প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৩
খেলার মাঠে বিপিএল
সারা বছর মাতিয়ে রাখা খেলাগুলোর মধ্যে পাক-ভারত উপমহাদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট বিকল্পহীন। বাংলাদেশের দর্শক, বিশেষ করে তরুণ সমাজ ও ছাত্রসমাজের কাছে ক্রিকেটের উন্মাদনা বর্ণনাতীত। সেই উন্মাদনার আঁচে এবার ঘি পড়েছে পনেরতম বিপিএলের আসরে। আশৈশব ক্রিকেট আমার আকর্ষণের মধ্যবিন্দু হলেও পেশাগত জীবনে এসে ব্যস্ততার কারণে এবং অতি ঘন ঘন ক্রিকেটের মজমা জমার কারণে কখনও কখনও দুয়েকটা ম্যাচ বাদ পড়তে পড়তে এক সময় সেই আকর্ষণে ভাটা পড়ে যায়। ঊনিশশো আটাত্তর সালে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে রকিবুল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এবং আসিফ ইকবালের নেতৃত্বে পাকিস্তান দলের তিনদিনের ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা দিয়েই আমার সরাসরি আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখা শুরু। যদিও খেলাটি তখন সম্পূর্ণ হতে পারেনি, পণ্ড হয়ে যায়। কারণ বাংলাদেশ দলকে পাকিস্তান ক্রিকেট দল নমস্তে বলে কুশল বিনিময়ের সূচনা করেছিলো। এটা যে চক্রান্ত করে অভদ্রতা ছিলো তা দর্শকদের আর জানার বাকি ছিলো না। দর্শকরাতো বীর বাঙালি। একাত্তরের স্মৃতি তখনও টগবগে। তাই সবাই নেমে পড়লো নতুন করে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। মারমুখো দর্শকের ভয়ে খেলা তখন পণ্ড। পাকিস্তানিরা দ্বিতীয়বারের মতো বুঝে নিলো বাঙালিদের বিক্রমের তেজ। সেই মাঠেই খেলা দেখেছিলাম এমসিসি এবং বাংলাদেশের তিনদিনের একটা ম্যাচের। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়ক রকিবুল হাসানের আটাত্তর রান এখনও চোখে ভাসে। এশিয়া কাপের একটা ম্যাচ ছিলো বাংলাদেশ বনাম ভারতের। সেই প্রথম নভোজ্যোৎ সিং সিধু, সুনীল মনোহর গাভাস্কার এবং কপিল দেবদের মতো বিশ্বমাতানো ক্রিকেটারদের কাছে থেকে দেখা। মাঠে দর্শক মাতাতে ফিল্ডিংয়ে থাকা কপিল দেব মাঝে মাঝে কোমর দুলিয়ে নৃত্যমুদ্রা দেখিয়েছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম, কপিলজী একজন খুব আমুদে মানুষ। লেখার শুরুতে এই গৌরচন্দ্রিকা এজন্যে যে, বহু বছর পরে আবারও খেলার মাঠে গিয়ে টিকেট কেটে সরাসরি ক্রিকেট খেলা দেখলাম।
আমার ছোট ছেলে প্রখরের মধ্যে ক্রীড়ার প্রতি অনুরাগ প্রবল। শুধু খেলার জন্যেই সে তার স্কুল কামাই দিতে চাইতো না কখনও। যখন স্কুলের মাঠে কোনো সহপাঠীকে পাওয়া না যেতো, তখনও সে একা একাই খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতলকে বল জ্ঞান করে ফুটবল খেলতো একমনে। টেলিভিশন ধারাভাষ্যকারদের বদৌলতে এখন ক্রিকেট তার নখদর্পণে। তারই আগ্রহে মূলত গত তেইশে জানুয়ারি দুহাজার পঁচিশ সালে আমরা বাপেপুতে দুজনে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গেলাম খেলা দেখতে। মাঠে আমাদের সাথে যোগ দেয় বীকনের দোলন মিয়া। টিকেট আগে থেকেই কিনে রেখেছিলো দোলন।
