বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

কারবালার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও শিক্ষা
মুফতি মাওলানা মোঃ জাফর আলী

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম ও হৃদয় বিদারক ঘটনা কারবালার ময়দানে সংঘটিত হয়েছিল। ৬১ হিজরি সনের ১০ মুহাররম ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার ময়দানে ক্ষমতালোভী, পাপিষ্ঠ, দুশ্চরিত্র ইয়াযীদের নির্দয় সেনাবাহিনীর হাতে পিপাসার্ত অবস্থায় দোজাহানের কাণ্ডারী রহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু’র নয়নের তারা খাতুনে জান্নাত ফাতেমা (রাঃ)-এর কলিজার টুকরা, বেহেশতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইন (রাঃ) পরিবারের সদস্য ও আহলে বাইতের শুভাকাক্সক্ষীসহ ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেছেন। আল্লামা ইকবাল মন্তব্য করেছিলেন, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হার কারবালা কি বাদ, অর্থাৎ কারবালার পর ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কারবালার প্রসঙ্গ এলেই এক শ্রেণির মানুষ প্রখ্যাত সাহাবী কাতিবে ওহী হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ)কে দোষারোপ করে বানোয়াট কাহিনী রচনা করে। আবার কেউ আবেগের আতিশয্যে মাওলা আলী (রাঃ)-এর ব্যাপারে চরম বাড়াবাড়ি করে। আমরা সকল প্রকার বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ির ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত ইতিহাস জানার মানসে সে মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনা হৃদয়ে ধারণ করে প্রয়োজনীয় দীক্ষা গ্রহণ করবো।

পটভূমি : যে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পেছনে কিছু কার্যকারণ থাকে। কারবালার ঘটনা তথা ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর নির্মম শাহাদাতের পেছনেও সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। হিজরি ৬০ সনের রজব মাসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানিত সাহাবী কাতিবে ওহী হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ইন্তেকাল হয়। শর্ত সাপেক্ষে ইয়াযীদের জন্যে পূর্ব থেকেই তিনি বাইয়াত নিয়ে রাখেন। ফলে তাঁর ওফাতের পরে ইয়াযীদ পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়। ক্ষমতারোহণের পর ইয়াযীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল, হযরত ইমাম হোসাইন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর বাইয়াতের নিশ্চয়তা বিধান করা। কেননা ইয়াযীদের খলীফার স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে প্রথম থেকেই তাঁরা স্বীকার করেননি। এছাড়াও ইয়াযীদের মনে আশঙ্কা দানা বেঁধেছিল, তাঁদের কেউ আবার খেলাফত দাবি করে বসেন কি-না! কিংবা সমগ্র হেজাযবাসী তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নেয়ার আশঙ্কাও তার মনে নাড়া দিচ্ছিল। আবার ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে খলীফা বানানোর দাবিতে ইরাকে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

এ সব আশঙ্কার কারণে ইয়াযীদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল নিজ ক্ষমতার ভিত মজবুত ও নিষ্কণ্টক করা। এ কারণে সে উক্ত ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য আদায় করা জরুরি বলে মনে করে। সুতরাং সে মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে প্রথমে আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ওফাতের সংবাদ জানায় এবং সাথে সাথে বর্ণিত বুজুর্গদের পক্ষ থেকে বাইআত গ্রহণের জন্যে অত্যন্ত কঠোর নির্দেশ প্রদান করে। নির্দেশনামায় ইয়াযীদের ভাষ্য ছিল, “হোসাইন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও ইবনে যোবায়ের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে এমনভাবে পাকড়াও করো যেন বাইয়াত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি না পায়।” (ইবনে আছীর, ৪/৪)

