বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জহিরুল হক পাঠানের চির বিদায়

আজ সকাল ১০টায় অলিপুর হাই স্কুল মাঠে জানাজা

কামরুজ্জামান টুটুল ॥
সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জহিরুল হক পাঠানের চির বিদায়

মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও পাঠান বাহিনীর প্রধান অনারারী ক্যাপ্টেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক পাঠান (৮৭) ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি হাজীগঞ্জ উপজেলার অলিপুর পাঠান বাড়ির মৃত আব্দুল গনি পাঠানের সন্তান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন কন্যা, নাতি-নাতনিসহ বহু আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।

মরহুমের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি গতকাল ২৭ জানুয়ারি শনিবার রাজধানীর জুরাইনের নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন এবং রাত ৮টায় জুরাইন এলাকার মসজিদে প্রথম জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি অলিপুরে তাঁর লাশ আনা হয়। আজ ২৮ জানুয়ারি বোরবার সকাল ১০টায় মরহুমের হাতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অলিপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান পরবর্তী সময়ে ২য় জানাজা শেষে অলিপুর পাঠান বাড়ির পারিবারিক গোরস্তানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে।

উল্লেখ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার অনারারী ক্যাপ্টেন ও পাঠান বাহিনীর প্রধান জহিরুল হক পাঠান ছিলেন পাকবাহিনীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত, সাহসী আর শক্ত মনোবলের এক যোদ্ধা। তিনি যুদ্ধকালীন চাঁদপুর মহকুমা ও সন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

জীবনবৃত্তান্ত

জহিরুল হক পাঠান ১৯৩৭ সালের ৮ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার অলিপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত পাঠান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আবদুল গণি পাঠান, মাতা মরহুমা তাহেরুন নেছা, স্ত্রী নার্গিস হক। তিনি আট ভাই-বোনের মধ্যে সপ্তম এবং তিন সন্তানের জনক। তাঁর বর্তমান ঠিকানা নার্গিস ভিলা, ৫৯ রজ্জব আলী সরদার রোড, পূর্ব জুরাইন, কদমতলী থানা, ঢাকা ১২০৪। শৈশবে তিনি অলিপুর প্রাইমারি স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে বলাখাল হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছোটবেলা থেকে জহিরুল হক পাঠান ছিলেন একজন ভালো খেলোয়াড়, তাই সেনাবাহিনীতে তিনি ভালো খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল একটি দক্ষ, চৌকস সামরিক বাহিনী, যা বাঙালিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণ সহ্য করে যে ক’জন বাঙালি ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধে প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন জনাব জহিরুল হক পাঠান ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কঠোর পরিশ্রম, সততা, শৃঙ্খলা ও বীরত্বের সঙ্গে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অনেক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে লাহোর বেদিয়ান খেমকেরান সেক্টরে দুটি হিন্দুস্তানি ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। অসীম সাহস ও বীরত্বের জন্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান জহিরুল হক পাঠানকে ‘তগমায়ে জুরাত’ (টিজে) খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে এজন্যে জহিরুল হক পাঠানকে বিভিন্ন স্থানে ৬টি সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ৭ একর খাস জমি এবং তাঁর ৩ পুরুষ পর্যন্ত মাসে ৩০ টাকা হিসেবে ভাতা প্রদান করে। এছাড়া তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘রণাঙ্গনে পাকিস্তান’ বইতে লিপিবদ্ধ করে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে।

১৯৭১ সালের প্রথম দিকে জনাব জহিরুল হক পাঠান যশোর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বদলি করা হয়। দেশের পরিস্থিতি বুঝে তিনি লাহোরে না গিয়ে কৌশলে ২ মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি ৪ তারিখ থেকে ১২টি রাইফেল নিয়ে হাজীগঞ্জ বাজারের দক্ষিণে টোরাগড় গ্রামে ছাত্র-যুবকদেরকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দান) ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তিনি দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যের প্রেরণায় ডাঃ আবদুস সাত্তার (এমসিএ) পরামর্শে নিজ এলাকায় ছাত্র-যুবকদেরকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে হানাদার বাহিনী বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়ে কয়েক লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর গ্রেপ্তারের পূর্ব মুহূর্তে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনঃঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি চাঁদপুর মহকুমার মুক্তিবাহিনী গঠনে পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল করিম পাটোয়ারী, অ্যাডঃ আবু জাফর মোঃ মঈনুদ্দিন, অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম ও ওয়ালিউল্লাহ নওজোয়ানের অনুরোধে জহিরুল হক পাঠান চাঁদপুরের সামরিক বাহিনী, ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-যুবকদেরকে সংগঠিত করে ৩০০ সদস্যের একটি দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং পুরো চাঁদপুর মহকুমার বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাঁদপুর হানাদার বাহিনী মুক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বেশ ক’টি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো : বলাখাল রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাট যুদ্ধ, ওটতলী খেয়াঘাট যুদ্ধ, ফরিদগঞ্জের মুন্সীরহাট যুদ্ধ, কামতা যুদ্ধ, খাজুরিয়া, কড়ইতলী, ঠাকুরবাজারের লড়াই, রামগঞ্জের কালীবাজার, শাহরাস্তির নরিংপুর ও হাজীগঞ্জের লাকমারা যুদ্ধ। এসব যুদ্ধ পরিচালনা করে হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরে গিয়ে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর জীবনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করে যান। তিনি চাঁদপুর মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের উপদেষ্টা, অলিপুর হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও অলিপুর দিঘিরপাড় মাদ্রাসার দাতা সদস্য।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে ক’জন অকুতোভয় কিংবদন্তি বীরযোদ্ধা ছিলেন, সুবেদার জহিরুল হক পাঠান তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে চাঁদপুরের মতলব, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর, কচুয়া ও নোয়াখালীর কিছু অংশ নিয়ে যে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল, সুবেদার জহিরুল হক পাঠান ছিলেন এই বিশাল মুক্তিবাহিনীর পরিচালনার দায়িত্বে। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন চাঁদপুর মহকুমা মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক এবং সাব সেক্টর কমান্ডার। একাত্তরে তাঁর বাহিনী পাঠান বাহিনী হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিল এবং তাঁর সেক্টরের কোড নাম ছিল মধুমতি, নম্বর ১২০৮। চাঁদপুর থেকে হানাদার বাহিনী মুক্ত হওয়া পর্যন্ত সুবেদার জহিরুল পাঠান প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রায় ৬৪টি সামরিক হামলা ও যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পাঠান বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধের কথা এখনো চাঁদপুরবাসীকে শিহরিত করে। এ বীরযোদ্ধার কীর্তিগাথা ও বীরত্বের কাহিনি আজও চাঁদপুরবাসীর হৃদয়ে চির জাগ্রত রয়েছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের অবদান অপরিসীম।

সূত্র : পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিঃ থেকে প্রকাশিত ‘চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়