দিয়ে তাগাদা করে আসতে অনেক সময় সন্ধ্যার পর হয়ে যেতো। ফলে কিছু সময় বিপণীবাগ বাজারের পৌর সুপার মার্কেটের নিচে টিপটপ সেলুনে কিছু সময় কাটাতেন। এভাবে সেলুন মালিক কৃষ্ণা ও কর্মচারী রাজু শীলের সাথে নিহত নারায়ণ ঘোষের সখ্যতা গড়ে উঠে।
জানা গেছে, টিপটপ সেলুনে গত দু বছর পূর্বে কুমিল্লার রাজু নামে ওই কর্মচারী চাকুরি নিয়ে কাজ করতে থাকে। নারায়ণ ঘোষ সেলুনে আসা-যাওয়ার ফলে রাজুর সাথে চাচা-ভাতিজা হিসেবে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। জানা যায়, রাজু এই সম্পর্কের কারণে প্রায়ই অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়লে দধি ব্যবসায়ী নারায়ণ ঘোষ থেকে টাকা ধার নিতো। ফলে সম্পর্কের গভীরতা সেলুন মালিক কৃষ্ণার চেয়ে কর্মচারী রাজুর সাথে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। ফলে নারায়ণ ঘোষ শহরের আর কোথায়ও আড্ডা বা সময় কাটাতো না, বিপণীবাগ টিপটপ সেলুন ব্যতীত।
নিহতের দু ছেলে সুমন ও রাজু ঘোষ জানান, তাদের বাবা কখনই রাত সর্বোচ্চ ১০টার পর বাইরে থাকেননি। যতো সমস্যা হোক না কেনো তিনি ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরেন। কিন্তু ১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে ব্যবসার কাজে বাসা থেকে বের হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও নারায়ণ ঘোষ বাসায় না ফেরায় দু ছেলেই বাবার খোঁজে নানা স্থানে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথায়ও খুঁজে পাননি। এমনকি তার একমাত্র অবসর সময় কাটানো টিপটপ সেলুনে একাধিকবার খোঁজ নিয়েও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সেলুন মালিক কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি বলেন, চাচার সাথে আজ আমার দেখা হয়নি। এ অবস্থায় নারায়ণ ঘোষের ছোট ছেলে বাবাকে না পেয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় অভিযোগ করার জন্যে দুবার গিয়েও আত্মীয়স্বজনদের পরামর্শে ফিরে আসেন। সকলের একটাই কথা ছিলো রাত পর্যন্ত দেখি, সকালে না হয় আইনগত ব্যবস্থা নেবো। এমন কথায় তিনি আর আইনগত ব্যবস্থা বা থানায় জিডি করেননি বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।
এদিকে সেলুন মালিক কৃষ্ণা সবসময় রাত ১০ থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে বাসায় চলে যান বলে জানা গেছে। তাই অন্যান্য দিনের ন্যায় এদিনও একই সময়ে চলে যাওয়ায় তিনিও বিষয়টি জানেন না বলে জানান। কিন্তু দোকানের কর্মচারীরা কাস্টমার থাকলে দেরি বা অধিক দেরিতে দোকান বন্ধ করা হয়। অনেক সময় দোকানে কর্মচারীরা রাতে ঘুমানোর কারণে দোকান অধিক সময় বন্ধ করা হয় বলে জানান দোকান মালিক কৃষ্ণা। সেলুন কর্মচারী রাজুই হত্যাকারী নিশ্চিত হয় যেভাবে
নারায়ণ ঘোষের হত্যাকারী সেলুন কর্মচারী রাজুই, এটি অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় নাইটগার্ডের বর্ণনার দ্বারা। নাইটগার্ড ইসমাঈল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলেও সে সময় তিনি ঘটনা যে এমন তা কোনো ভাবেই আঁচ করতে পারেন নি। রাত যখন গভীরে যাচ্ছে, নারায়ণ ঘোষ বাসায় ফিরছে না, তখন তার স্বজনরা খোঁজে নানা স্থানে ব্যস্ত। কিন্তু খোঁজার স্থান হিসেবে চিহ্নিত টিপটপ সেলুনে গিয়ে তার ছেলেরা কয়েকবার কর্মচারী রাজুকে নারায়ণ ঘোষ সেলুনে আসছে কি না জিজ্ঞেস করেন। যতোবার জানতে চেয়েছেন ততোবারই তার উত্তর ছিলো একটাই, চাচা আসছিলো, সেভ করে আমার কাছ থেকে চলে গেছে। নিহতের ছেলেরা জানান, এই কথা বলার সময় হত্যাকারী রাজুর চোখমুখে ছিলো একটা আতঙ্কের ছাপ। এভাবেই হত্যাকারী গভীর রাত পর্যন্ত সময় কাটিয়ে রাত ১টার দিকে শুরু হয় লাশ গুম করার কাজ।
