প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৩৮
৯ বছর পর হাইমচরের মনিকে উদ্ধারের স্মৃতিচারণে সাবেক পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির
চাঁদপুরের সাবেক ও সফল পুলিশ সুপার জিহাদুল করিব। যে কোনো ক্রাইম তদন্তে নিজেই তদারকি আর আপডেটটা জানতে সহকর্মীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। চাঁদপুরে দায়িত্ব পালনকালে জেলায় সফলতার সাথে কাজ করেছেন। সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছিলেন একাকারভাবে। সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন নিরন্তর। যে কোনো ঘটনার পেছনে লেগে থাকতেন বাঘা বাঘা গোয়েন্দার মতো। তেমনি একটি ঘটনার পেছনে লেগে থেকে খুঁজে বের করেছেন হাইমচরের মনিকে। মনিকে ৯ বছর পর বাবার বুকে ফিরিয়ে দিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। সাবেক কর্মস্থলের বহু উদ্ঘাটনকৃত ঘটনার মধ্যে মনিকে উদ্ধার ও বাবার বুকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে নিজের ফেসবুক আইডিতে স্মৃতিচারণ করেছেন এই কর্মকর্তা। গত রোববার জিহাদুল কবিরের ফেসবুক পেজ থেকে তার দেয়া স্ট্যাটাসটি চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠকদের জন্য হুবহু নিচে দেয়া হলো :
|আরো খবর
১৩ বছর পর আদরের সন্তানের মুখটা দেখে আর সইতে পারলেন না সাত্তার। ‘মা রে’ বলে সেন্স হারিয়ে ফেললেন। লোকটা জ্ঞান হারালো ঠিকই, কিন্তু চাঁদপুর পুলিশ সুপারের (ঔবযধফঁষ কধনরৎ) রুমে তখন বইছে আনন্দের বন্যা। কারও কারও চোখের ধার বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল আনন্দাশ্রু। কী প্রশান্তি! কী তৃপ্তি! বিষয়টা খুবই সাধারণ। তবে এখন আর সাধারণ নেই। এক যুগ পর খোয়া যাওয়া সন্তানের মুখ দেখতে পেলে ঘটনাটা আর সাধারণ থাকে কী করে বলুন? মেয়েটার নাম নার্গিস আক্তার। ৯ বছরের ফুটফুটে সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে। তাই বাড়ির সবাই আদর করে মনি বলে ডাকে। দুরন্ত আর উচ্ছল মনির দিনগুলো ভালই কাটছিল বাবা-মার সাথে। বাবা হতদরিদ্র কৃষক। কিন্তু পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই। অগত্যা প্রতিবেশী স্বজনের দ্বারস্থ হতে হল তাকে। তারা ধনাঢ্য পরিবার। প্রায় সারা বছর ঢাকাতেই থাকেন। তাদের বাসায় গেলে খাওয়া পরার অভাব হবে না। ধনাঢ্য এই পরিবারও আশ^াস দিল, বাসায় তেমন কাজই নেই। খাবে-দাবে টিভি দেখবে আর মাঝে মাঝে গৃহকর্ত্রীকে সাহায্য করবে। বিনিময়ে মাস গেলে ভাল মাইনে পাবে। বউয়ের সাথে পরামর্শ করে মনিকে পাঠালেন ঢাকায়। যাওয়ার সময় বাবার গলা ধরে খুব কেঁদেছিল মনি। মায়ের আঁচলটা জাপটে ধরে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়েছিল ঠিকই। মা বলেছিল সামনের মাসেই দেখা হবে আবার। বিশ^াসও করেছিল মেয়েটা। কিন্তু তার বিশ^াস সত্যি হয়নি। ঢাকার বাসায় আনার পর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। সইতে না পেরে মাসখানেক পরেই রাতের আঁধারে পালিয়ে চলে যায় সদরঘাট। ৮/৯ বছরের বাচ্চাকে একা একা ঘুরতে দেখে এগিয়ে আসে এক লোক। বলে ‘আমার সাথে যাবে’? এরপর ঐ লোকটি মনিকে নিয়ে যায় উত্তরায় তার চাচীর বাসায়। এক মাস পরেই ঢাকা থেকে তার মনিব বাগেরহাটে পাঠিয়ে দেয় তার মেয়ের কাছে। ৮ বছর কাজ করে ঐ বাসাতে, তবে সেখানেও তার ওপর চলে নির্যাতন। আবার পালায় মনি। কিন্তু কোথায় যাবে, কী করবে বুঝতে পারে না। আবারো অসহায়ের মত ঘুরতে থাকে পথে পথে। এবার আশ্রয় হয় এক কমিশনারের বাড়িতে। কিছুদিন পরেই কমিশনার মনিকে পাঠায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট হলেও বর্তমানে ঢাকায় সেটেল্ড। বাড়ির কর্ত্রী অমায়িক মানুষ। মাঝে মাঝেই গল্প করেন মনির সাথে। সদা উচ্ছল মেয়েটা মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে যায়। একদিন কথাচ্ছলে মনি জানায় তার করুণ ইতিহাস। শুনে খুব মায়া হয় তার। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কেননা মনির ছোট বেলার কথা কিছুই মনে ছিল না। শুধু বলতে পারে চাঁদপুরের দিকে কোথাও হরিণহাটা জাতীয় নামের একটা গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। বাবার নাম সাত্তার। যাই হোক, এইটুকু সম্বল নিয়ে কারও এক যুগ আগের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ একদিন গৃহকর্ত্রীর (ঝধষরহধ ঔধযধহ ঘওঢ়ঁ পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের কলেজের বন্ধু) আলাপ হয় চাঁদপুরের পুলিশ সুপারের সাথে। কথা প্রসঙ্গে মনির কথা উঠে আসে। ঘটনাটা দুঃখ প্রকাশ আর সান্ত¡নার মধ্য দিয়েই শেষ হতে পারতো। কিন্তু পুলিশ সুপার মহোদয় বাসায় এসে ঘুমোতে পারেননি। যতবার তার আদরের মেয়ে তাকে বাবা বলে ডেকেছে, ততবারই তার মনে হয়েছে কেউ হয়তো প্রতীক্ষা করছে মনির বাবা ডাক শোনার জন্য। তাই স্থির করলেন খুঁজবেন। রহংঢ়বপঃড়ৎ রহাবংঃরমধঃরড়হ চাঁদপুর মডেল থানা মাহবুব (গধযনঁনঁৎ জধযসধহ) সন্ধান শুরু করেন। সন্ধান মেলে হরিণাঘাটের, তারপর ঐ এলাকার সাবেক মেম্বার হাসানের সহায়তায় সন্ধান মেলে ১২ জন সাত্তারের। তবে দুঃখের বিষয়, মনির বাবা সাত্তারের সন্ধান কেউ দিতে পারে না। হাল ছাড়েন না পুলিশ সুপার মহোদয়। গত ১০/১২ বছরে কোনো কোনো সাত্তার মারা গেছেন, কারা গ্রাম ছেড়েছেন তাদের খোঁজ নেয়া চলে। অবশেষে জানা যায়, মূল গ্রাম থেকে বসতি ছেড়ে চর এলাকায় বসতি করেছে এক সাত্তার। ২৬/০৯/১৮ তারিখ এসপি অফিসে আনা হয় তাকে। কথা শুনে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এরপর একটা ভিডিও কল। এক প্রান্তে পুলিশ সুপার মহোদয় অন্য প্রান্তে মনি। কথার এক পর্যায়ে ফোনের ক্যামেরা তাক করা হয় সাত্তারের দিকে। এরপর স্তব্ধ সবাই। ফোনের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় দুটি মানুষ। জড়িয়ে ধরতে চায়। কাঁদতে চায় এক যুগের জমা হওয়া কান্না। একটুও ভুল হয়নি দু’জনার। এক যুগ ভুলতে দেয়নি পরস্পরের মুখ। যে ছবি থাকে হৃদয়ে, সময় তাকে কি মুছে দিতে পারে?
আজ ঢাকা থেকে আনা হবে মনিকে। ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার বাবা, ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার ঠিকানা। শুধু থাকছে না তার মা। মেয়ের শোকে ৮ বছর আগে গত হয়েছেন তিনি। মনিকে কি পারবে বাবার বুকে ফিরে মায়ের অভাব ভুলতে? বাবাইবা কিভাবে সামলাবেন আজকের এই ২২ বছরের কন্যাকে।
এখন এত ভাবার সময় নেই। চাঁদপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আসছে মনি। নিভে যাওয়া দীপ আবারও জ্বলতে চলেছে। মিলন মেলার চলছে আয়োজন। এই মিলনক্ষণে আপনিও আমন্ত্রিত। শেষ কথা নিরাপদ হোক সকল শিশুর শৈশব, জাগরুক থাকুক কচিপ্রাণের কলরব।
অনুলিখন : আশীষ বিন হাসান অংযরংয ঐধংধহ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বেড়া সার্কেল), পাবনা।