শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৭

অবসর

ইসরাত জাহান তন্নি
অবসর

জীবনের ভ্রমণে সব কিছু নিজ দায়িত্বে ছিল। এখন ছেলেদের বুঝিয়ে দিয়েছি গত চার বছর আগে। তবুও ছেলেদের আবদারে আমি সকল ব্যবসা, প্রতিষ্ঠানে এতদিন নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি। এখন আমার সময় হয়েছে সব কিছু থেকে অবসর নেওয়ার। তাই আমি ছেলেদের সাথে গত চব্বিশ তারিখে বসে আলোচনা করেছি আর বলেছি, বাবারে তোমরা তো এখন সবটা সঠিক মতো বুঝ, আমিও চারটা বছর যাতে অসুবিধা না হয় তোমরা সবটা ভাল করে বুঝ তাই সকল কিছুর সাথে যুক্ত ছিলাম। এবং সকল তথ্য সংগ্রহ করে গুছিয়ে রেখেছিলাম এখন আমি কিছু টা সময় নিজের মতো করে কাটাতে চাই। একটু নিরবে। বিকেল হলে বইয়ের গভীরে হারিয়ে যেতে চাই। চায়ের চুমুকে গল্পের আনন্দ উপভোগ করতে চাই। এবার আমি বিদায় নিতে চাই। ছেলেরা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা বোঝানোর পর এখন ছেলেরা বলে, আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। তবে তোমাকে মাসে একবার হলেও আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যেতে হবে। তোমার পদধূলি, তোমার সুগন্ধি একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে আসবে। এতে করে ব্যবসা ভাল যাবে, আমরা ও খুশি থাকব, তোমার এ ইনসাফে আল্লাহ খুশি হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরো সুন্দর করে দিবেন।

গত চব্বিশ তারিখের আলোচনা মোতাবেক আগামীকাল বৃহস্পতিবার আমার সকল কিছু থেকে অবসরে যাওয়ার শেষ দিন। আমি সকালে নামাজ পড়ে, নাস্তা করে, সুন্দর পোশাক পরিধান করে বিধান সভায় উপস্থিত হলাম। আমি তাকিয়ে ই রইলাম। কতো রকমারি আয়োজন, বিভিন্ন স্থান থেকে আগত অনেক বড় বড় অফিসার, আর তার সাথে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বার, সমাজের গ্রাম প্রধান, আরো অনান্য অঞ্চলের মানুষ ও আমাদের অফিসের সকল স্টাফ, কলিগ। শাড়ি বদ্ধভাবে সকলে বসে আছেন। জীবনের দীর্ঘতম যাত্রার আজ শেষ প্রহর। এতো মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে আমাকে বিদায় জানানো দেখে সুখে আমার চোখজোড়া টলমল করতেছে। এদের মধ্যে অনেক কে আমি কঠোরভাবে শাসন করেছি বটে, কিন্তু এখন যখন উচ্চ পদবীতে আসন পেয়েছে এখন বলে স্যার, তখন যদি শাসন না করতেন আজ এ পোস্টে আসতে পারতামনা। অনেক কৃতজ্ঞ, ঋণী করে রাখলেন আমায়। তাইতো আজ আপনার অবসরের কথা শুনে চলে এলাম। এভাবে অনেকেই বলেছে। আবার আমি চলে যাব এ কথা শুনে আমার অফিসের পুরুনো স্টাফ মেম্বার রা আড়ালে কাঁদতেছে। যখন আমি তাদের সামনে গেলাম কান্না লুকিয়ে চোখ মুছে আমার দিকে তাকাল আমি দেখতে পেলাম,রক্তাক্ত চোখের চাহনী, যেন অগ্নি জ্বলে। আমি বল্লাম সকলের কাজের সমাপ্তি আছে। এই যে তুমি কাঁদতেছো তুমি ও চলে যাবে একদিন আমাদের অফিস ছেড়ে অবসরে। তখন তোমার ও আমার মতো এমন ক্লান্তি আসবে। এর চেয়ে আমি আর কি'বা বলতে পারতাম। কারণ আমার মনের মধ্যে যে কান্নার ঝড় বইতেছে সেটা তো আর দেখাতে পারতেছিনা তাহলে ওরা আর কষ্ট পাবে।

একটা সময় বিধান সভার কার্যক্রম শেষ হলো। একেক জনে একেক রকমের উপহার সামগ্রী দিচ্ছে আমাকে। কেউ ফুলের বুকে, কেউ স্কেচ, কেউ আমাদের সকল স্টাফ, কলিং মিলিয়ে ছবি ফ্রেম বাধাই করে দিয়েছে, আবার আমি যেহেতু বই পড়তে ভালোবাসি অনেক বই উপহার দিয়েছি। আবার বই রাখার জন্য বুক স্লেপ দিয়েছে। এক কথায় বিদায়ের ক্রন্দনে সকলের স্মৃতি আমার সাথে গেঁথে দিয়েছে। এভাবেই আমি বিদায় নিয়ে আসলাম এতোদিনের একটা সংসার নামক স্থান থেকে।

