প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
বাঙালির বাতিঘর রবীন্দ্রনাথ। তিনি পূর্ববঙ্গের বহুস্থানে এসেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, সংবর্ধনা গ্রহণ করেছেন। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া অনেকের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এঁদের মধ্যে কেউ যেমন তাঁর নির্ভরযোগ্য সহকর্মী ছিলেন, তেমনি কেউ ছিলেন সরাসরি শিক্ষার্থী ও স্নেহভাজন। পূর্ববঙ্গের অনেকের মতো রবীন্দ্র-সান্নিধ্য পেয়েছেন কালীমোহন ঘোষ, শান্তিদেব ঘোষ, চিত্রনিভা চৌধুরী, সাগরময় ঘোষ ও যাযাবর। কালীমোহন ঘোষ ছিলেন কবির একনিষ্ঠ সহকর্মী ও শ্রীনিকেতনের অন্যতম রূপকার। শান্তিদেব ঘোষ, চিত্রনিভা চৌধুরী ও সাগরময় ঘোষ সরাসির কবির কাছ থেকে পাঠ নিয়েছেন। শান্তিদেব, চিত্রনিভা নাম দুটিও কবির রাখা। দৃষ্টিপাত-এর লেখক যাযাবরের জীবনে রবীন্দ্র প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি কবির একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই পাঁচ ব্যক্তির সম্পর্ক ও সান্নিধ্যই আজকের প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে কবির যে কেবল অনুরাগের সম্পর্ক ছিল তা নয়, অনুরাগের সাথে কখনো কখনো রাগ-অভিমানের সম্পর্কও ছিলো। তবে সে-সম্পর্ক ছিল সাময়িক, স্থায়ী হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ও কালীমোহন
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এরমধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও সংগঠক কালীমোহন ঘোষ অন্যতম। তাঁর জন্ম ১৮৮৪ সালে চাঁদপুরের বাজাপ্তি গ্রামে। বাবা দীননাথ ঘোষ, মা শ্যামাসুন্দরী। অল্পবয়সে কালীমোহন তাঁর পিতাকে হারান। ফলে তাঁর শৈশব কাটে আর্থিক টানাপড়েনে। মা শ্যামাসুন্দরী ফসল, ফলমূল, পুকুরের মাছ বিক্রিসহ নানাভাবে সংসার চালাতেন। অভাব-অনটনের মধ্যেও কালীমোহনের পড়াশোনা বন্ধ হয়নি। তিনি ঢাকার তৎকালীন ইমপেরিয়াল সেমিনার স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯০২ সালে এনট্রান্স পরীক্ষার পর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯০৫ সালে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন কালীমোহন। ১৯০৬ সালের দিকে উচ্চশিক্ষার জন্যে ভর্তি হন কোচবিহারের রাজ কলেজে। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে কালীমোহন পড়াশোনা ছাড়েন। ওইসময় এ আন্দোলনের প্রচারণার অংশ হিসেবে তিনি গ্রামগঞ্জে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। তৎকালে অনেকের ধারণা ছিল কালীমোহন ঘোষ সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। সেকারণে তাঁর ওপর পুলিশের সজাগ দৃষ্টি ছিল। পরে পুলিশ রিপোর্টে স্পষ্ট হয় : কালীমোহন সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত নন।১
কালীমোহন ঘোষের জীবনের আদ্যপ্রান্ত জুড়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৪ সালে কবির স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটি পড়ে তিনি রবীন্দ্র-অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ক্ষিতিমোহন সেনের সান্নিধ্য তাঁর রবীন্দ্রকাব্যের চিন্তাকে আরও সমৃদ্ধ করে। স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে কালীমোহনের কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। সেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে তিনি রবীন্দ্র-সান্নিধ্য লাভের জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান এবং বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন ও এর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে কবিকে প্রশ্ন করেন। প্রথম সাক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথ কালীমোহনের স্বদেশ চিন্তা ও আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। তিনি তাঁর পল্লীউন্নয়ন কর্মসূচির জন্যে উপযুক্ত সহযোগী খুঁজছিলেন। কালীমোহন ঘোষ কবির সেই অভাব পূরণ করলেন। কবি তাঁকে পল্লীউন্নয়ন কাজে শিলাইদহে নিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণে বলেছেন :
আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিপল্লীতে, তার চর্চা আজ থেকেই শুরু করা চাই, তখন কিছুক্ষণের জন্যে কলম কানে গুঁজে এ কথা আমাকে বলতে হল আচ্ছা, আমিই এ কাজে লাগব; এই সঙ্কল্পে সহায়তা করবার জন্যে সেদিন একটিমাত্র লোক পেয়েছিলুম, সে হচ্ছে কালীমোহন।২
১৯০৭ সালে কালীমোহন সর্বপ্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ও কর্মকা- দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে শিশুবিভাগে শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। পরে কবির উৎসাহ ও সহযোগিতায় ১৯১২ সালে কালীমোহন ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। উদ্দেশ্য ইংরেজি সাহিত্য ও শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি অনুশীলন। একই বছরের মে মাসে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। কবি কালীমোহন ঘোষকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডব্লিউ বি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, এইচ জি ওয়েলস, আর্নেস্ট রীস, ঈভলিন আন্ডারহিল, অ্যালিস মেনীল, রটেনস্টাইনের কাছে পাঠাতেন। সে-সুবাধে এই বরেণ্য মানুষদের সাথে কালীমোহন ঘোষের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।৩ ইংল্যান্ডে এজরা পাউন্ডের সাথে সন্ত কবীরের দোহার ইংরেজি অনুবাদ করা কালীমোহন ঘোষের অন্যতম প্রাপ্তি। 'ঈবৎঃধরহ ঢ়ড়বসং ড়ভ শধনরৎ' গ্রন্থে ঞৎধহংষধঃবফ নু কধষর গড়যধহ এযড়ংব ধহফ ঊুৎধ চড়ঁহফ মুদ্রিত হয়েছিল।৪ ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ কালীমোহন ঘোষকে দেশে নিয়ে আসেন। এবার তাঁকে শান্তিনিকেতনের শিশু বিভাগের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের সাথে কালীমোহন বিভিন্ন সফরে যেতেন। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঈশ^রগঞ্জের আঠারবাড়িতে যান। সেসময় কবির সাথে তাঁর পুত্রবধূ, নাতনি, ভ্রাতুষ্পুত্রসহ কালীমোহন ঘোষও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববঙ্গ সফরকালে কালীমোহনও তাঁর সাথে ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই শ্রীনিকেতন গড়ে ওঠে। তিনি কবিগুরুর লেখা অনুলিখন করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কালীমোহন ঘোষের পত্রালাপও হত। কালীমোহন ঘোষকে লেখা কবির ৪২টি চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়।৫ প্রথম চিঠিটি ১৯ বৈশাখ ১৩১৫ বঙ্গাব্দের। এ চিঠির ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, এর পূর্ব থেকেই তাঁদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে। ১৯৩৩ সালে কালীমোহন ঘোষ উপলব্ধি করলেন বিশ্বভারতীর কর্মকর্তারা তাঁকে কাজের অন্তরায় ভাবেন।৬ অথচ তিনি সারাজীবন নিরলস-নির্মোহভাবে কাজ করে গেছেন। তাই বিশ্বভারতীর আচরণে মনক্ষুণœ কালীমোহন পদত্যাগপত্র জমা দেন। রবীন্দ্রনাথকেও পত্রের মাধ্যমে এ বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি ব্যথিতমনে লিখেছেন :
শ্রীচরণকমলেষু গুরুদেব,
আপনাকে আরেক দুঃখের সংবাদ দিতেছি। অদ্য প্রাতে আমি শ্রীনিকেতনের কর্মে পদত্যাগ করিয়াছি। গভীর বেদনার সহিত আমার প্রতি আমি এই নিষ্ঠুর আঘাত করিতে বাধ্য হইয়াছি। যৌবনের প্রথম হইতেই বঙ্গদর্শনের ভিতর দিয়া আপনার নিকট হইতে দেশসেবার যে আদর্শ লাভ করিয়াছিÑতাহার প্রেরণায় গভীর আনন্দে শ্রীনিকেতনের সেবার ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলাম। কিন্তু আমি গতবার মান্দ্রাজ হইতে ফিরে আসার পর হইতে যে অবস্থা হইয়াছে তাহা বিদূরিত হয় নাই। এখানকার ওহভষঁবহঃরধষ সহকর্মীগণ বারবার কথা প্রসঙ্গে জানাইয়াছেন যে আমি যেন তাঁহাদের কর্ম্মের পথে অন্তরায়। এই অবস্থায় অনেক বিবেচনার পর এই পদত্যাগপত্র দিয়াছি। যে অবস্থায়ই থাকি এবং যেখানে কার্য করি আপনার আদর্শ প্রচারই আমার বাকি জীবনের কার্য হইবে। ৭/৮ দিন পর কলিকাতা গিয়া আপনার সহিত দেখা করিয়া আমার বক্তব্য জানাইব।
