প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২১, ১৭:১১
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়
ফরিদগঞ্জে শিশুশ্রম বৃদ্ধি ও মোবাইলে আসক্ত হয়ে উঠছে শিশুরা
ফরিদগঞ্জে করোনাকালে কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মোবাইলে আসক্ত ও শিশুশ্রম বাড়ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। করোনায় নিম্ন আয়ের মানুষের সংসারে টানাপোড়োন শুরু হয়েছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া পরিবারগুলো তাদের স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের বাড়তি আয়ের আশায় শিশুশ্রমে নিয়োজিত করছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ছেলে মেয়েরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে উঠছে।
|আরো খবর
ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রা বাজার, ফরিদগঞ্জ বাজার, রূপসা বাজার, কালির বাজার, গোবিন্দপুর বাজার, গল্লাক বাজার সহ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে চোখের সামনে বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে ও আনাছে-কানাছে এমনই চিত্রই দেখা গেছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর বলছে, সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী উপজেলায় বিভিন্ন ভাবে ১শত ১২ জন শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিলো। তবে করোনাকালীন ভাসমান বিভিন্ন বসতি এবং নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে শিশুশ্রম বাড়ায় এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন ফরিদগঞ্জ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাকছুদা আক্তার। মাকছুদা আক্তার বলেন, উপজেলায় শিশু শ্রমিকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছিল ২০১৭ সালে। দীর্ঘদিন আর কোনো ধরনের সভা সেমিনার নেই। তবে সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে আমরা অনেক শিশুকে ও তাদের পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার চেষ্টা করেছিলাম। এছাড়া শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের পুনর্বাসনের জন্য উপজেলায় কোনো প্রকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি, কেন্দ্রীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি বদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: বিল্লাল হোসেন পাটোয়ারী বলেন, করোনাকালীন এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের কারণে শিশুদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক শিশুই বিভিন্ন কর্মে জড়িত হয়ে গেছে। এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের অনেক ছেলেমেয়ে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে দিন দিন বিপথগামী হয়ে উঠছে। তিনি বলেন যেহেতু আমরা শিক্ষকরা ভ্যাকসিন (টিকা) নিয়েছি, তাই আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নাই। শিশুদের তো এমনিতেই করোনা হচ্ছে না। তাই নিয়ম-নীতি মেনে এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে ঝরে পড়া শিশুদের আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এবং মোবাইলে আসক্ত হওয়া বিপথগামী ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
লতিফগঞ্জ ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) মোঃ মহিউদ্দিন বলেন করোনাকালে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে বেড়ে ওঠা শিশুদের একটি অংশ বিভিন্ন হোটেল ও ছোট কারখানাগুলোতে কাজ নিচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে শিশু অপরাধ বাড়ার আশংকা রয়েছে, মাদকের বাহকও বাড়তে পারে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের পক্ষে তিনি মতামত দিয়ে বলেন, অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস জোরদার করতে হবে। এবং শিক্ষকদের মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে শিশুদের প্রতি অধিকতর খবরদারি করে শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করাতে হবে।
চান্দ্রা ইমাম আলী উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ শাহ্ মোঃ মকবুল আহমদ এর সাথে কথা হলে তিনি শিশুশ্রম ও মোবাইলের প্রতি আসক্ত হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়ে বলেন, করোনাকালীন এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিশু শ্রম বেড়েছে এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা মোবাইল কিনে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে বিপথগামী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে শিশুশ্রমে নিম্নআয়ের পরিবারের মধ্যে এই প্রথাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিত্তবানরা সাহায্যের হাত বাড়ালে এমনটা হতো না। তিনি বলেন এই সময়ে ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া ঠিক না। তবে দৈনিক একটি বা দুটি শ্রেণীর ক্লাস নিলে আমরা শিক্ষকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘন্টা নেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। এতে করে পুণ্য শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় থাকতো, অন্যদিকে তাদের দৃষ্টি থাকত না বলে তিনি মতামত দেন।
ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা, রুপসা, গাজীপুর, পাটোয়ারী বাজার সহ আরো কয়েকটি বাজারে দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অসংখ্য শিশুরা অটো বাইক চালাচ্ছে। এবং অনেক শিশু বেকারি, গ্রিল ওয়াকসপ, ঔষুধের দোকান সহ বিভিন্ন কর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে অটোচালক রবিউল পঞ্চম শ্রেণি, রাব্বি ষষ্ঠ শ্রেণি, শাকিব চতুর্থ শ্রেণি, নিশাত কাজী পঞ্চম শ্রেণি, ঔষধের দোকানের সোহাগ পঞ্চম শ্রেণি, শাহনেওয়াজ সপ্তম শ্রেণী সহ বেকারি এবং গ্রিল ওয়ার্কশপ এ কর্মরত কয়েক শিশুর সাথে কথা হলে তারা বলেন, স্কুল বন্ধ, তাই তারা এ কাজে যোগদান করেছেন। তাদের দাবি সংসারে যদি টানাপোড়ন না থাকতো তাহলে তারা এ কাজ করত না। স্কুল খুলে দিলে আবার তারা স্কুলে চলে যাবে বলে তারা জানান।
অন্যদিকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত স্কুল পড়ুয়া ছাত্রদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, স্কুল বন্ধ। সময় কাটে না, তাই মোবাইল নিয়ে গেম খেলছি। এসব নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অনেকের সাথে কথা হলে তারা বলেন, করোনাকালীন এই সময়ে স্কুলগুলো বন্ধ রাখার কারণে আমরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিপাকে আছি। প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের টেনসনে যায়। ছেলেমেয়েদের কতক্ষণ আমরা ডাক দিয়ে রাখবো। আর মহামারী করোনা দিয়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে সেটাও আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়। তারপরেও সরকারের কাছে তাদের আবেদন নিয়ম-নীতি মেনে স্কুলগুলো খুলে দিলে হয়তো অনেক ভালো হতো বলে তারা জানান
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তি-সংক্রান্ত বিশেষ বিধান রয়েছে। শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারে, কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স হচ্ছে ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে হালকা কাজ করলে সেটাকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না।