এদিকে বিপণীবাগ বাজারের পশ্চিমাংশের নাইটগার্ড মোঃ ইসমাইল জানান, রাত ১টা বা দেড়টার দিকে দেখতে পাই টিপটপ সেলুন কর্মচারী রাজু সেলুনের ফ্লোরসহ পুরো সেলুন একাই পরিষ্কার করছে। তাও পুরো সার্টার বন্ধ করে। তখন সেলুনের লাইট জ্বলছে এবং ফ্যান চলছে। এ অবস্থায় ভেতর থেকে শব্দ হওয়ায় আমি দোকানের সামনে গিয়ে কে বা কী করছে জিজ্ঞেস করলে রাজু সার্টার একটু ফাঁক করলে আমি দেখি সে পানি দিয়ে ফ্লোর পরিস্কার করেছে। তখন আমি জানতে চাই, একা একা কী সম্ভব পুরো দোকান পরিষ্কার করা। সে আমাকে বললো, কী করবো চাচা একাই করছি। কারণ পরশু দিন পূজা। সে খুব কাজ করছে এবং কয়েকবার পানি ঢেলে পরিষ্কার করছে এ অবস্থা দেখে আমি চলে যাই। তখন পর্যন্ত বুঝার কোনো উপায় খুঁজে পাইনি।
ইসমাঈল আরো বলেন, এরপর রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে দূর থেকে দেখি সে হাতে করে ব্যাগ বা বস্তার মতো খুব ওজনের একটা কিছু একাই সেলুন থেকে বের করে বিপণীবাগ পুরানো মার্কেটের পাবলিক টয়লেটের পরিত্যক্ত স্থানে ফেলে আসে। আমি তখন কিরে এটা বললে সে আমাকে বললো ময়লা-আবর্জনা, আর কী চাচা।
এরপর সেলুন কর্মচারী রাজুকে দেখলাম বেশ কিছুসময় ধরে দোকানের সামনেই ঘুরাফেরা করছে। ফজরের আজানের পর ফর্সা হওয়ার পর পরই তাকে শার্ট পরা অবস্থায় দেখলাম। এরপর আর দেখি নাই। এদিকে সকাল ৮টা সাড়ে ৮টার দিকে বিপণীবাগ পুরান মার্কেটের ব্যবসায়ী মেসার্স শরীফ স্টীল ওয়ার্কসের মালিক শরীফ দোকান খুলতে এসে দেখেন দোকানের পাশে পাবলিক টয়লেটের পথে প্লাস্টিকের বস্তায় খুব ভালো করে পেঁচানো কী যেনো পড়ে আছে। এক পর্যায়ে তিনিসহ বাজারের বেশ কজন বস্তাটি রাখার স্থানে রক্ত এবং বস্তা থেকে রক্ত বের হতে দেখে নিশ্চিত হন ভেতরে কোনো লাশ রয়েছে। তাৎক্ষণিক বিষয়টি চাঁদপুর সদর মডেল থানাকে জানালে প্রথমে থানার টহল বাহিনী পরে থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুর রশিদ, ওসি (তদন্ত) সুজন বড়ুয়া ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ এটি বস্তাবন্দি মানুষের লাশ নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ সুপার মোঃ মিলন মাহমুদ, বিপিএম (বার)সহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করলে তাৎক্ষণিক পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণ সেখানে হাজির হন।
এদিকে থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুর রশিদ ও ওসি (তদন্ত) সুজন বড়ুয়া ঘটনাস্থলে পৌঁছে সাথে সাথে বাজারের নাইটগার্ড ইসমাইলের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে হত্যাকারী মোটামুটি শনাক্ত করতে পেরে তাৎক্ষণিক আসামীর বর্ণনা দিয়ে তার বার্তা পাঠিয়ে দেয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি মডেল থানা পুলিশের বেশ কজন এসআই, এএসআইকে আসামী ধরতে বিভিন্ন কৌশলে কাজে নামিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ টিপটপ সেলুন মালিক কৃষ্ণাকে সাথে নিয়ে কর্মচারী রাজুর সন্ধানে নেমে যায়।
