রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ফুটপাত থেকে ফুটবল বিশ্বের রাজপথে রোনালদো

ফুটপাত থেকে ফুটবল বিশ্বের রাজপথে রোনালদো
চৌধুরী ইয়াসিন ইকরাম ॥

নাম্বার ৭ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি রয়েছে তার। তার খেলা মানেই বিপক্ষ দলের জালে বল জড়িয়ে দেয়া। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতাটা যে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য আরাধ্য। অনেক অখ্যাত খেলোয়াড় আছেন যারা দেশকে আন্তর্জাতিক শিরোপার গৌরব এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন, পেরেছেন সোনালি ট্রফিতে চুমু আঁকতে। আবার অনেক তারকা খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার জন্য হাহাকার করতে করতে। একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার হাহাকার দেখা গেছে ডি স্টেফানোর মতো ফুটবলারের মধ্যে। জর্জ বেস্ট, ইউসেবিও, লুইস ফিগোদেরও। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সেই সৌভাগ্য হয়েছে। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতার সৌভাগ্য হয়েছে তার। তারপরেও একটা হাহাকার থেকেই যায়। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপের শিরোপা যে এখনো অধরায় রয়ে গেল তার। নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, তারপরেও ব্যর্থ হয়েছেন দলকে সাফল্য এনে দিতে। জন্ম হয়েছিল তার পর্তুগালের মতো দেশে, যেখানকার সমর্থকরাই বিশ্বকাপ জয়ের আশা করে না হয়তো। তাদের কাছে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়াটাই বড় অর্জন বলা যায়।

তার চলার পথটা কখনোই মসৃণ ছিল না। জন্মেছিলেন মাদেইরার এক দরিদ্র পরিবারে, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অ্যাবোরশন করিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু তার মায়ের দ্বিমতের কারণে সেই যাত্রায় বেঁচে যান সিআরসেভেন। অবশ্য ফুটবলে তার হাতেখড়ি ছিল বাবার হাত ধরেই। বাবাই তাকে সবসময় উৎসাহ দিতেন। রাস্তায় ফুটবল খেলে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতেন। এ সময় তার বাবা তাকে এফসি এন্ডোরিনহোর যুবদলে ভর্তি করে দিলেন। এরপর থেকে তার পুরো জীবনটাই পরিবর্তন হয়ে গেলো। সারাক্ষণ শুধু ফুটবল নিয়েই মেতে থাকতেন, কিন্তু দিনশেষে রাতে যখন ঘরে ফিরতেন তখন মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে সেই খুশিটা হারিয়ে যেতো। তার বাবা উৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন, করতেন পরিবারের অন্য সদস্যদের, কিন্তু তাতেও কাজ হতো না। পেটে খাবার জোগাড় করার জন্য যাদের সারা দিন বাইরে পরিশ্রম করা লাগে, পরদিন কাজ না করলে যেই ঘরে খাবার আসবে না, সেখানে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি আসলে এক রকমের বিলাসিতা বলা যায়।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? প্রতিদিনই রোনালদো যতক্ষণ মাঠে থাকতেন ততক্ষণ সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে তার বাবা উৎসাহ দিতেন এবং দিনশেষে ঘরে এসে তার মা-বোনদের উৎসাহিত করতেন খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য। একসময় তার মা-বোন ও তার বাবার সঙ্গে খেলা দেখতে যায় ছোট্ট রনের। সেদিনটা ছিল তার জন্য অন্যরকম। গ্যালারিতে বসে বাবা-মা, বোন হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে অন্যদিকে ক্রিস্টিয়ানো বল নিয়ে ছুটছে। এর চাইতে মধুর দৃশ্য আর কী হতে পারে!

