প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০
যে কোনো নির্যাতনই নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারপরও নির্যাতন বন্ধ করা যাচ্ছে না। কে নির্যাতিত হন? দুর্বল মানুষই বেশি নির্যাতনের শিকার হন। কে দুর্বল? প্রবীণ, নারী ও শিশুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হন। সহায় সম্বলহীন মানুষ যারা শ্রম বিক্রি করে তারা নানা ভাবে নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনকারী যখন বুঝতে পারে নির্যাতিত ব্যক্তির প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দুর্বল, তখন সে নির্যাতনের কথা ভাবে। নির্যাতন করলে কিছু হবে না বা হলেও তা মোকাবিলা করতে পারবে এই মনোভাব থেকে নির্যাতনে আগ্রহী হয়।
যুগে যুগে নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। নির্যাতনে শারীরিক শক্তি একসময় প্রধান ছিল। শারীরিকভাবে শক্তিশালী লোকজন আশপাশের লোকজনকে সব সময়ই তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। নিয়ন্ত্রণ অমান্যকারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো।
শারীরিক নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদণ্ডপ্রতিরোধ বাড়ছে, ফলে নির্যাতনের ধরণ পাল্টে গেছে। এখন তুলনামূলকভাবে মানসিক নির্যাতন-নিপীড়নের হার অনেক বেড়ে গেছে। মানসিক নির্যাতন পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, গণপরিবহনে, সেবা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে দিন দিন বাড়ছে। নির্যাতিত মানুষের মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ক্ষোভ প্রশমনে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্যাতন নিপীড়নের শাস্তি দেবার প্রক্রিয়া কার্যকর রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আইন শেষ পর্যন্ত শক্তিমানের পক্ষেই যায়। তবুও মানুষ আশায় বুক বাঁধে একদিন সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রকৃত পক্ষে মানুষ সুযোগ-সুবিধার চাইতে ন্যায়বিচার বেশি দাবি করে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাক এটাই একমাত্র কাম্য হয়ে উঠে। কারণ যাই হোক না কেন, রাষ্ট্রযন্ত্র শেষ পর্যন্ত শক্তিমানের স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনোযোগী হয়। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষরা লড়াই-সংগ্রাম করে রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে। বরাবরই নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করার জন্যে দুর্বল মানুষই থাকে। এই দুর্বল মানুষের রক্ত-ঘামে আমাদের সমাজ-সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
আমাদের দৈনন্দিন সুখণ্ডশান্তি, আরামণ্ডআয়েশ দুর্বল মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা থেকে প্রাপ্ত। দুর্বল মানুষের লড়াই-সংগ্রাম থেকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল।
নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মানুষকে মুক্ত করার সংগ্রাম করতে গিয়ে সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে। নির্যাতন মানুষকে প্রতিবাদী হতে প্রেরণা জোগায়। নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে নির্যাতন-নিপীড়ন সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
একটা সময় জমিদারি প্রথা, মহাজনি সুদ মানুষকে চরম নির্যাতনের মধ্যে রেখেছিল। মানুষের প্রতিবাদণ্ডপ্রতিরোধের মুখে জমিদারি ও মহাজনি সুদ বিলুপ্ত হলেও নতুন কায়দায় জমিদারি প্রথা ও মহাজনি সুদ সমাজে বিরাজমান রয়েছে। কিছু কিছু ধর্মীয় বিধান মানুষের জন্যে পীড়াদায়ক হওয়ার কারণে আন্দোলন-সংগ্রাম দাবির মুখে স্থগিত করা হয়েছে।
প্রবীণরা সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠী। তাদের অধিকাংশই সহায়-সম্পদহীন অবস্থায় প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে। ভরসা করে সন্তান এবং নিয়তির ওপর। কপালের লিখন খণ্ডানো যায় না এই বিশ্বাস থেকে সকল রকমের নির্যাতন-নিপীড়নকে মেনে নেয়ার প্রবণতা রয়েছে। প্রবীণরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতনের প্রায় পুরোটাই পরিবার পরিজনের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন। নির্যাতনবিরোধী আইন থাকার পরও অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ সন্তান সন্তুতির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে যায়। মানসিক নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রবীণের সাথে কথা বলা বন্ধ করা কিংবা চুপ করে থাকাও বড় ধরনের মানসিক নির্যাতন। প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে প্রবীণ নির্যাতনের ঘটনা দেখতে পাই গণমাধ্যমের কল্যাণে। কোনো নির্যাতনই এককভাবে মোকাবিলা করা যায় না। মোকাবিলা করতে হয় সম্মিলিতভাবে। প্রবীণদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রবীণ জনগোষ্ঠী পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত জুলুমণ্ডনির্যাতন বন্ধ করার জন্যে সক্রিয় হবে। প্রবীণরা বার্ধক্যের ভার পরিবার পরিজন আর নিয়তির ওপর ছেড়ে দিতে চাইবে না। তারা নিজেদের শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে অর্থ সঞ্চয় করবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে, স্বস্তিদায়ক জীবনের জন্যে কুঅভ্যাস ত্যাগ করবে, সন্তান নির্ভর মানসিকতা বাদ দিবে।
প্রবীণদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে তারা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন। প্রবীণরা তাদের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে নির্যাতনের পরিমাণ অনেক কমে যাবে। কারো ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করা পাপ-- এটা শত সহস্রবার প্রচার করলেও নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। নির্যাতন করা মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ এই কথায়ও কাজ হবে না। নির্যাতনবিরোধী কঠিন আইন করা হলেও নির্যাতন বন্ধ হবে না। নির্যাতন বন্ধ করতে ব্যক্তিকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তির নির্ভরতা যত কম হবে, নির্যাতনের মাত্রাও তত কম হবে। সন্তাননির্ভর জীবনের আকাঙ্ক্ষা কিংবা পরিবার পরিজনের সাথে পারিবারিক জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করার ইচ্ছা মানুষকে আবেগিক সঙ্কটে ফেলে দেয়। যদি জীবনের শুরু থেকে প্রবীণ জীবনের প্রস্তুতি নেয়া যায় তবে নির্যাতনের সম্ভাবনা অনেকখানি কমে যায়। ব্যক্তি তখন ঠিক করে আয়ের কতোটুকু নিজের জন্যে, কতোটুকু সন্তানের জন্যে, কতোটুকু স্ত্রী বা স্বামীর জন্যে, কতোটুকু প্রবীণ জীবনের জন্যে রাখবেন। নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা থেকে সরে আসতে থাকবে। নিজেকে বঞ্চিত করে সব কিছু পরিবারের সদস্যদের জন্যে উৎসর্গ করা মূর্খতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
প্রবীণ নির্যাতন অবশ্যই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রত্যেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ভালো কিছু অর্জনের সুযোগ থাকে। প্রবীণ নির্যাতনের ঘটনা যতো বেশি মানুষের সামনে হাজির হবে, মানুষ ততো বেশি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাববে, নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে নানান রকমের উপায় খুঁজে বের করবে। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যে আশপাশের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে বৃহৎ শক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটাতে পারবে। বৃহৎ শক্তির মোকাবিলা করার বিষয়টি সবসময় নির্যাতনকারী মাথায় রাখবে। সে বুঝতে পারবে নির্যাতন করলে শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবে না।