এদিকে পুলিশ সুপার মোঃ মিলন মাহমুদ, বিপিএম (বার)কে ঘটনার বিষয়ে অবহিত করা হলে ঘটনাস্থলে তিনিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল, পিবিআই, ডিবি পুলিশ, সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ঘটনাস্থলে চলে আসেন। পরে পুলিশের কয়েকটি টিম একত্র হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এবং নমুনা সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের বস্তা খুলে লাশের টুকরো টুকরোকে একত্র করে সুরতহাল রিপোর্ট নিয়ে লাশ মডেল থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে যায়।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) সুদীপ্ত রায় চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেছি। প্রত্যক্ষদর্শী নাইটগার্ড এবং পরিবারের বক্তব্য নিয়েছি। বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে অভিযুক্তকে আটক করা হবে। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার সাথে অন্য কোনো বিষয় জড়িত আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি বলে জানান তিনি। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আসিফ মহিউদ্দিন, চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রশিদসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত নারায়ণ ঘোষ বিপণীবাগ বাজারের অনেক ব্যবসায়ীর কাছে টাকা বিনিয়োগ করেছেন, হয়তো টাকার লেনদেন নিয়ে এই ঘটনা ঘটতে পারে।
ঘটনার পর থেকে কৃষ্ণা কর্মকারের সেলুনের কর্মচারীরা রাজু শীল পলাতক রয়েছে। এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রশীদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নিহত নারায়ণ ঘোষের হত্যা মামলা প্রক্রিয়াধীন।
মুহূর্তে শত শত উৎসুক জনতা
বিপণীবাগ বাজারে বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া গেছে এমন খবরে মুহূর্তে শত শত উৎসুক জনতা উক্ত স্থানে ভিড় করে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
ঘটনাস্থলে স্বজনরা বিপণীবাগ বাজারের পাবলিক টয়লেটের পাশে বস্তায় মানুষের লাশ পাওয়া গেছে এ খবর যখন নিহত দধি ব্যবসায়ী নারায়ণ ঘোষের পরিবার ও স্বজনরা শুনতে পায়, তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে তারা ছুটে আসেন। প্রথমে নিহত নারায়ণ ঘোষের বড় ছেলে সুমন ঘোষ ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গত রাত থেকে তার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক খোঁজাখুঁজি করার বিষয়টি অবহিত করলে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাগণ তাকে বলেন, আমরা এখনো বস্তা খুলে দেখিনি। তাছাড়া আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে আপনাকে সর্বাগ্রে লাশ দেখাবো। আপনি এখানে থাকেন।
মুহূর্তেই নিহতের ছোট ছেলে ও আরো স্বজনরা ঘটনাস্থলে চলে আসেন। এর মধ্যেই নিহতের স্বজনদের কানে পৌঁছে যায় টিপটপ সেলুন কর্মচারী রাজু লাশভর্তি প্লাস্টিকের এ বস্তা এখানে রেখেছে। ইতিমধ্যে পুলিশ প্লাস্টিক বস্তা থেকে লাশ বের করার সাথে সাথেই নিহতের দু ছেলে লাশের শরীরে থাকা কাপড় দূর থেকে দেখে লাশটি আর কারো নয়, তাদের পিতার লাশ বলে শনাক্ত করেন।
এ সময় নিহতের দু ছেলে ও উপস্থিত স্বজনদের চিৎকারে পুরো এলাকা যেনো এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহত নারায়ণ ঘোষের লাশ চাঁদপুর সদর মডেল থানার হেফাজতে রয়েছে।