এরপর স্পোর্টিং সিপিতে যোগ দিলেন। সেখান থেকে ইউনাইটেডে এবং ইউনাইটেড থেকে বিশ্বসেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। প্রতিটা ক্ষেত্রে পেয়েছেন সফলতা। অর্জনের ঝুলিপূর্ণ রয়েছে ব্যক্তিগত ও দলগত সাফল্যে। কিন্তু এত কিছুর পরেও তার ক্যারিয়ারে অপূর্ণতা ছিল একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার। যেই শিরোপার জন্য হতাশ হয়ে লিও মেসি বলেছিলেন আমার সবগুলো ব্যালন ডি’অর ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যদি দলকে বিশ্বকাপ জেতানোর গৌরব অর্জন করতে পারতাম তাহলে আমি সেটাই চাইতাম।

আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের লক্ষে তরুণ রোনালদোর প্রথম মিশন ছিল ২০০৪ ইউরোতে। সেবার পর্তুগাল ফাইনালে চলে গিয়েছিল। তরুণ রোনালদো সেদিন পারেননি দলকে জেতাতে। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করলেও ফাইনালেই খেই হারিয়ে ফেলল পর্তুগাল, যার জন্য জলাঞ্জলি দিতে হলো প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা ঘরে তোলার স্বপ্ন। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ঘিরে ধরেছিল সেই তরুণ ছেলেটাকেও। একটা তরুণ ছেলে যে কি না পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করে দলের হয়ে শিরোপা জয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে হেরে গিয়ে কাঁদছে। সেদিনের সেই ছেলেটার কান্না কেড়ে নিয়েছিল হাজারো ফুটবল প্রেমিকদের মন। একই সঙ্গে ফুটবল বিশ্ব পেয়েছিল নতুন একজন তারকার আগমনী বার্তা।

এর পরের মিশনটা ছিল ২০০৬ বিশ্বকাপ। ফিগো, কস্তা, ডেকো, রোনালদোদের ওপর ভরসা করেই আরও একবার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখে তারা। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের মতো দলগুলোকে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় তার পর্তুগাল, কিন্তু ভাগ্যবিধাতা এবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আরও একবার স্বপ্নভঙ্গ! এবারও জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে ফাইনাল থেকে নিঃশ্বাস দূরত্বে থেকেই বিদায় নিল পর্তুগাল। একই সঙ্গে শিরোপা না জেতার আক্ষেপ নিয়েই অবসান হলো পর্তুগালের সোনালি প্রজন্মের। এরপরের প্রজন্মের ভার পড়ল ক্রিস্টিয়ানোর কাঁধে। এরপরের গল্পটা তার একা লড়ে যাওয়ার। একা বলার কারণ, পর্তুগালের সোনালি প্রজন্মের কেউ আসেনি যে নির্ভরতা দেবে তাকে। সাধারণ খেলোয়াড়দের নিয়েই লড়াই করতে হয়েছে তাকে। ফিগো, কস্তা, ডেকোদের রিপ্লেসমেন্ট এখনো পায়নি তারা। লড়াই করতে হচ্ছে এক রোনালদোর ওপর ভরসা করে। যখনই দলটা বিপদে পড়ে তখন পুরো দল চেয়ে থাকে তার পায়ের দিকেই। তাদের সব ভরসা যে ওই একজনই। কিন্তু একা আর কত! দু-একটা ম্যাচে অতিমানবীয় পারফর্ম করে জেতানো যায়, কিন্তু একটা টুর্নামেন্ট জিততে হলে দল হিসেবে ভালো পারফর্ম করার বিকল্প নেই। পর্তুগালের দুর্বলতা এখানেই।

যাই হোক, এরপরও লড়াই চালিয়ে গেলেন। পরবর্তী মিশন ছিল ২০০৮ ইউরো। গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে কোয়ার্টার পর্যন্ত যেতে পারলেও জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় পর্তুগালকে। এরপর আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১০ বিশ্বকাপেও একই পরিণতি। গ্রুপ পর্ব পেরোলেও নকআউট পর্বে স্পেন বাধায় হেরে যায় তারা। ডেভিড ভিয়ার একমাত্র গোলে জয় পায় স্পেন। সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ গোলকিপার ইকার ক্যাসিয়াস রুদ্রমূর্তি ধারণ না করলে হয়তো জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ার সৌভাগ্য হতো পর্তুগালের। শেষ পর্যন্ত স্পেন বিশ্বকাপ জয় করে এবং ক্যাসিয়াস হন সেবারের বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক।

