প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৮
অস্থির সময়ের অস্থির ক্রিকেট
মহান একাত্তর বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশকে স্থান করে দিয়েছিলো অতুলনীয় গৌরবের বরমাল্য দিয়ে। সেই গৌরবকে বিশ্বের অসংখ্য মানুষের মনে বিবর্ধিত করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তাতে যেমন অবদান আছে সালমাদের নারী ক্রিকেট দলের, তেমনি অবদান আছে সাকিবদের পুরুষ ক্রিকেট দলেরও। আরও স্পষ্ট করে বলতে হয়, গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেট মহারথীকে পেছনে ফেলে অলরাউন্ডারের সেরা স্থানটি ধরে রেখেছেন বাংলাদেশের বাঁ হাতি জিনিয়াস সাকিব আল হাসান। ব্যাটিং-বোলিংয়ে সাকিব নিজের দক্ষতার ঝলক দেখিয়ে মাঠ ও মাঠের বাইরে বাংলাদেশকে আলোচনায় রেখেছেন সাকিব। হেমন্ত বা শীতের নয়, প্রেম হতে পাওয়া মানবী শিশিরকে জীবনের সাথে জড়িয়ে সাকিব মার্কিন মুল্লুকের নাগরিক হয়েছেন আগেই। তারপরও দেশকে তিনি মাতিয়ে রেখেছেন ক্রিকেটীয় দক্ষতা দিয়ে।
|আরো খবর
সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত খেলোয়াড়কে পেয়েও বাংলাদেশের ক্রিকেট অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের অস্থিরতায় পথ হারাতে বসেছে। সাকিবের খেলোয়াড় পরিচয়কে ছাপিয়ে অনেকের কাছে তার রাজনৈতিক পরিচয়টা বড়ো হওয়ার কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা মেনে নিতে হলো। ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই সাকিবকে ছেড়ে যেতে হলো প্রাণের ক্রিকেট আর এই চাপান উতোরে ভুগে বাংলাদেশের ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে তুলোধুনো হতে হলো। একুশে অক্টোবর হতে শুরু হওয়া পাঁচদিনের প্রথম টেস্ট অকালে শেষ হয়ে গেলো চারদিনের মধ্যেই। প্রথম ইনিংসে মাত্র একশ ছয় রান করে অল আউট হওয়া বাংলাদেশ ইনিংস হারের শঙ্কা জাগিয়ে শেষমেষ সাত উইকেট পরাজয় বরণ করে ছেড়ে দে মা কেঁদে বেঁচেছে। ব্যাটিং-বোলিং উভয় সেক্টরে চরম ব্যর্থ হওয়া বাংলাদেশকে মাশুল দিতে হয়েছে টেস্ট শুরুর আগে চলমান রাজনীতির মনস্তাত্ত্বিক চাপের কুফলের জন্যে।
এমনিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেট দীর্ঘদিন ধরে কোচ নিয়ে গেঁয়ো রাজনীতির শিকার হয়ে ছিলো, তার ওপর সিনিয়র খেলোয়াড়দের বলয়ভিত্তিক রাজনীতি ও ইগো আমাদের ক্রিকেটীয় অগ্রগতির সকল সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দিয়েছিলো। পাপনের ব্যর্থ নেতৃত্ব ও হাথুরাসিং সংকট টক অব দ্য কান্ট্রি হয়ে উঠার পর পাঁচ আগস্টের দৃশ্যান্তর আমাদের সামনে নতুন এক আত্মহননকে উপস্থাপন করলো যার নাম সাকিব-সংকট। সাকিবকে বলি দিয়ে আমরা ইনিংস পরাজয় রোধ করলেও আমাদের সামনে এখন ঝুলছে আরেকটি বড়ো খড়গ, আর তা হলো আইসিসির নিষেধাজ্ঞার চোখ রাঙানি। রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় না রেখে বাঙালি সব সময় তাকে টেনে এনেছে বেডরুমের একান্ত জগতের মধ্যেও। ফলে সরকার বদল হলে বদলে যায় তামাম খোল নলচে আর তারই কুপ্রভাব পড়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে অঙ্গে। এরকম কুপ্রভাবের শিকার আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট। অথচ তেন্ডুলকারদের মতো বিশ্ববন্দিত ক্রিকেট অবতারদের কাছে সাকিবই একমাত্র বাংলাদেশী, যে বিশ্ব শাসন করতে পারে তার ক্রিকেটীয় দক্ষতায়। হাথুরাসিংকে সরিয়ে সিমন্সকে আনা হয়েছে বটে, জিইয়ে রাখা হয়েছে সাকিব সংকট।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড়ো শত্রু যেমন রাজনীতি, তেমনি বর্তমানে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড়ো আইকন হলো সাকিব। এই সংকট জন্ম দিয়েছে সাকিবিয়ান নামে এক গোষ্ঠীকে। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে আরেক গ্রুপ, যাদের কাজই হলো সাকিবিয়ানদের মেরে মাথা ফাটানো। অর্থাৎ ঠেকানো। ক্রিকেটকে এখন এগিয়ে নেওয়ার চেয়ে সংস্কারের নামে পঙ্গু করে তোলা হচ্ছে অধিক। ফলে সংকট সংকটই থেকে যাচ্ছে, কিন্তু সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব-মাশরাফি-তামিম-মুশফিক-রিয়াদদের ভক্ত সংখ্যা অধিক। কাজেই কিছু করতে গেলে তার প্রভাব নিয়ে চিন্তা মাথায় রাখতেই হয়। ক্রিকেটারদের মূল কাজ হলো মাঠে। তাদের নিয়ে টেবিলে কোনো ষড়যন্ত্র না পাকানোই উত্তম। কেননা, দিনশেষে পরিসংখ্যান ক্রিকেটের কথাই বলবে। বিগত হওয়ার গন্ধ শুঁকতে গিয়ে নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। কল্যাণ নিহিত আছে প্রাজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে।