মদীনায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ওফাতের সংবাদ পৌঁছার পূর্বে মদীনার গভর্নর ইয়াযীদের এ ফরমান পেয়ে বিচলিত হয়ে গেলেন। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাঁর নায়েব মারওয়ানের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করলেন। মারওয়ান ছিল রুঢ় প্রকৃতির। সে পরামর্শ দিল, “ওনাদের তিন জনকে ডেকে পাঠান এবং বাইয়াতের প্রস্তাব দিন। প্রস্তাব মেনে নিলে তো ভালো, নতুবা তাদেরকে পাকড়াও করে শির- েদ করুন। যদি আপনি তা না করেন, তবে অবস্থা প্রতিকূলে চলে যেতে পারে।”

পরামর্শের ভিত্তিতে গভর্নর তাঁদের তিন জনের নিকট দূত প্রেরণ করলেন। দূত এসে ইমাম হোসাইন ও আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) কে মসজিদে পেলেন। অসময়ে এমন সংবাদ (গভর্নরের কাছে যাওয়া) পেয়ে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দূরদর্শী ইমাম হোসাইন (রাঃ) বললেন, আমার মনে হয় আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ) ইন্তেকাল করেছেন। এ সংবাদ আমাদেরকে জানানো ও বাইয়াতের বিষয়েই আমরা আহূত হয়েছি। পরামর্শক্রমে কিছু যুবক নিয়ে তিনি গভর্নরের কাছে গেলেন। যুবকদের শর্ত সাপেক্ষে বাইরে অপেক্ষমান রাখলেন এই বলে যে, “আমি ডাক দিলে বা উচ্চ বাচ্য করলে তোমরা ভেতরে আসবে, নতুবা নয়। গভর্নর প্রথমে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ওফাতের সংবাদ জানিয়ে ইয়াযীদের নির্দেশ জানিয়ে দিলেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) সমবেদনা জ্ঞাপন পূর্বক বললেন, “আমার মতো এক জন লোকের পক্ষে এভাবে গোপনে বাইয়াত গ্রহণ করা শোভনীয় নয়। প্রকাশ্যে সকলের সাথে বাইয়াতের আহ্বান করলে দেখা যাবে।” (ইবনে আছীর, তাবরী)

এ কথা বলে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে চরম মর্মপীড়ায় ভুগছিলেন। এ দিকে আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রাঃ) নানা কৌশলে গভর্নরের দূতকে এড়িয়ে চলে দ্বিতীয় দিনে মক্কা মুর্কারামায় চলে গেলেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন।

ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর মক্কায় হিজরত : ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর কাছে মদীনায় অবস্থান করা নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন মনে হচ্ছিল না। মদীনার গভর্নর বার বার তাঁকে দূত মারফত আহ্বান জানাচ্ছিলেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) পরিবারের সবাইকে বললেন, প্রস্তুত হয়ে নাও আমরা মক্কায় হিজরত করবো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বুকে পাহাড়সম ব্যথা নিয়ে শৈশবের নানা স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় ভূমি বিশেষ করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়া-মহব্বতের কেন্দ্রবিন্দু মদীনা মুনাওয়ারা ছেড়ে ৬০ হিজরির ৪ শাবান পরিবার-পরিজনসহ মক্কা মুয়াজ্জমায় হিজরত করলেন। হিজরতকালে পবিত্র মুখে আল্লাহ পাকের বাণী তেলাওয়াত করছিলেন, অর্থাৎ- “তিনি ঐ (শহর) জনপদ থেকে ভীতিগ্রস্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন, এ প্রতীক্ষায় যে, না জানি কী হবে! বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে এ জালিম গোষ্ঠী থেকে নাজাত দিন।” (সূরা আল-কাসাস : ২০) দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পরিবার-পরিজনসহ মক্কায় পৌঁছে কিছুটা নিরাপত্তা বোধ করলেন।

যখন তিনি মক্কা মুর্কারামায় প্রবেশ করলেন, তখন আপাতত স্বস্তিবোধ করে কুরআনুল কারীমের আয়াত পাঠ করলেন, অর্থাৎ- “যখন তিনি ‘মাদইয়ান’-এর প্রতি মনোনিবেশ করলেন, তখন বললেন, আশা করি আমার প্রভু আমাকে সরল পথে চালিত করবেন।” (সূরা আল- কাসাস:২০)