ইউরো ২০১২ তে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই জার্মানির কাছে হেরে বসে পর্তুগাল। পরের ম্যাচে পেপে, পস্তিগা, ভারেলাদের গোলে কোনোমতে ৩-২ গোলের জয় পায় ডেনমার্কের বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে জেতাতে সাহায্য করেন রোনালদো। কোয়ার্টার ফাইনালে চেকদের বিপক্ষে ৭৯ মিনিটে দলের হয়ে একমাত্র গোল করে সেমিফাইনালে তোলেন পর্তুগালকে। সেমিফাইনালে নির্ধারিত সময়ের খেলা ০-০ থাকলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে মুটিনহো, আলভেসরা পেনাল্টি মিস করলে আবারও সেমি-ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ার যন্ত্রণা সইতে হয় রোনালদোকে। ম্যাচটাতে পেনাল্টি নেওয়ার সুযোগ পাননি তিনি।

২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরোতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তার দলকে। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের কাছে জিতলে প্লে অফ নিশ্চিত হবে এমন ম্যাচে ৬০ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিল পর্তুগাল। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলে প্লে অফের টিকিট এনে দিলেন। কী করেছিলেন রোনালদো? ১৫ মিনিটের ব্যবধানে ৩ গোল করে দলকে ৪-২ গোলের অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছিলেন। হেড থেকে জোড়া গোল এবং ফ্রি কিক থেকে এক গোল করেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাট্রিকটাও পেয়ে যান এই ম্যাচেই। প্লে অফে ইব্রার সুইডেনের মুখোমুখি রোনালদোর পর্তুগাল। প্রথম লেগে ১ গোল এবং দ্বিতীয় লেগে তার অবিস্মরণীয় হ্যাট্রিকের সুবাদে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে পর্তুগাল। প্রথম লেগে তার শেষ মুহূর্তের একমাত্র গোলে ১-০ গোলের জয় পায় পর্তুগিজরা। দ্বিতীয় লেগের আগে ছিলেন মারাত্মক ইনজুরিতে।

ইনজুরিটা হতে পারত ক্যারিয়ারঘাতী। অনুশীলন করতে পারেননি দলের সঙ্গে। এরপরও ম্যাচটা খেললেন। দল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কা নিয়ে লড়াই করবে আর তিনি গ্যালারিতে বসে দেখবেন! রোনালদো এটা করতে চাননি। ম্যাচটা খেললেন, হ্যাট্রিক করলেন এবং সর্বোপরি বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করলেন দলের। প্লে অফে দলের ৪ গোলের সবকটিই আসে রোনালদোর পা থেকে। তবে ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে তার দল। প্রথম ম্যাচে জার্মানির কাছে হার, এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ড্র। তাই শেষ ম্যাচটা জিতলেও গ্রুপ পর্বের বাধা পেরোতে পারেনি পর্তুগাল। বিশ্বকাপের ইনজুরি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল তাকে। এক রকম রিস্ক নিয়েই ম্যাচগুলো খেলেছিলেন। দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নামতে হয় তাকে। তারপরেও পর্তুগাল গ্রুপ পর্বে বাদ পড়লে সমালোচকদের লক্ষ্যবস্তু ওই রোনালদো। কীভাবে ইনজুরি নিয়েও দলকে কোয়ালিফাই করালেন সেটা তারা মনে রাখেনি কিংবা পেইন কিলার নিয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন সেটাও তারা মনে রাখেনি। একের পর এক সমালোচনায় জর্জরিত করা হলো তাকে। বিশ্বকাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইনজুরিতে ছিলেন, তারপরেও খেলেছেন। এ রকম মুহূর্তে ইনজুরির কারণে তার ভেতর দিয়ে কী যাচ্ছিল সেটা একমাত্র রোনালদোই জানেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াই করে আসা রোনালদো হার মানবেন কেন! হার মানতে নয়, সব প্রতিকূলতাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বিজয়ের গৌরব ছিনিয়ে আনতে, নিজেকে বিশ্ব সেরাদের কাতারে অধিষ্ঠিত করতেই তার জন্ম হয়ে ছিল।

