বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৭

নারীর প্রতি সহিংসতা আর নয়

মুক্তা পীযূষ
নারীর প্রতি সহিংসতা আর নয়

যে কোনো সহিংসতা, হোক গুপ্ত কিংবা দৃশ্যমান, তা আক্রান্তের জীবনে ও সমাজে স্থায়ী ক্ষত রেখে যায়। কোনো নারীকেই একা এ বীভৎস অন্ধকারের মুখোমুখি হতে দেওয়া উচিত নয়।

প্রতিটি নারীরই নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং নিজের স্বাধীন মতকে তুলে ধরার ও অন্যকে তা শোনানোর অধিকার রয়েছে। আমরা ইনার হুইল বন্ধুরা এ ব্যাপারে অটল ও অনড়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমরা পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করি না। আমরা দৃপ্তকণ্ঠে প্রতিটি নারীর অধিকার ব্যক্ত করার পক্ষে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাই এবং যারা নিজেদের পক্ষে কথা বলতে পারে না তাদের হয়ে কথা বলি।

মনে রাখবেন, আপনি বা নারী কখনো একা নন। আপনাদেরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। আপনাদের সমর্থন করার জন্যে আমরা আপনাদের সাথে আছি।

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের দাবি নিয়ে ২০২৪ সালে ইনার হুইল ইউএনআইটিই টিম প্রথম ইনার হুইল গ্লোবাল অরেঞ্জ দ্যা ওয়ার্ল্ড প্রচারণা শুরু করে।

২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘নারীর প্রতি সহিংসতার নির্মূল।’ জাতিসংঘের নারী ইউনিট এবং অরেঞ্জ দ্যা ওয়ার্ল্ড উদ্যোগের সমর্থনে আমরা ইনার হুইল বন্ধুরা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতামুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলবার জন্যে ঐক্যবদ্ধ।

নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, যার মধ্যে রয়েছে :

-ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতা

-যৌন সহিংসতা

-মানসিক সহিংসতা

-নারী যৌনাঙ্গ বিচ্ছেদ

-জোরপূর্বক বিবাহ এবং বাল্যবিবাহ

-নারীহত্যা ও

-পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে নারী পাচার।

লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা মূল্যবোধ, সামাজিক সংহতি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ক্ষুণ্ন করে। নারী ও মেয়েদের মানবাধিকারের একটি শক্তিশালী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইনার হুইল বিশ্বব্যাপী নারীদের রক্ষক হিসেবে আছে এবং অনলাইন ও প্রযুক্তি-নির্ভর নির্যাতন সহ সকল ধরনের লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার আমরা বিরোধিতা করি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গোপনীয়তা এবং কার্যকর আইন ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে নারীর প্রতি ডিজিটাল সহিংসতা উদ্বেগজনক গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। নারীরা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নারী ও মেয়ে শিশু এখনও অনলাইনভিত্তিক নির্যাতন থেকে আইনি সুরক্ষার অভাব বোধ করে। আসুন জেনে নেই-ডিজিটাল সহিংসতা সম্পর্কে আইন কী বলে :

--ডিজিটাল অপব্যবহার কেবল ক্ষতিকারকই নয়, এটি অবৈধ। আজ, আমরা সাইবার অপরাধ (নিষেধাজ্ঞা, প্রতিরোধ, ইত্যাদি) আইন ২০১৫-এর মূল বিধানগুলো ভেঙ্গে ফেলছি, যাতে মানুষ তার অধিকার, নিজের সুরক্ষা এবং অপরাধীদের জন্যে পরিণতি সম্পর্কে জানতে পারেন।

অনলাইনে নিরাপদ থাকার প্রথম পদক্ষেপ হলো আইনটি বুঝতে পারা।

আপনি নারী বলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সোয়াইপ করুন, শিখুন এবং শেয়ার করুন, আজ যে কোনো কারো এটির প্রয়োজন হতে পারে।

এ বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী পালিত হচ্ছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলে জাতিসংঘ নারীর কাছে অঙ্গীকার করেছে--প্রতিটি নারী ও মেয়ে শিশুরই সহিংসতামুক্ত জীবনযাপনের অধিকার আছে।