এই প্রথম দেখলাম বিপিএলের টিকেটও কালোবাজারি হতে। ব্যাংকে যে টিকেট পনের শতাংশ ভ্যাটসহ দুশো ত্রিশ টাকা, সেটাই কালোবাজারির কাছে পাঁচশো তিরিশ টাকা। আসলে বাঙালির আলস্য এবং হুজুগই মূলত কালোবাজারিদের উস্কে দেয় বেশি। কারণ খেলা দেখে বের হওয়ার পর জানতে পারলাম, ব্যাংকে এই টিকেটের লাইন বেশি বড় ছিলো না।
খেলা মাঠে খেলা দেখতে গেলে আমি সবসময় গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে পছন্দ করি। কারণ খেলার মজা শুধু মাঠে নয়, গ্যালারিতেও। গ্যালারির টুকিটাকি অনেক বেশি উপভোগ্য এবং অনেক প্রাণবন্ত। একেকজন দর্শকের একেকটা হাসির মন্তব্য প্রাণে অফুরান আনন্দের খোরাক এনে দেয়। যে খেলাটা আমরা দেখতে গেলাম তা ছিলো বিপিএলের একত্রিশতম ম্যাচ। দুর্বার রাজশাহী বনাম রংপুর রাইডার্স। ইতোমধ্যেই রংপুর রাইডার্স পরবর্তী পর্বে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দুর্বার রাজশাহী অবশ্য আর্থিক সংকটে পড়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিছুটা দুর্বলই আছে বলা যায়।
আম্পায়ার মাসুদুর রহমান এবং তানভীর আহমেদের পরিচালনায় খেলাটি শুরুর আগে আতাহার আলী খানের নেতৃত্বে হয়ে গেলো টস পর্ব। এতে টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় রংপুর রাইডার্সের দলনেতা সোহান। প্রতিপক্ষের দলনেতা তাসকিনকে বাধ্য হয়েই বল হাতে মাঠে নামতে হয়। মাঘের শীতে দুপুর দেড়টায় খেলা দেখতে গিয়ে বাসা থেকে বের হলাম ঠিক বারোটায়। মাঠে গিয়ে পৌঁছি সাড়ে বারোটা নাগাদ। দোলন টিকেট আনার পরে দেখলাম, আমাদের প্রবেশপথ চার নাম্বার গেট দিয়ে। উপস্থিত ভলান্টিয়ারদের একজন বললেন, একটা অটো নিয়ে চলে যান, ওই গেটটা দূর আছে। ভাগ্যিস এ পরামর্শটা সময়মত পেয়েছিলাম। তা না হলে হাঁটার দুর্ভোগ পোহাতে হতো নিদারুণ। জনপ্রতি কুড়ি টাকায় অটোতে উঠে চার নাম্বার গেটে পৌঁছাতে প্রায় দশ মিনিট সময় লাগলো। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে এই প্রথম আমার পদার্পণ। চারদিক থেকে মাঠটাকে দেখে মনে হলো, এখনও দর্শকদের জন্যে অনেক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি আছে। নারী দর্শকদের জন্যে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন যথেষ্ট ওয়াশরুমেরও ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। বর্ষায় প্রবেশদ্বারগুলোতে যেতে হলে কাদা মাড়াতেই হবে। খাবারের দোকানও সে রকমভাবে তৈরি হয়নি। আসলে শহর থেকে দূরে হওয়ায় ম্যাচ না থাকলে মাঠপাড়া ঝিমিয়েই থাকে বলে মনে হলো। তাই স্থায়ী খাবারের দোকান তেমন গড়ে উঠেনি। মূল গেটের উল্টোদিকে টিকেট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বেশি। দোলনের জন্যে মিনিট দশেক আমরা অপেক্ষা করেছিলাম মূল গেটের রাস্তার ঐপারে। এরই মধ্যে প্রায় জনা পাঁচেক টিকেট কালো বাজারি এসে জিজ্ঞেস করে গেছে, মামা টিকেট লাগবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে গিয়েই টের পেলাম, আশেপাশে কোনো চা খাওয়ার দোকান নেই, টংয়ের দোকান ছাড়া। তাও তাতে বসার ব্যবস্থা নেই, হোটেল ইটালিয়া বা ছালাদিয়ার মতোই হোটেল দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া।