এখন রাত প্রায় পোনে একটা। আমার ঘুম আসতেছেনা। কি যেন রেখে আসলাম, এমন মনে হচ্ছে সর্বক্ষন। কতগুলো চেনা মুখের মানুষ ছিল। এগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল আরে সন্ধ্যায় তো ঘরে রহিত এসে সকল উপহার গুলো রেখে গিয়েছিল। এগুলো একটু খুলে দেখি। নিজের দুঃখ বিলাসী মনটাও একটু হালকা হোক। সবগুলো একেক করে সুন্দর করে আমার রুমে সাজিয়ে নিচ্ছি। এরইমধ্যে মধ্যে একটা বক্স পেলাম কালো কাপড় দিয়ে মুড়ানো। আমি খুব আগ্রহের সহিত হাতে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। কাপড়ের বক্স টা খুলে দেখি ছোট্ট একটা চিরকুট একটা কাঁচের কলম ও সাথে দু'টো বীজ। আমি আশ্চর্য হলাম এমন উপহার দেখে। আমি জীবনে অনেক উপহার পেয়েছি বা দিয়েছি এমন কাঁচের কলম আমি কোথাও দেখিনি বা পাইনি।শুধু আজই পেলাম। চিরকুটে লেখা ছিল

প্রিয় সাহেব,

আমি আপনার চাকরি শুরুতে যোগদান দেওয়া রহমতুল্লাহ। আপনার মতো আমারো চাকুরী থেকে অবসর নিতে হয়েছিল। সেদিন আমাকেও খুব আয়োজন করে নানা উপহার সামগ্রী দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন। সেদিন আমারো হৃদয় ক্ষরন হয়েছিল, কান্নার সাগরপথে পাড়ি জমিয়েছিলাম।

আল্লাহ আমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। আপনি আমার মুনিব ছিলেন,মহাজন ছিলেন,আশ্রয় দিয়েছিলেন,একটা তীরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সফলতা এনে দিয়েছিলেন আমার মুমূর্ষু জীবনে। আপনার এ মহাত্মা, আমি কী করে ভুলি বলেন। তাইতো আজ আপনার বিদায়ের খবর শুনে গুটি গুটি পায়ে চার বার পথে বিশ্রাম নিয়ে হাজির হয়েছিলাম এই সামান্য উপহার নিয়ে।

বীজটা বপন করিয়েন শুঁকনো মাটিতে আর এ বীজ থেকে উৎপাদিত হওয়া পাতার রস কাঁচের কলমে নিয়ে লিখতে পারবেন। তাহলে আর কলমে ঝং ধরবেনা,কালি ফুরিয়ে গেছে ভেবে ফেলে দেয়া হবেনা। তবে হে কীভাবে এটা সংরক্ষণ করে রাখতে হয় বা এমন কাঁচের কলম কোথা থেকে আনলাম, কীভাবে তৈরী করেছিলাম আমি আবার আপনার ছেলের অবসরে গেলে আবার এমন করে একটা চিরকুটে বলে দিব। তখন যদি আমি বেঁচে না থাকি তাহলে এভাবেই গুছিয়ে লিখে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে একজন কে বলে যাব যাতে আমার চিঠিটা আপনাদের হাতে পৌঁছে দেয়।আর এটাই হল আমার সামান্য উপহার।

ইতি আপনার

কেবিন মুছা রহমতুল্লাহ

আমি ওর এমন উপহারে খুবই আশ্চর্য হলাম! সে কতটুকু ভালোবাসা আগলে রেখে আমার জন্য এমন উপহার নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসেছিল। আমার জন্য এতো উদার মনের লেখা আমাকে রীতিমতো মুগ্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ ঘড়িতে টুং-টুং করে শব্দ হল।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনটা বেজে গেছে। সব কাগজপত্র গুছিয়ে, বিছানায় গিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। আর রহমতুল্লাহর গুটি গুটি পায়ের মাফ কতটুকু হয়েছিল, কতোটা মাইল হয়েছিল, আমার বিদায়ের বিধান সভায় উপস্থিত হতে হতে কতটুকু সময় ওর লেগেছিল, ওর মনে কতটুকু ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন উঠে নামাজ পড়ে, রহমতুল্লাহাহর কথা অনুযায়ী শুকনো মাটিতে বীজ রোপন করে আসলাম। আমি আমার রুমের পাশে জানলার কাছে বীজটা রোপণ করেছি যাতে সকলের স্মৃতির সাথে তার মূল্যবান দেয়া স্মৃতিটুকু বাহিরে থাকলেও এক সাথে থাকে। আমি এখন রোজ জানলার পাশে চায়ের কাপ আর এক গাদা বই নিয়ে বসি এবং গল্প পড়ি। আর রহমতুল্লাহর বীজ থেকে চারা কতটুকু হল খেয়াল করি। তার চিঠি মোতাবেক আমার ছেলেদের অবসরের কথা মনে করি। আবার এ ও মনে করি তাদের সে সময়ের সাপেক্ষে আমি কী থাকবো বেঁচে, রহমতুল্লাহর সে রহস্যময় কথা কী শুনতে পাবো আমি! এসব ভেবে ভেবে উষ্ণন্ন চায়ের কাপের ধোঁয়ার সাথে আমার দীর্ঘ শ্বাস উড়াই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়