প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২১, ০০:০০
প্রাথমিকে ভর্তি বাড়াতে এবং ঝরে পড়া রোধে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার। ১৯৯৯ সাল থেকে প্রকল্পের মাধ্যমে এ উপবৃত্তি বিতরণ করা হচ্ছে। উপবৃত্তির পরিধি ও টাকার পরিমাণ বাড়ায় প্রকল্প নয়, এবার রাজস্ব খাতের মাধ্যমে সরাসরি সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীর মাঝে উপবৃত্তি বিতরণ করা হবে। উপবৃত্তি বিষয়ে বিশৃঙ্খলা রোধ ও খরচ কমাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, আগামী ৩০ জুন প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্পের (৩য় পর্যায়) মেয়াদ শেষ হবে। এরপর থেকে এটি রাজস্ব খাতে চলে যাবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রকল্পটি সরাসরি পরিচালনা করবে। প্রকল্প থেকে উপবৃত্তি রাজস্ব খাতে নেওয়ার সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ ইউসুফ আলী বলেন, প্রকল্পের তৃতীয় মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের জুন মাসে। করোনার পরিস্থিতির কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। সেই মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসের ৩০ তারিখ। এরপর প্রকল্পটি সরাসরি রাজস্ব খাতে চলে যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত আছেন চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তাদের বিদায় নিতে হবে। তবে হাইকোর্টের নির্দেশে কিছু কর্মকর্তাকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হবে।
তিনি জানান, রাজস্ব খাতে গেলে প্রকল্পটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত হবে। তখন এ প্রকল্প পরিচালনার জন্য একজন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি মূলত এ উপবৃত্তির বিষয়গুলো দেখভাল করবেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে ২০০৮ সালে ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’ গ্রহণ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ ২০১৫ সালের ৩০ জুন শেষ হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ পর্যায়ে প্রথমে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এর সঙ্গে আরও ১০ লাখ শিক্ষার্থী যুক্ত করা হয়। প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। সবশেষ সংশোধনীতে আরও দেড় বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। যা শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ জুন।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেন সার্ভিস ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে এক শিক্ষার্থীর পরিবারকে মাসে ১৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। একই পরিবারে শিক্ষার্থী দুজন হলে দেওয়া হয় ৩০০ টাকা, তিন শিক্ষার্থীর পরিবারকে ৪০০ টাকা এবং চার শিক্ষার্থীর পরিবারকে মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
প্রাথমিকে রেকর্ড উপবৃত্তি বিতরণ : প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ও মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি এবং ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্প চালু করা হয়। ২০০২ সালে দুটি কর্মসূচিকে একীভূত করে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে সরকার। উপবৃত্তি প্রকল্পের সুফল বিবেচনায় ২০০৮ সালে পুনরায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (২য় পর্যায়) গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে তৃতীয় পর্যায়ে সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীর লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৩০ লক্ষ নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে দুই দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। বর্ধিত সময়ে উপবৃত্তির সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৪০ লাখ নির্ধারণ করা হয়।
উপবৃত্তি প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ২০০৮ সাল থেকে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ১২ কোটি ৭৪ লাখ ৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ হাজার ৪৯ কোটি ৩৯ লাখ ২ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৪৮ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৮ কোটি ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৭৮ লাখ শিক্ষার্থীদের হাতে ৫৭ কোটি ৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৭৬ লাখ ১৯ হাজার শিক্ষার্থীকে ৮২ কোটি ৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭৭ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী হাতে ৯২ কোটি ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭৭ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে ৮৯ কোটি ৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৭ লাখ ৮৭ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে ৯০ কোটি ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ কোটি ১৭ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে ১৩৪ কোটি ২ লাখ ৪০ হাজার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ কোটি ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে ১৩২ কোটি ৮ লাখ ৯৬ হাজার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি ২০ লাখ শিক্ষার্থীকে ১৪০ কোটি ৯ লাখ ৩ হাজার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীকে ১৪৯ কোটি ২ লাখ ১২ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ কোটি ১৬ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে ১১৫ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ থাকা ১১৬ কোটি ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৬ মাসের টাকা বিতরণ শেষ হয়েছে। বাকি টাকা বিতরণ চলছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জামা-জুতা কেনা বাবদ এককালীন ১ হাজার টাকা শিগগিরই বিতরণ শুরু করা হবে। এ জন্য ১১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (৩য় পর্যায়) পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ ইউসুফ আলী বলেন, এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনার রেকর্ড পৃথিবীতে নেই। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনন্য একটি নজির স্থাপন করেছে। প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ সম্ভব হয়েছে কেবল উপবৃত্তি কর্মসূচির কারণে। মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, শুধু উপবৃত্তির টাকা পাবে এজন্য অনেক শিক্ষার্থীরা স্কুল এবং পড়াশোনায় মনযোগী হয়। কারণ, উপবৃত্তি পেতে হলে তাকে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত ও পড়াশুনার মধ্যে থাকতে হয়।
উপবৃত্তি শিক্ষার অগ্রগতিতে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীতে শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তির হার ও শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখার ক্ষেত্রে উপবৃত্তি কর্মসূচি দারুণভাবে কাজ করেছে। বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলে আনা এবং পরবর্তীতে ধরে রাখার ক্ষেত্রে এ কর্মসূচি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।