কুফাবাসীর আমন্ত্রণ : হযরত আলী (রাঃ) খেলাফতকালে মদীনা থেকে কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। ফলে তাঁর অনুরক্তগণ সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলেও ইমাম হোসাইন (রাঃ)কে কুফায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যে মাত্র মুয়াবিয়া (রাঃ) ইন্তেকাল করলেন এবং ইমাম হোসাইন, আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে ইয়াযীদের বাইয়াত অস্বীকার করার সংবাদ কুফাবাসী জানতে পারল, তখন কুফার সকল ভক্ত সুলাইমান ইবনে ছারদ আল খোযায়ীর ঘরে একত্রিত হল। মুহাম্মদ ইবনে বিশর বর্ণনা করেন, “সকল শিয়া সুলাইমান বিন ছারদণ্ডএর ঘরে সমবেত হয়ে গেল এবং আমীরে মুয়াবিয়ার (রাঃ) ইন্তেকালের কথা আলোচনা করে সবাই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জানাল (মাআযাল্লাহ্)। অতঃপর সুলাইমান সবার উদ্দেশ্যে বলল, “মুয়াবিয়ার (রাঃ) অবসান হয়েছে, আর ইমাম হোসাইন ইয়াযীদের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করে মক্কায় চলে গিয়েছেন। আর তোমরাতো তাঁর ও তাঁর আব্বাজানের শিয়া (ভক্ত)। তোমরা ভালোভাবে জেনে নাও, যদি তোমরা তাঁর দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সক্ষম হও, তবে তাঁর কাছে লিখে দাও। যদি নিজেদের দুর্বলতা ও সাহসের অভাব বোধ কর, তবে তাঁকে ধোঁকা দিও না।” সবাই সমস্বরে বলল, “না, আমরা তাঁকে ধোঁকা দিব না; আমরা তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়বো এবং তাঁর জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবো।” সুলাইমান বললেন, “তবে লিখ! তখন তারা তাঁর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে।” (তাবারী, ৬/১৯৭)।

কুফা থেকে চিঠিপত্র ও আমন্ত্রণকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল। এমনকি মোল্লা বাকের মজলিসীর বর্ণনা মতে, “শিয়াদের পক্ষ থেকে বারো হাজার চিঠি ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর কাছে পৌঁছেছিল।” (জালাউল উয়ূন, ২/১৩৯)

ইমাম হোসাইন (রাঃ) চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার ও কুফাবাসীদের কাছে জবাবে লিখেন, “আমি আপনাদের সকল চিঠি ও দূত মারফত অবগত হলাম, আপনাদের কোন ইমাম নেই; আমি যেনো অতি সত্বর আগমন করি। আপনাদের কাছে আমারই আপন চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে প্রেরণ করছি। তাঁর দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমার আগমনের সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে।” (জালাউল উয়ূন, ২/২৪০) এ চিঠিসহ ইমাম হোসাইন (রাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ) কে কুফায় প্রেরণ করলেন।

মুসলিম ইবনে আকীলের কুফায় গমন : ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর নির্দেশক্রমে হযরত মুসলিম ইবনে আকীল তাঁর দুজন ছাহেবজাদা মুহাম্মদ ও ইবরাহীমকে নিয়ে কুফায় পৌঁছালেন। সেখানে কুফাবাসী তাঁর অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল। তিনি মুখতার বিন আবু উবাইদা কারো মতে ইবনে আওসাজার ঘরে অবস্থান গ্রহণ করেন। কুফাবাসীদের জান-মাল কোরবান করার ঘোষণা ও আবেগ উচ্ছ্বাসে তিনি আপ্লুত হয়ে গেলেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে তিনি চিঠি মারফত জানালেন, “ইতিমধ্যে আমার হাতে আঠারো হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে। অবস্থা পূর্ণ অনুকূলে, আপনি তাশরীফ আনুন; যাতে ইসলামী মিল্লাত ইয়াযীদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায় এবং মানুষ একজন ইমাম ও ন্যায়নিষ্ঠ যথার্থ খলীফার বাইয়াতের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে ও দ্বীনে হক-এর সহায়তা হয়।”