শীতের কোমল রোদ গায়ে মেখে গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছি। খেলা দেখছে প্রখর। আমি কি আর খেলা দেখি! আমি দেখছি গ্যালারি শো। একেকজন একেক ভঙ্গিমা নিয়ে সেলফি তুলছে, টিকটক করছে এবং ক্যামেরা আকর্ষণের জন্যে ফন্দিফিকির করছে। ইলেকট্রনিক স্কোর বোর্ড এবং টেলিভিশন স্ক্রিনে চোখ সবার, কখন কাকে দেখায়! মাঝে মাঝে প্রেমিক যুগলের আগমন এটাও মনে করিয়ে দিলো, খেলার মাঠ প্রেমের এক আদর্শ জায়গাও বটে। মাঠের সীমানা ঘেঁষে কাঁটাতারের ওপারে কাউকে দেখলে দর্শক চিৎকার করে উঠছে। তাদের চিৎকার থেকে বুঝা যায়, এরা সেলেব্রিটি ইউটিউবার। আজকাল ইউটিউবারদের কদর বেশি। একদিকে যেমন মনিটাইজেশন, তেমনি অন্যদিকে তাদের ফ্যানফলোয়ারও বেশি। মাঝখানে কাঁটাতার রেখে দর্শকেরা তাদের প্রিয় তারকার সাথে সেলফিও তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার শ্রীমানও গিয়ে কোন্ ফাঁকে একজনকে সেলফিতে বন্দি করে আনলো। আমি এদের কাউকে চিনিই না। চিনবো কোত্থেকে! আমি তো এদের জগতের বাইরের লোক।
দুর্বার রাজশাহী ব্যাটিংয়ে গিয়ে কুড়ি ওভারের নির্ধারিত সীমায় একশো সত্তর রান তুলে নিলো। ইয়াসির আলির ষাট রানের বদৌলতে এ সংগ্রহকে স্বাস্থ্যবানই বলা যায়। রংপুর রাইডার্স বোলিংয়ের সূচনা করায় স্পিনার এবং মিডিয়াম পেসার দিয়ে। এ সময় পাওয়ার প্লে ছিলো বলেই হয়তো এ কৌশল। শুরুতেই যে হারে মারকাট চলছিলো, তাতে মনে হচ্ছিলো রান দুশো পার হয়ে কুড়ি-তিরিশে গিয়ে ঠেকবে। কিন্তু কখন যে রাশ টানা হলো টের পেলাম না। রান একশো সত্তরেই আটকে গেলো। মনে করেছিলাম রংপুর রাইডার্স এ রানকে টপকে যাবে সহজেই। কিন্তু শুরুর ওভারেই একটা উইকেট হারানোয় রংপুর রাইডার্স নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে এবং একসময় ঊনিশ ওভার দুই বলে সবাই আউট হয়ে যায়। রায়ান বার্ল চার উইকেট নেওয়ায় একশো ছেচল্লিশ রানেই মুখ থুবড়ে পড়ে রংপুর রাইডার্স। খেলার মাঝে মাঝে ' ডানা ছত্রিশ মাস্কটটি এসে দর্শকদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করে। তবে এ ধরনের কোনো পাখি আমি বাংলাদেশে দেখিনি। আমাদের সাথে থাকা দোলনের বাড়ি গাইবান্ধায়, তাই সে সঙ্গত কারণেই চাইছিলো যাতে রংপুর জিতে। কিন্তু খেলাশেষে তার মুখে আঁধারের প্রতিচ্ছবি আমাকেও ম্লান করে দেয়। সে চাইছিলো, সন্ধ্যার ফ্লাড লাইটে পরের খেলাটিও দেখতে। কিন্তু আমাদের কাজ থাকায় আর দেখা হলো না। একটা খেলা শেষেই আমাদের বিপিএল দেখা সাঙ্গ হলো। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে দেখতে মনে হলো, এই বিপুল তারুণ্যের শক্তিকে যদি নিখাদ দেশপ্রেমের গঠনমূলক কাজে লাগানো যায়, তবে আমরাই একদিন আকাশ হয়ে যাবো মানব সভ্যতায়। কিন্তু সে শক্তির মধ্যে বিভেদ বা স্বার্থের ব্যবহার আমাদের পিছিয়ে নিতে পারে শতাব্দী।