ক্রিকেট কখনো পড়ে যায় সাম্প্রদায়িক সমালোচনায়, কখনো পড়ে যায় সাকিব সংকটে আবার কখনো পাপন-তামিম হয়ে উঠে ক্রিকেটের যদি-কিন্তুর মতো বিঘ্ন। এসবকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে, সর্বদা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হতে ক্রিকেটকে পরিচালনা করতে হবে। বিকেএসপিকে যেমন ক্রিকেটার বানানোর কারখানায় পরিণত করতে হবে, তেমনি নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট কিংবা দামাল সামার ক্রিকেটকে পুনর্জাগ্রত করতে হবে। আমরা ক্রিকেট মাঠে ধর্ম ও রাজনীতিকে নিয়ে গেলেও মনের গভীরে ক্রিকেটকে ধ্যানজ্ঞান করতে পারিনি। ফলে উদ্বোধনের ফিতা কাটার জন্যে দলের খেলা উপেক্ষা যেমন অবলীলায় করি, তেমনি হাজার মাইল দূরে থাকলেও নির্দোষ মানুষকে খুনি বানিয়ে দিই। দিনশেষে ক্রিকেটই ভুক্তভোগী হয়।
অস্থির রাজনীতির জগত পার হয়ে আমরা যদি খেলোয়াড়দের দিকে মনোনিবেশ করি, তবে তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে, তাদের মধ্যে কমিটমেন্টের ঘাটতিটাই প্রধান। আর এ কারণেই কোনো খেলোয়াড়ের ধারাবাহিকতা দেখা যায় না। এক ইনিংসে ভালো করলে তাদের তুষ্টিতে পেয়ে বসে এবং ক্রীড়া সাংবাদিকদের স্তুতিতে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে। ফলে নিবিড় মনোযোগে ঘাটতি হয়। মনোযোগ কেড়ে নেয় খেলা বহির্ভূত বিষয়গুলো, যাতে অর্থ আর শোবিজের ছড়াছড়ি থাকে। দক্ষতার চেয়ে আমাদের খেলোয়াড়দের শারীরিক সামর্থ্যে ঘাটতি থাকে বেশি। ফলে দক্ষতার সঠিক প্রয়োগ মাঠে হয় না। যদি খেলোয়াড়দের মনোজগত পেশাদারি না হয়, তাহলে কোচিং স্টাফ কিংবা ম্যানেজার পাল্টে কোনো লাভ হবে না। কারণ খেলাটা মাঠে খেলোয়াড়দেরকেই খেলতে হয়। এখনও দেখা যায়, আমাদের সিনিয়র খেলোয়াড়দের অনেকেই গ্যালারি শো করতে গিয়ে দলের প্রয়োজন ভুলে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে আমরা যেমন একশ ছয় রানে অল আউট হয়েছি, তেমনি আমরা স্কোর না করতে পারলেও ক্রিজে কীভাবে আঁকড়ে পড়ে থাকতে হয় তা ভুলে গেছি। সব খেলায় জিততে হবে কথা নেই। কিন্তু মর্যাদাপূর্ণ হারের মধ্যেও সুখ আছে, সান্ত্বনা আছে। আমরা লজ্জায় কুঁকড়ে যাই যখন টেস্টে প্রতিপক্ষ মাত্র বাইশ ওভারে একশ ছয় রান তুলে আমাদের সাত উইকেট হাতে রেখে ঘরে পাঠিয়ে দেয়।
আমাদের পেস বোলিং মোকাবেলায় ঘাটতি প্রকট। কারণ বিশ্বমানের পেস বোলার আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে আমাদের ব্যাটসম্যানদের ধুঁকতে হয়। বল মোকাবেলায় মেরিট যাচাইয়ে আমাদের খেলোয়াড়দের ঘাটতি লক্ষণীয়। ছাড়ার বল মারলে কিংবা মারার বল ছাড়লে আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয় আসবেই না। আমাদের ড্রেসিং রুমের রাজনীতি পরিহার করা উচিত। পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ও ইগো সমস্যাকে খেলোয়াড়দের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পুরো দলকে একটা পরিবার বানাতে না পারলে আমরা আলোর দেখা পাবো না, আঁধারেই রয়ে যাবো।
দেশজুড়ে চলমান অস্থিরতার ঢেউ ক্রিকেট মাঠে যাতে না আসে সেজন্যে প্রশাসনকে যত্নশীল হতে হবে। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জের ধরে সেরা খেলোয়াড়দেরকে অকারণ হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে বাইরে রেখে দেশের কোনো লাভ হবে না। বরং ভবিষ্যতে কোনো খেলোয়াড় যাতে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ না করে ক্ষমতার রাজনীতিতে না জড়ায় সে বিষয়টা শক্তভাবে বিবেচনা করতে হবে। খেলোয়াড় কোনো দলের নয়, খেলোয়াড়েরা দেশের সম্পদ। তাদের নষ্ট করা যাবে না, তাদের কোনো দলীয় তকমা লাগানো যাবে না। ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধনের জন্যে ক্রিকেটকে স্তরবিন্যাস করে বছরব্যাপী প্রশিক্ষণে রাখতে হবে। অস্থির ক্রিকেটকে সুস্থির করতে না পারলে আমাদের মাঠ জয় করা দুরূহ হয়ে পড়বে। এমনিতেই আমাদের বদনাম আছে, টেস্ট স্ট্যাটাস আমরা নাকি মাঠের খেলায় নয়, টেবিলের জাদুতে পেয়েছি। এ বদনাম আমাদের ঘোচাতেই হবে।