দৃঢ়তার সাথে নিজের কথা বলুন, সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

৩১৬ মিলিয়ন! গত এক বছরে বিশ্বব্যাপী এতো নারী সঙ্গী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে প্রমাণিত কৌশল থাকা সত্ত্বেও, এটি বিশ্বের সবচেয়ে স্থায়ী এবং অমীমাংসিত মানবাধিকার সংকটগুলোর মধ্যে একটি রূপে পরিগণিত হয়েছে।

নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করার জন্যে প্রয়োজন হলো সাহস, দৃঢ় অঙ্গীকার ও সম্মিলিত পদক্ষেপ।

নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা খুব কমই জোরে শুরু হয়। এটি প্রথমে সতর্কতার সাথে শুরু হয়।

অন্য কারো মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার প্রথম লক্ষণগুলো চেনার উপায় :

--নারীর সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোর জন্যে সতর্ক থাকুন, যেমন :

-বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা সামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা

-মেজাজ বা আত্মবিশ্বাসের হঠাৎ পরিবর্তন

-ঘন ঘন ব্যাখ্যাতীত আঘাত বা দুর্ঘটনা

-সঙ্গীর আশেপাশে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন বা ভীত আচরণ

যদি আপনি এই লক্ষণগুলো লক্ষ্য করেন, নিরাপদে সহিংসতায় আক্রান্ত নারীর সাথে যোগাযোগ করুন, তাকে সহায়তা প্রদান করুন এবং পেশাদার সাহায্য পেতে তাদের পরামর্শ দিন।

নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে :

শারীরিক স্বাস্থ্য :

পরিসংখ্যান মতে ৪২% নারী তাদের সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হন। এর ফলে তাদের সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত শারীরিক লক্ষণও দেখা দিতে পারে, যেমন মাথাব্যথা, ব্যথা সিন্ড্রোম (পিঠ, পেট এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্রোণী ব্যথা), গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্যাধি এবং দুর্বল সামগ্রিক স্বাস্থ্য।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য :

যেসব নারী শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তাদের গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয় অথবা অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের সম্মুখীন হতে পারেন এবং তাদের যৌনবাহিত রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা ১.৫ গুণ বেশি।

মানসিক স্বাস্থ্য :

সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিষণ্ণতা, আঘাত-পরবর্তী চাপ, আত্মহত্যা কিংবা নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা, ঘুমের সমস্যা এবং খাওয়ার ব্যাধি।

এ সকল সমস্যা নারীর সন্তানদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

জরুরি অবস্থার সময় এবং পরে নারী ও মেয়েদের নির্দিষ্ট চাহিদা থাকে যা সর্বদা সমাধান করা উচিত। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্রাদুর্ভাবের মতো মানবিক জরুরি অবস্থার সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে :

-নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন

-বেঁচে থাকাদের সহায়তা করা

-নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা

-সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা।

আসুন এমন একটি পৃথিবীর দরজা খুলে দেই, যেখানে প্রতিটি নারী নিরাপদ, যেখানে সবাই তাকে শুনবে এবং তখনই নারীর প্রতি সহিংসতার সমাপ্তি ঘটবে কোনও অজুহাত ছাড়াই।

আমার আপনার প্রাথমিক হস্তক্ষেপ ও গৃহীত সঠিক পদক্ষেপে অন্য একটি নারীর জীবন বদলে দেওয়া পরিবর্তন আনতে পারে।

নারীর প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে নারী ও মেয়ে শিশুদের প্রতি সহিংসতা অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য।

মুক্তা পীযূষ : সংস্কৃতি সংগঠক ও নারী নেত্রী; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পদক্ষেপ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটি; সদস্য, ইনার হুইল অরেঞ্জ ইউনিট; পাস্ট প্রেসিডেন্ট (২০১৭-১৮), ইনার হুইল ক্লাব অব চাঁদপুর সেন্ট্রাল, ডিস্ট্রিক্ট-৩২৮, বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়