এ দিকে ইয়াযীদের একান্ত সহযোগী আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম এবং উমারা ইবনে ওয়ালিদ ইয়াযীদকে মুসলিম ইবনে আকীলের আগমন এবং লোকদের তাঁর প্রতি ভক্তি-প্রেমের জোয়ারের কথা জানিয়ে দিল। ইয়াযীদ চিন্তিত হয়ে তার বন্ধুদের পরামর্শক্রমে কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বশীরকে বরখাস্ত করে বসরার গভর্নর পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসরার সাথে কুফার গভর্নরের দায়িত্ব প্রদান করে। ইবনে যিয়াদ রাতের আঁধারে ছলনা করে কুফায় গমন করে কুফাবাসীদের প্রতি কঠোর ফরমান জারি করল, কেউ যাতে মুসলিম ইবনে আকীলকে (রাঃ) আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয় এবং ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর পক্ষে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ না করে।

তার নির্দেশানুযায়ী কুফার লোকেরা একে একে মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ)কে ত্যাগ করতে লাগল। নানা কূটকৌশলে ইবনে যিয়াদ ইয়াযীদের পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ) কে শহীদ করে দিল। তাঁর শাহাদাতের সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লে কুফায় গমনকারী তাঁর দুসন্তান অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়ে। ইয়াযীদের প্রেতাত্মারা এ নাবালক দুসন্তানকেও শহীদ করে দিয়েছিল।

ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর কুফায় যাত্রা : কুফা থেকে মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ) কর্তৃক সেখানে অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে মর্মে প্রেরিত চিঠির কারণে হোসাইন (রাঃ) কুফায় যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। মক্কাবাসীগণ অবশ্য তাঁর কুফায় গমনকে মনে-প্রাণে অপছন্দ করলেন। কেননা কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতার কথা তাঁরা ভালোভাবেই জানতেন। হযরত আলী ও হাসান (রাঃ)-এর সাথে তারা কী আচরণ করেছিল এটা তাঁরা অবলোকন করেছিলেন। এ কারণে হোসাইন (রাঃ) কে তাঁরা সেখানে যেতে বাধা দিলেন। বাধাদানকারীদের মধ্যে উমর বিন আবদুর রহমান মাখযুমী, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের, আবু বকর ইবনে হারেস রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ অনেকে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। সকলকে পরাস্ত করে হোসাইন (রাঃ) নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে ৬০ হিজরির জিলহজ্জ মাসে আহলে বাইতের সদস্য ও ভক্ত-অনুরক্তদের নিয়ে মক্কা মুকাররমা থেকে কুফা অভিমুখে রওয়ানা হলেন।

পথিমধ্যে অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল, সবাই কম-বেশি বাধা প্রদান করেছিলেন। কাফেলা পথ চলছিল, কিন্তু তাঁদের কেউ কুফার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। যখন তাঁরা ‘মালুমে সা‘লাবিয়া’ নামক স্থানে পৌঁছালেন, তখনই মুসলিম ইবনে আকীল এবং হানী ইবনে উরওয়ার শাহাদাতের সংবাদ পেলেন। ‘মাকামে যাবলা’য় পৌঁছে ইমাম হোসাইন (রাঃ) অত্যন্ত মনোকষ্ট নিয়ে সঙ্গীদেরকে বললেন, “আমাদের কাছে মুসলিম ইবনে আকীল, হানী ইবনে উরওয়াহ, আবদুল্লাহ ইবনে বকতরসহ অনেকের শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছেছে। সেখানে আমাদের হিতাকাক্সক্ষীগণ আমাদের পক্ষ ত্যাগ করেছে। সুতরাং যাদের ইচ্ছা খুশি মনে ফিরে যেতে পারেন। এ ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ থাকবে না।” তাঁর এ বক্তব্য শুনে মদীনা থেকে যাঁরা সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁরা ব্যতীত প্রায় সকলেই সঙ্গ ত্যাগ করলো।

