প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২২, ০০:০০
সারা পৃথিবী জুড়ে প্রবীণরা কমণ্ডবেশি নির্যাতনের শিকার হন। ভয়াবহ কোভিড-১৯ আক্রমণ করলে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ মানুষের মৃত্যু হয় যথাযথ চিকিৎসা ও সেবা-যত্নের অভাবে। প্রবীণ নিবাসে একই সেবাকর্মী একাধিক প্রবীণের সেবা-যত্ন করে দ্রুত রোগ ছড়িয়ে মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে। মৃত্যুর পরও সম্মানজনকভাবে বিদায় জানানো যায়নি। বিদায় দিতে হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রোটোকল অনুসারে।
১৫ জুন বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গণমাধ্যমে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরা হয়।
বিভিন্ন সংগঠন সভা, সমাবেশ, সেমিনার, শোভাযাত্রা, মানববন্ধনসহ নানা রকমের কর্মসূচি পালন করে। নির্যাতন মানে সবল শক্তিমান কর্তৃক দুর্বল অক্ষম ব্যক্তিকে দুঃখ কষ্ট দেয়া। এসব দুঃখণ্ডকষ্ট অর্জিত কিংবা আরোপিত হতে পারে। প্রবীণরা সাধারণত শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক, আবেগিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
শারীরিক নির্যাতন হলো কিল ঘুষি, চড়-থাপ্পড়, ধাক্কা-লাথি, চুল টানা, গলা টিপে ধরা, ধারালো কিংবা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে জখম করা, সময় মতো খাবার খেতে না দেয়া, চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা না করা। মানসিক নির্যাতন হলো কথা বন্ধ করে দেয়া, গালাগালি করা, অক্ষমতা নিয়ে কটাক্ষ করা, কুৎসা রটানো, আলো বাতাস হীন ঘরে রাখা, বাড়ি থেকে বের করে দেয়া, বাথরুমে আটকে রাখা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করা, পছন্দের কাজ করতে বাধা দেয়া। আর্থিক নির্যাতন হলো টাকা পয়সা, জমি-জমা, বাড়ি-গাড়ি, সহায় সম্পদ কৌশলে কিংবা চাপ সৃষ্টি করে বেহাত করা, ব্যাংক একাউন্ট, সঞ্চয়পত্র, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাওয়া, সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য করা।
আবেগিক নির্যাতন হলো বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভালোলাগার বিষয়কে গুরুত্ব না দেয়া কিংবা উপহাস করা। পছন্দের কারো সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা কিংবা বাঁধা দেয়া। বেড়াতে যেতে, আড্ডা দিতে, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে নিরৎসাহিত করা। সামাজিক নির্যাতন হলো সামাজিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত না করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় না রাখা, কুৎসা রটানো, বুলিং করা, অপবাদ দেয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজি করা। যৌন নির্যাতন হলো সম্মতি ব্যতিরেকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, অশ্লীল কথা কিংবা ছবি দেখানো, গায়ে হাত দেয়া, আদি রসাত্মক গল্প-কবিতাণ্ডছড়া বলা, হাসি ঠাট্টা তামাশা করে যৌন ইঙ্গিত করা। গোসল অথবা ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সময় অপ্রয়োজনে গা উদোম করে রাখা।
নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনা জনসমক্ষে আসে না। মান-সম্মানের ভয়ে নির্যাতনের খবর গোপন রাখা হয়। মাঝে মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশ হয়ে পড়ে।
প্রবীণদের ওপর নির্যাতন যেন আমাদের গা সয়ে গেছে। অস্তগামী সূর্যের বিদায় যেমন নতুন সকালের স্বপ্ন দেখায়, তেমনি আমাদের প্রবীণদের বিদায় ঝামেলা মুক্ত দিনের আশা জাগায়। অনেকেই এ কথা মুখে অস্বীকার করলেও অন্তরে লালন করে। মুখে মুখে আমরা কেউ কেউ বাবা-মায়ের জন্য আকুল রোদন করে সামাজিক সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করি। মা দিবস, বাবা দিবস, পরিবার দিবস পালনের মধ্য দিয়ে প্রবীণ পিতামাতার প্রতি যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিবেদন করি অবশ্যই তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা মূলক।
প্রবীণদের প্রতি নির্যাতন অবহেলা অসম্মান প্রদর্শন দিবস পালনকে ম্লান করে দেয়।
প্রবীণরা মূলত পরিবারের সদস্যদের হাতে বেশি নির্যাতিত হয়ে থাকে। সিনিয়রদের সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের কৃপণতা দৃশ্যমান।
আমরা সম্মান করি ক্ষমতাবানদের। তাদের ছায়ায়, মায়ায়, দয়ায় থাকা আমাদের অভ্যাস। প্রবীণরা সেবা-যত্ন আশা করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে চান। সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে চান। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য আশা করেন। সরকারি-বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সম্মান, মর্যাদা, মনযোগ চান। খাবার দাবার, চলাচল, যানবাহনে, অফিস আদালতে, পরিবারে, রাস্তা পারাপারে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মনোযোগ ও সহযোগিতা কামনা করেন। প্রবীণদের এই চাহিদা পূরণ করা আমাদের দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের বর্তমান তৈরিতে এই প্রবীণদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো।
আমাদের প্রবীণদেরকে সন্তাননির্ভর প্রবীণ জীবনের ভাবনাকে সমাজনির্ভর প্রবীণ জীবনের ভাবনায় উন্নীত করতে হবে।
প্রবীণদের প্রতি সম্মান ও মনোযোগ প্রদর্শন করে একটি প্রবীণ বান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে হবে, কারণ আগামী দিনের প্রবীণরা সেখানে বসবাস করবেন।
মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা কারো দয়া কিংবা করুণার পাত্র নন। তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি প্রবীণবান্ধব সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।