অনুগ্রহপূর্ব্বক এই বিশ্বাস রাখিবেন যে কোনো স্বার্থের জন্য যাচ্ছি না। কোথাও চাকুরীর চেষ্টাও করি নাই। গুরুতর দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হইবে এবং শান্তিনিকেতনের সহিত বাহিরের বিচ্ছেদও আমার প্রাণে গভীর বেদনার সঞ্চার কবিবে। এ সব জানিয়াই এই দুঃখবরণ করিতেছি।
এই জীবন সংগ্রামেও আপনার আশীর্বাদ ভিক্ষা করি। আপনার প্রতি আমার একনিষ্ঠ ভক্তি ও শ্রদ্ধা সম্বন্ধে বিশ্বাস রাখিবেন ইহাই একান্ত অনুরোধ। অন্যথায় সেই অবিশ্বাসের আঘাত আমার পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হইবে।
ইতি
আপনার ভক্তিপ্রণত
কালীমোহন।৭
রবীন্দ্রনাথ চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। জবাবে তিনি যা লিখেছেন, তাতে কবির কাছে কালীমোহন ঘোষ যে কতটা আস্থাভাজন ও নির্ভরযোগ্য তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কালীমোহন ঘোষকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জবাব :
কল্যাণীয়েসু
তুমি কাজে ইস্তফা দিয়েচ এ হতেই পারে না। তোমাকে কোনোমতেই ছুটি দিতে পারব না। তুমি গেলেই চলবে না। কার সঙ্গে তোমার কী অনৈক্য হয়েছে তা নিয়ে তুমি মন খারাপ করে এত বড়ো কাজ মাটি কোরো না। যারা তোমার মূল্য বোঝে না তাদের উপর আমি শ্রদ্ধা করতে পারিনে। যাই হোক দশজনে একসঙ্গে কাজ করতে হলে এরকম মনান্তর মতান্তর হয়েই থাকে, তা নিয়ে তুমি নিরাশ হোয়ো নাÑজেনো তোমার উপর আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভর আছে। তোমার কর্মত্যাগপত্র আমরা কিছুতে স্বীকার করব না। ইতি
শুভানুধ্যায়ী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২ মে ১৯৩৩।৮
ব্যক্তিগত জীবনে কালীমোহন প্রখ্যাত উকিল দীননাথ বসুর কন্যা মনোরমা দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯০৬ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। তিনি ৬ ছেলে ১ মেয়ের জনক ছিলেন। বিখ্যাত রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য শান্তিদেব ঘোষ ও দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁরই সন্তান। কর্মবীর কালীমোহন ১৯৪০ সালের ১২ মে অমৃতালোকে পাড়ি জমান। তাঁর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ কালিম্পঙে ছিলেন। দীর্ঘদিনের সহযোগী হারিয়ে স্বাভাবিকভাবে কবি ভীষণরকম শোকাহত হয়ে পড়েন।৯ তিনি ১৯ মে কালীমোহন-পুত্র শান্তিদেব ঘোষকে চিঠিতে লিখেছেন :
তোমার পিতার মৃত্যুসংবাদে গুরুতর আঘাত পেয়েছি। শান্তিনিকেতনে আসবার পূর্বে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার নিকট সম্বন্ধ ঘটেছিল। কর্মের সহযোগিতায় ও ভাবের ঐক্যে তাঁর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা গভীরভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। অকৃত্রিম নিষ্ঠার সঙ্গে আশ্রমের কাছে তিনি আপনার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ...তাঁর মূর্তি আমাদের আশ্রমে এবং আমার মনের মধ্যে চিরদিনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে রইল। লোকহিতব্রতে তাঁর যে জীবন ত্যাগের দ্বারা পুণ্যোজ্জ্বল ছিল, মৃত্যু তার সত্যকে খর্ব করতে পারে না। এই সান্ত¡না তোমাদের শান্তি দান করুক।১০
বিংশ শতাব্দির সূচনালগ্ন থেকে কালীমোহন আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ছিলেন।
তথ্যনির্দেশ :
১. শান্তিদেব ঘোষ, জীবনের ধ্রুবতারা, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, চৈত্র ১৪২২, পৃ. ২৪-২৬
২. শান্তিদেব ঘোষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১
৩. তদেব, ৩৭
৪. তদেব, ৩৭
৫. পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কবি ও কর্মী : রবীন্দ্রনাথ ও কালীমোহন ঘোষ, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং হাউজ, জানুয়ারি ২০০৭, পৃ. ৫৯
৬. পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯
৭. তদেব, ১৯
৮. তদেব, ৫৪-৫৫
৯. অঞ্জন আচার্য, রবির জীবনে মৃত্যুশোক, কলকাতা : আত্মজা পাবলিশার্স, নভেম্বর ২০১৭, পৃ. ৭৭-৭৮
অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, গৌতম ভট্টাচার্য (সম্পা.), শান্তিদেব ও শান্তিনিকেতন, কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ডিসেম্বর ২০০২, পৃ. ১১