তাইতো আরও একবার স্বপ্ন দেখলেন আন্তর্জাতিক শিরোপার। এবারের মিশনটা ছিল ইউরো ২০১৬। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ন্যানির একমাত্র গোলে ১-১ গোলে ড্র করে পর্তুগাল। দ্বিতীয় ম্যাচেও ড্র করে বসে পর্তুগাল। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটাতে ড্র করলে গ্রুপ পর্বে তৃতীয় হয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পর্তুগালের সামনে। ১৯ মিনিটেই প্রথম গোল করে বসে হাঙ্গেরি। এরপর ৪২ মিনিটে ন্যানির সমতা ফেরানো গোলটিতে দৃষ্টিনন্দন অ্যাসিস্ট করেন রোনালদো। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আবার এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। কিছুক্ষণ পরই অসাধারণ ব্যাকহিল থেকে ম্যাচে সমতা আনেন। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে আরও একবার এগিয়ে যায় হাঙ্গেরিয়ানরা। এবারও গোল শোধ করতে দেরি করেননি রোনালদো। ৬২ মিনিটে হেডে গোল করে ম্যাচে সমতা আনেন। এরপর আর কোনো দল গোল করতে না পারলে ৩-৩ ব্যবধানেই শেষ হয় ম্যাচটি। গ্রুপ পর্বে তৃতীয় হলেও গোল ব্যবধানে এগিয়ে থাকার ফলে পরের রাউন্ডে যায় পর্তুগাল। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে রোনালদোর শট বারে লেগে ফিরে আসলে সেখান থেকে রিবাউন্ডে কারেজমার একমাত্র গোলে কোয়ার্টারে ওঠে তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে পোল্যান্ডকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে পর্তুগাল। সেমিফাইনালে বেলের ওয়েলসের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় পায় তারা। ৫০ মিনিটে হেড থেকে দলের প্রথম গোলটি করেন তিনি। কিছুক্ষণ পরই দ্বিতীয় গোলটি করেন ন্যানি।

সেমিফাইনালে জার্মানিকে হারানো স্বাগতিক ফ্রান্সের মুখোমুখি হয় পর্তুগাল। ম্যাচের শুরু থেকেই একের পর এক আক্রমণে ফ্রান্স কোণঠাসা করে রাখে পর্তুগালকে। কিছুক্ষণ পরই পায়েতের ট্যাকলে ইনজুরিতে পড়েন। প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন খেলা চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু কাউন্টার অ্যাটাকে বল পেয়ে না দৌড়ে বরং বসে পড়লেন। পর্তুগাল সমর্থকদের হৃদয় এক অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তখন। শেষপর্যন্ত সেই শঙ্কাই সত্যি হলো। স্ট্রেচারে করে কান্নাভেজা চোখে মাঠ ছাড়লেন রোনালদো। সতীর্থরা তার বিদায়ে ভেঙে না পড়ে বরং তার জন্য জেতার লক্ষ্যে আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ফ্রান্সের একের পর এক আক্রমণ রুখতে বারবার ন্যানির ডিফেন্সে চলে আসায় বলে দিচ্ছিল তাদের ব্যাকুলতা কতটুকু। যেই রোনালদো তাদের এত দিন ধরে এগিয়ে নিলেন, তাকে শিরোপার স্বাদ এনে দিতে ব্যাকুল ছিলেন তারা। প্রথমার্ধ শেষ, নির্ধারিত সময়ের খেলাও শেষ। কোনো দলই লক্ষ্যভেদ করতে পারছে না। শেষপর্যন্ত এডারের আচমকা শটে গোল পেয়ে যায় পর্তুগাল! রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পায় পর্তুগিজরা। ফ্রান্সকে তাদেরই মাঠে হারিয়ে বারবার তাদের কাছে হেরে বাদপড়ার মধুর প্রতিশোধ নেয় তারা। শিরোপা জয়ের আনন্দে মেতে ওঠে পর্তুগাল, মেতে ওঠেন রোনালদো।

২০০৪ ইউরোর ফাইনালে গ্রিসের কাছে হেরে শুরু। যার শেষটা ২০১৬ তে। এর মধ্যে অনেকবারই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। তার পাশে তেমন তারকা খেলোয়াড় ছিল না। এরপরও অধৈর্য হননি, লড়াই করে গিয়েছেন এসব খেলোয়াড় নিয়েই। চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্য থেকেই ভালো কিছু বের করে আনার। একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার জন্য জীবনভর অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু ফাইনালে যখন সেই শিরোপার কাছাকাছি চলে গেছেন তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাকে। বেশিক্ষণ মাঠের বাইরে থাকতে পারেননি তিনি। শিরোপা জয়ের তীব্র আকাক্সক্ষা তাকে আবারও মাঠে টেনে আনে। মাঠে নেমে তো দলকে সাহায্য করতে পারবেন না, তাই ব্যথা আক্রান্ত পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়েই কাতরাতে কাতরাতে সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে দিকনির্দেশনা দিলেন দলকে। তার মুখের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল শিরোপার জন্য কতটা ব্যাকুল হয়ে আছেন। অতিরিক্ত সময়ের আগে বিরতির সময়টাই পুরো দলকে সাহস জোগালেন। এডারকে বলেছিলেন, আমি জানি জয়সূচক গোলটা তুমিই করবে! রোনালদোর মতো একজন যদি এভাবে বলে তাহলে জয়ের স্পৃহা বেড়ে যেতে বাধ্য।

পুরো টুর্নামেন্টে বেঞ্চে বসে কাটানো এডার হয়ে গেলেন ফাইনাল জয়ের নায়ক। অখ্যাত এডার একেবারে শেষ মুহূর্তে গোল করে দলকে ১-০ গোলের জয় এনে দিলেন। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করলেন পর্তুগালের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়। হাসি ফোটালেন পুরো পর্তুগালবাসীর মুখে, হাসি ফোটালেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত পর্তুগাল সমর্থকের মুখে, হাসি ফোটালেন রোনালদোর মুখে।

পাশে তারকা খেলোয়াড় পাননি, এরপরও লড়াই করেছেন। ব্যর্থ হলেই জুটেছে সমালোচনা। কেউ দেখেনি তার পাশে কারা খেলছে, কাদের নিয়ে লড়াই করেছেন রোনালদো সেটা কেউ দেখেনি। শুধু মনে রেখেছে রোনালদো ব্যর্থ হয়েছেন দলকে জেতাতে। রোনালদো ইনজুরি নিয়ে খেলেছেন তারপরেও প্রতিপক্ষের সমালোচনা জুটেছে তার কপালে। নিন্দুকদের মুখে চপেটাঘাত করে দলকে ইউরো জেতাতে সক্ষম হয়েছেন।

ছোটবেলা থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া রোনালদো জানতেন এর চাইতেও বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাকে। তিনি নিজেকে সেভাবেই গড়েছেন। প্রতিপক্ষের সমালোচনাকে বানিয়েছেন নিজের শক্তি। ছোটবেলায় দুর্দান্ত পারফর্ম করে ঘরে ফিরেও যখন দেখতেন মা ও বোন মনমরা হয়ে বসে আছে তখনই বুঝে গিয়েছিলেন তাদের মুখে হাসি ফোটাতে হলে তাকে সেরাদের সেরা হতে হবে। সকল বাধাকে জয় করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে। নিন্দুকেরা তার সমালোচনা করলেও সেটাতে কান দেননা বরং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নিজেই দিয়ে নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চ্যালেঞ্জ। প্রমাণ করেছেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব।

হাসি ফুটিয়েছেন পরিবারের মুখে। পেয়েছেন বিশ্বজুড়ে অগণিত ভক্ত সমর্থকদের ভালোবাসা। নির্ভরতা দিয়েছেন পর্তুগালকে। একসময় গ্রুপ পর্ব পার হওয়াটাই ছিল যাদের কাছে বিরাট অর্জন, তারাও এবার বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই খেলা খেলা দেখবে। কারণ তাদের দলে আছে একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। যার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় সবই সম্ভব। ৯০ মিনিটের খেলায় অসম্ভবের কিছু নাই। আপনি ফেবারিট নাকি আন্ডারডগ সেটা বিবেচনা করা হবে না বরং ম্যাচটাইমে প্রতিপক্ষের সাথে আপনার পারফর্মেন্স নির্ধারণ করে দিবে আপনার ভাগ্য। সেক্ষেত্রে রোনালদোর মুহূর্তে দুইটা চমক বদলে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য, এনে দিতে পারে অবিশ্বাস্য জয়। ইউরোর ফাইনাল জয়ের পর রোনালদোর মুখের চওড়া হাসিটা বিশ্বকাপে আরও একবার দেখার লক্ষ্যেই টিভির সামনে বসবে অগণিত দর্শক। জানি সম্ভাবনা কম, কিন্তু দলে এমন একজন আছেন যার ওপর ভরসা করে জেতার আশা করতেই পারি। তিনি রোনালদো, ক্রিস্টিয়ানো বিশ্বসেরা রোনালদো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়