৬১ হিজরির মুহাররমের ১ম তারিখে হুর বিন ইয়াযীদ এক হাজার সৈন্য নিয়ে কোহে “যী হেশম” উপত্যকায় ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর তাঁবুর কাছে আগমন করল। তারা যোহর ও আসর ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর ইমামতিতে আদায় করল। হুর বলল, “আমি ইবনে যিয়াদ কর্তৃক আপনাদের কাফেলাকে অনুসরণ করতে আদিষ্ট হয়েছি।” হুর অবশ্য পরবর্তীতে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর পক্ষে জিহাদ করে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন।

কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (রাঃ) : উভয় কাফেলা ‘নীনুয়া’ নামক স্থান পার হয়ে ইবনে যিয়াদের নির্দেশ মতে এক ময়দানে হুর বাহিনী বাধা দিলে হোসাইন (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “এ স্থানের নাম কী?” লোকেরা বলল, “কারবালা।” তিনি অবতরণ করে বললেন, “এখানেই আমাদের উটের বসার স্থান, এখানেই আমাদের আসবাবপত্র অবতরণের স্থান আর এখানেই আমাদের শাহাদাতের স্থল।” তাই তিনি ৬১ হিজরির মুহাররমের ২য় তারিখ বৃহস্পতিবার কাফেলাকে সেখানে তাঁবু খাটাতে বললেন। (রাওদ্বাতুশ শোহাদা, ১৬৩ পৃ.)।

কারবালার ময়দানে হোসাইন (রাঃ)-এর তাঁবুর সামনাসামনি হুর তাঁবু গেড়েছিল। যদিও হুরের মনে আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত ছিল, কিন্তু ইবনে যিয়াদের নির্দেশে সে নিরূপায়ও ছিল। ইতোমধ্যে ইবনে সা’দের নেতৃত্বে মুহাররমের ৩য় তারিখে হোসাইন (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে চার হাজার সৈন্য সেখানে পৌঁছাল।

ইমাম হোসাইন (রাঃ) ইবনে সা’দের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন, “আজ রাতে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।” ইবনে সা’দের সম্মতিতে উভয় পক্ষ থেকে বিশ জন আরোহীসহ একত্রিত হলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন (রাঃ) তিনটি প্রস্তাব পেশ করলেন : “১. আমি যেখান থেকে এসেছি আমাকে সেখানে চলে যেতে দাও, ২. আমাকে কোনো সীমান্তে নিয়ে যাও যেখানে বসবাস করতে পারি অথবা ৩. আমাকে ইয়াযীদের কাছে নিয়ে চল, তার সাথে সরাসরি আলোচনা করে সমাধান করবো; যেমনটি হযরত হাসান (রাঃ) হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর সাথে করেছিলেন।” ইবনে সা’দ পরামর্শগুলো ভালো মনে করে এ বিষয়ে ইবনে যিয়াদকে পত্র মারফত জানালে সে সীমারের পরামর্শে উত্তরে লিখল, “হোসাইনকে এবং তার সঙ্গীদের ইয়াযীদের বাইয়াত গ্রহণ করতে বলো। তারা বাইয়াত গ্রহণ করলে পরবর্তী করণীয় আমরা নির্ধারণ করবো।”

ইবনে যিয়াদ নিষ্ঠুরতার চরম সীমায় পৌঁছে দ্বিতীয় পত্রের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর কাফেলার জন্যে ফোরাতের পানি বন্ধ করার নির্দেশনা প্রদান করে। পত্র পেয়ে ইবনে সা’দ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পানির রাস্তা বন্ধ করে নিজেই হোসাইনী কাফেলায় হামলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিল। এটা ছিল ৯ মুহাররম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা।

হোসাইন (রাঃ) সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা সবচেয়ে উত্তম সাথী ও উত্তম পরিবার। শত্রু বাহিনী কেবল আমাকে হত্যা করতে চায়, আমার কারণে তোমরা শহীদ হবে, আমি এটা চাই না।” সঙ্গীদের মধ্যে একের পর এক সকলেই দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমরা আপনার শাহাদাতের পর জীবিত থাকার জন্যই কি চলে যাবো? আমরা হাজার বার শহীদ হয়ে হাজার বার জীবিত হয়ে হাজার বার শহীদ হলেও আপনাকে ত্যাগ করে চলে যাবো না।”

১০ মুহাররম ৬১ হিজরি জুমার দিন অবুঝ মাসুম শিশুসহ সপরিবার ও আশেকে আহলে বাইতসহ মাত্র ৮২ জনের কাফেলার জন্য ইয়াযীদ বাহিনী বাইশ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। এ যেনো এক অসম যুদ্ধ। ইবনে সা’দ আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হলে হুর বলল, সত্যিই কি ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে! অবশ্য হুর সৌভাগ্যক্রমে যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে হোসাইন (রাঃ)-এর কাছে এসে তাওবা করে। ইবনে সা’দ যুদ্ধ শুরু করলে হুরসহ আহলে বাইতের একে একে সবাই প্রাণপণে লড়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। দুধের শিশু আলী আসগরের কান্নায় অস্থির হয়ে হোসাইন (রাঃ) ইয়াযীদ বাহিনীর কাছে সামান্য পানির আবেদন করলে বদবখত হারমালা ইবনে কাহেলের তীরের আঘাতে শিশুপুত্রও শহীদ হন।

পরিশেষে ইমাম হোসাইন (রাঃ) যুদ্ধের পোশাক পরে ‘যুলফিকার’ তলোয়ার হাতে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অবতরণ করে বহু ইয়াযীদী সৈন্য ধরাশায়ী করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করেন। ইয়াযীদী বাহিনী ইবনে সা’দের পরামর্শে সম্মিলিত আক্রমণ করলে ৩৩টি বর্শা, ৪০টি তরবারি ও ১২১টি তীরের আঘাত সহ্য করে ইমাম হোসাইন (রাঃ) সিজদায় পড়ে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমু খেয়ে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে চলে যান। (তাযকেরাতে সিবতে ইবনে জু‘যী)। হতভাগা খুলী ইবনে ইয়াযীদ হোসাইন (রাঃ)-এর নুরানী শির মোবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ইচ্ছা করেও ভয়ে পিছু হটে যায়। তার ভাই কুলাঙ্গার হাশাল ইবনে ইয়াযীদ অথবা হতভাগা শিমার ইমামের শির মোবারক পবিত্র দেহ থেকে পৃথক করে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে।

কারবালার শিক্ষা : কারবালার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন হয়ে থাকবে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত। এ ঘটনা থেকে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর প্রতিশ্রুতি রক্ষা, অন্যায়, অসত্য, অসাম্য, যালিমের বিরুদ্ধে সকল প্রতিকূল অবস্থায় অটল-অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বিশ্ববাসীর মাঝে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছেন। তাঁর এ মহান ত্যাগ-তিতিক্ষা থেকে আমরাও সকল প্রকার বাতিলের সামনে মাথা নত না করে সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে প্রয়োজনে নিজের জান-মাল কোরবান করতেও কুণ্ঠিত না হওয়ার শিক্ষা লাভ করতে পারি।

লেখক : আরবি প্রভাষক, রামপুর আদর্শ আলিম মাদরাসা, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়