মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৩

জেগে উঠুক বাংলাদেশের ক্রিকেট

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
জেগে উঠুক বাংলাদেশের ক্রিকেট

বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে সাথে যে বিষয়টি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে কোটি বাঙালির হৃদয়কে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলেছে, কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ ছাড়াই বলা যায়, ক্ষেত্রটি ক্রিকেট। আরও একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেট দলের মাঠের পারফরম্যান্সই আমাদের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ বিশ্বময়। এতদিন পাপন-হাথুরুর কাঁধে দায় চাপিয়ে ক্রিকেট পার পেলেও এবার বুঝি আর তার জো-টি নেই। এখন আর সেই হাথুরুও নেই, পাপনও নেই। কিছুদিন আগেও মাঠের খেলার চেয়ে মাঠের বাইরের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু দখল করেছিলো লাজলজ্জাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। সাকিব-তামিমের কাজিয়া কিংবা রাজনীতিকে ক্রীড়ায় এনে ক্রীড়াকে পুঁতিগন্ধময় করে তুলে যে ক্ষতি বাংলাদেশের ক্রিকেটের হয়েছে, তা পুষিয়ে উঠবার মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের ভাঁড়ারে আর নেই, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে কথা উঠেছে, মুশফিক-রিয়াদকে বিদায় জানানোর। তাদের ক্লান্তি দুচোখ ছাপিয়ে সারাদেহে বহমান। বুড়ো হাড়ে আর বিজয়ীর শক্তি নেই। বরং তাদের ক্লান্তি দলের তরুণদের মনেও নেতিবাচক রেখাপাত করতে পারে। কখন আট-দশ ম্যাচ পরে এক ম্যাচে জ্বলে উঠবে, সে আশায় জাতীয় দলের মতো দামি জায়গা বরাদ্দ রাখাটা আর উচিত নয় মোটেই। এবার সময় এসেছে নবীনের স্রোতকে টেনে এনে দলে নূতন রক্ত ঢোকানোর। কিন্তু সে আশায়ও গুড়ে বালি। কেননা, নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট কিংবা দামাল সামার ক্রিকেটের মতো টুর্নামেন্টগুলো আবার চালু না করলে নূতন খেলোয়াড় তুলে আনার প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়বে। ফলে বৃষ্টি হলে ছাতাবিহীন মাথা না ভেজানোর আকাঙ্ক্ষার মতোই দশা হবে। বৃষ্টি ঠেকাতে যেমন হাতে ছাতা অবশ্যই থাকতে হবে, তেমনি জাতীয় ক্রিকেট দলের পাইপ লাইনে সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারদের মিছিল অব্যাহত রাখতে ক্রিকেটার হান্ট-এর মতো প্রকল্পগুলো চালু রাখতে হবে, কোনো অজুহাতে তা বন্ধ করা যাবে না।

ক্রিকেট অনুশীলনের জন্যে প্রতিটি উপজেলায় একটা করে আদর্শ ক্রিকেট মাঠ সৃজন করতে হবে। নচেৎ ক্রিকেটার তৈরি হবে না, বরং পাড়ায় পাড়ায় গভীর রাতে টেপ টেনিস খেলার প্রজন্ম তৈরি হবে।

যে ক্ষোভের উদ্গীরণ করে এ লেখার সূচনা হলো, সে ক্ষোভ মূলত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের হতাশাজনক পয়েন্ট টেবিল দেখে। দুহাজার তেইশ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা প্রথম আটদলের সমন্বয়ে এবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। তাও আবার দুহাজার সতের সালের পর, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে। পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ছিলো ভারত,পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের সাথে একই গ্রুপে। গ্রুপটি শক্ত ছিলো, এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। ফেব্রুয়ারির ঊনিশ তারিখ থেকে নয়ই মার্চ পর্যন্ত চলমান এ প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ছিটকে পড়েছে টুর্নামেন্টের পরবর্তী রাউন্ড থেকে। ফেব্রুয়ারির কুড়ি তারিখ ছিলো বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলা। দুবাইতে অনুষ্ঠিত এ খেলায় ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাটিং পায়। মাত্র দুশো আটাশ রানে অল আউট হয়ে ভারতের কাছে ছয় উইকেটে পরাজয় বরণ করে। আহত খোঁড়া পা নিয়ে তাওহিদ হৃদয়ের সেঞ্চুরি এবং জাকের আলীর আটষট্টি রান বাংলাদেশের স্কোরকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গেলেও ভারতের ব্যাটসম্যানদের কাছে তা নস্যি হয়ে যায়। চব্বিশে ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও তথৈবচ অবস্থা। নিউজিল্যান্ড পাঁচ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশের দুশো ছত্রিশ রানকে টপকে যায়। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত সাতাত্তর রান এবং জাকের আলী ও রিশাদ যথাক্রমে পঁয়তাল্লিশ ও ছাব্বিশ রান করে দলকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচান। সাতাশে ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত হওয়া ম্যাচে বৃষ্টির বদান্যতায় একটা বলও খেলার মাঠে গড়ায়নি এবং বাংলাদেশ ভাগ্য বরাতে একটা পয়েন্ট পায়। ইংল্যান্ড তাদের শেষ খেলায় হেরে যাওয়ায় পয়েন্ট টেবিলে তারা পয়েন্ট শূন্য থেকে খেলা শেষ করে। ফলে আট দলের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম হওয়ায় প্রাইজমানি হিসেবে অংশগ্রহণ করার কারণে ইংল্যান্ডের চেয়ে তিনকোটি টাকা বেশি পাবে। এটাই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি।

আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়, বাংলাদেশে আগামী কয়েক বছর খেলানোর মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলোয়াড় উঠে আসবেও না, আর আসেও নি। এর কারণ নিহিত আছে পরিকল্পনার দুর্বলতায়। এখানে কিছু কিছু অভিভাবকের প্রচেষ্টায় কিছু খেলোয়াড় তৈরি করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খেলোয়াড় তৈরি করার প্রকল্পে পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটার তৈরির জন্যে এমআরএফ যেমন একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান, তেমনি কেবল ক্রিকেটের জন্যে সেরকম একটা রাষ্ট্রীয় একাডেমি সব জেলায় এখনও চালু হয়নি। এ একাডেমির মাধ্যমে অন্তত প্রতি জেলা থেকে একজন করেও যদি নতুন খেলোয়াড় তুলে আনা যেতো, তাহলে প্রতিবছর আমরা চৌষট্টি জন করে খেলোয়াড় পেতাম। সেই খেলোয়াড়দের চারদলে ভাগ করে সারা বছর তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বজায় রাখলে মানসম্পন্ন খেলোয়াড় উঠে আসতে বাধ্য।

বিপিএল খেলোয়াড় তুলে আনার প্রকল্প নয়, এগুলো হলো দর্শক তৈরির প্রকল্প। ক্রিকেটারদের মানসিক স্তর গঠনের দিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি তাদের শারিরীক শৈলীকেও মাথায় রাখতে হবে। মেধাবী খেলোয়াড় হয়েও শারীরিক দুর্বলতার কারণে দলে আনফিট হয়ে যায়। আবার শারিরীকভাবে ফিট কিন্তু ট্যালেন্টেড না হওয়ায় দলের জন্যে কেবল ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়, সম্পদ হয় না।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পারফরম্যান্স হতে একটা বিষয় দাঁড়ালো, ওয়াসিম আকরামদের মতো বিশ্ব বরেণ্য ক্রিকেটাররা ঠিকই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নজরে রাখছেন। ঊনচল্লিশ বছরের মাহমুদউল্লাহ ও সাঁইত্রিশ বছরের মুশফিক এখনও দলে সুযোগ পাওয়াটা প্রমাণ করে, এদেশে ক্রিকেটার উঠে আসছে না। তাদের প্রতিস্থাপন করার মতো যোগ্য খেলোয়াড় এখনও তৈরি হয়নি। অথচ বয়স বিবেচনায় তারা আরও তিন চার বছর আগে অবসর নেওয়ার কথা। সতের-আঠারো হতে তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছরই হলো একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়ের আদর্শ ব্যাপ্তি। এর বেশি হওয়া মানে হয় তিনি অতিরিক্ত ফিট, নয় তার কোনো বিকল্প নেই।

ক্রিকেট বাঙালির ধ্যান-জ্ঞান। খেলার মাঠে শুধু এগারজন থাকলেও আসলে ক্রিকেট খেলে আঠারো কোটি মানুষ। হারলে এগারজন খেলোয়াড় হারে না, হেরে যায় লাল-সবুজের পতাকাও। কাজেই ক্রিকেটকে শুধু ক্রিকেট হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না, ক্রিকেট আমাদের মর্যাদার প্রতীক। সেই ভেবে প্রতিটি খেলোয়াড়কে মাঠে নামাতে হবে। ক্রিকেটের প্রয়োজনে আলাদা ক্রিকেট অধিদপ্তর করা নিয়েও ভাবা দরকার। বিসিবি দিয়ে আসলে সুপরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব নয়, তারা সুপরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হবে। ক্রিকেট অধিদপ্তর হবে ক্রিকেট সম্পর্কিত সকল গবেষণা ও অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকেই ক্রিকেট খেলোয়াড়, ক্রিকেট কোচ, ক্রিকেট সাংবাদিক, ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার, ক্রিকেট ফিজিও, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ, ক্রিকেট পিচ্ বিশারদ এসব তৈরি করতে হবে। তবেই এদেশের ক্রিকেট এগিয়ে চলার একটা মহাসড়ক পাবে। ক্রিকেটের জয় হোক, টিম টাইগারের গর্জনে সারাবিশ্ব মুগ্ধ হয়ে উঠুক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়