প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:২৬
অপরিকল্পিত নগরায়নে ভাসছে গ্রামীণ জনপদ-৪
ফসলি জমি পুকুর জলাশয় ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিক আবাসন
মানুষ বৃদ্ধি পেয়েছে যেমন তেমনি মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাসস্থানের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। বেঁচে থাকার জন্যে বাসস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কিন্তু সেই বাসস্থান তৈরি করতে গিয়ে যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান ফসলি জমি ও জলাশয়ের মতো প্রাকৃতিক মাছের উৎস। পুকুর ভরাট তো মামুলি ব্যাপার। কোথাও কোথাও নদী ও খালের অংশবিশেষও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসবের জন্যে অনেকাংশে দায়ী অতি লোভী আবাসন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য এবং প্রশাসনের যথাযথ হস্তক্ষেপের অভাব । এতে করে হুমকির মুখে পড়ছে স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য।
বর্ষা মৌসুমে পত্রিকার পাতা খুললে দেশের বড়ো বড়ো শহরে জলাবদ্ধতার খবর দেখা যায়। মূলত অতিবৃষ্টির কারণে যখন জলাবদ্ধতা তৈরি হয় তখন বিশেষজ্ঞগণ মতামত দেন যে, জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিতভাবে নদী ও খাল ভরাট করা। যখন কোনো ভবন দুর্ঘটনায় পতিত হয় বা ভেঙ্গে যায় অথবা হেলে যায়, তখন আমাদের বিশেষজ্ঞগণ মতামত দেন, ভবন তৈরিতে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়নি। কিন্তু নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং পরিবেশের স্বাভাবিক গতিধারা বজায় রাখার জন্যে যদি ভবন তৈরি করার আগে অথবা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে এমন বিষয়ে বাস্তব সম্মত আইন এবং তার প্রয়োগ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হতো, তবে অনেক ক্ষতি থেকে বেঁচে যেতো সকলে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশকে ভাটির দেশ বলা হয়। উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে এসে বহমান নদীর উপর দিয়ে তার প্রবাহ সাগরে মিশে যায়। পানির এই স্বাভাবিক গতিধারা অব্যাহত রাখতে নদী, খাল, হাওর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে নদী,খাল ও হাওড় পানির স্বাভাবিক গতিধারা অব্যাহত রাখতে পারছে না। খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, নদী জবরদখল হওয়া, পুকুর-জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ি তৈরি করার ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ আজ বন্ধ প্রায়। যার পরিণতি বর্ষা মৌসুমে ভোগ করে থাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন ।
জাতীয় তথ্য বাতায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, জনসংখ্যা বিবেচনায় ঢাকার ১২-১৫ শতাংশ এলাকায় জলাশয় থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও বর্তমানে এর আওতা মাত্র ৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ৩০ বছরে ঢাকার ৬০ শতাংশের জলাভূমি হারিয়ে গেছে। ঢাকার অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৬৫ টি পুকুরের অধিকাংশ ভরাট হয়ে গেছে। যেখানে দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকার নগর পরিকল্পনার চিত্র এমন, সেখানে জেলা, উপজেলা এবং গ্রামীণ নগরায়নের বাস্তবতা কেমন হতে পারে তা অনুমেয়।
দেশের সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দালান তৈরি করার বিধিনিষেধ কিছুটা পালন করা হলেও পৌরসভা বা প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ম- কানুনের তোয়াক্কা করছে না অনেকেই । নিয়ম মেনে বাড়ি তৈরি করার প্ল্যান পাস করলেও বাস্তবে কাজ করার সময় নির্ধারিত জায়গা না ছেড়েই তৈরি হচ্ছে বাড়ি। মফস্বল এলাকায় যে যার মতো করে ব্যক্তি অথবা বাণিজ্যিক পরিকল্পনা করছে আর ভবন তৈরি করছে। এক ইঞ্চি জায়গা খালি রেখে কাজ করতে রাজি নয় প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ। ফলে রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা কোনো কিছুই পরিবেশবান্ধব তথা জনবান্ধব করে তৈরি করা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও উল্লেখিত নাগরিক পরিষেবাগুলো তৈরিই হচ্ছে না। যার কারণে অপরিকল্পিত নগরায়নে নিরূপায় নাগরিক প্রায় সচেতন ভাবে খাল-বিল- জলাশয়ে ময়লা আবর্জনা ফেলছে। এতে করে পরিবেশ বিপর্যয় বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এতে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে বাড়ছে শিশু মৃত্যুহার, কমছে মানুষের গড় আয়ু।
মতলব দক্ষিণ উপজেলার ঘিলাতলী গ্রামের আলতাফ হোসেন বকাউল জানান, তার চার ছেলে। ছেলেরা বড় হয়ে সংসার সাজিয়েছে। মূল বাড়িতে এখন বসবাসের জন্যে জায়গা সংকুলান হয় না। তাই বাধ্য হয়ে ফসলি জমি ভরাট করে ছেলের জন্যে বাড়ি করেছি।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর পৌরসভার প্রকৌশল শাখার শহর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ ইসলাম বলেন, আমাদের দেশ জনবহুল। এখানে অল্প জমিতে অধিক মানুষ বসবাসের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। সে জন্যে সরকার জেলা- উপজেলায় পরিকল্পিত নগরায়নে প্রকৌশল বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, পরিবেশ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমন্বয়ে একটি কমিটি করেছে। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিকল্পিত নগরায়নে প্রয়োজনীয় বিধিনিষধ ঠিক করা আছে। এখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বাসযোগ্য নগর পরিকল্পনা করতে প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের উচিত প্রাকৃতিক ইকো সিস্টেম ঠিক রেখে বাড়ি-ঘর তৈরি করা।
'গ্রামীণ নগরায়নে ভূমির অপব্যবহার কীভাবে রোধ করা যায়' এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ ইসলাম বলেন, পৌর এলাকায় ভবন তৈরির বিধিনিষেধ কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। তবে মফস্বল এলাকার মানুষ এতোটা সচেতন নয়। তাই মফস্বল এলাকায় ইচ্ছে মতো খাল-বিল-জলাশয়- পুকুর ভরাট করে আবাসিক ভবন তৈরি না করার জন্যে জনগণকে সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি।