প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:০০
মতলব উত্তর থানার সাবেক ওসি (তদন্ত) ও পরে হাজীগঞ্জ থানর সাবেক অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন রনি। হাজীগঞ্জে থাকাকালে নিজের দায়িত্বের বাইরে অনেক মানবিক কাজ করেছেন। বিশেষ করে করোনাকালে ছিলেন হাজীগঞ্জবাসীর পাশে। এমনকি নিজে স্ত্রী-সন্তানরাসহ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত এই কর্মকর্তা এক ভবঘুরে ব্যক্তিকে কীভাবে গোসল করান, গোসলের পাশাপাশি সেবা করেন আর কিছুটা সুস্থ করে তোলেন, বহু চেষ্টার পর তার পরিবারের খোঁজ পেয়ে তাকে সেখানে পৌঁছে দেন--সেটা নিয়ে তার নিজের ফেসবুক পেজে একটি লম্বা স্ট্যাটাস দেন। যা নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো হলো :--
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করতে এসে আমরা নানাবিধ ঘটনার মুখোমুখি হই। আমাদেরকে অত্যন্ত ধৈর্য ও মেধা খাটিয়ে কাজ করতে হয়। গত ০৪/০৬/২০২৩ তারিখ রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি থানাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় একজন ব্যক্তিকে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা করতে দেখে তাকে আটক করেন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ জুরাছড়ি থানাধীন যক্ষা বাজার ক্যাম্পে এনে তাকে তার নামণ্ডঠিকানা জানার চেষ্টা করেন। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তাকে খাবারের ব্যবস্থা করেন। তার সাথে কথা বলে তার নামণ্ডঠিকানা সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। অতঃপর রাত হয়ে গেলে সেনা সদস্যগণ ক্যাম্প ইনচার্জ ক্যাপ্টেন মোশারফ হোসেন মহোদয়ের নির্দেশে সন্দেহজনক লোকটিকে থানায় নিয়ে আসেন। লোকটিকে আনার পর তার নামণ্ডঠিকানা যতটুকু তারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন, সিডিএমএস-এর মাধ্যমে যাচাই করি সে কোনো অপরাধী কি না, কোনো মামলা আছে কি না। নামের সাথে ঠিকানা মিল না থাকায় কোনো তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। লোকটিকে দেখে আমার মনে হয়েছিল লোকটি মানসিকভাবে ঠিক নেই। দেখতে খুবই ক্লান্ত ও রোগাক্রান্ত। সারা শরীর ময়লা, নোংরা। আমি তাকে থানায় পেয়ে প্রথমেই খাবার খেতে দেই। তার সাথে ব্যাপক আলোচনা করি। কোনো সুস্পষ্ট ঠিকানা বা তথ্য জানতে না পেরে এসআই নির্মল ও ডিউটি অফিসার তপনকে দায়িত্ব দেই তার সাথে কথা বলার জন্যে। দুজন অফিসার অনেক চেষ্টা করে তার কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাননি। সে একেক সময় একেক রকম কথাবার্তা বলে। ঠিকানার বিষয়ে বলতে গেলে সে কোনো ঠিকানা দিতে পারছিল না। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করার পর তারা যে ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারলেন, সেই ঠিকানা খোঁজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার সাথে কথা বলার পর জানতে পারেন এই নামে কোনো গ্রাম বা ঠিকানা নেই। আমি তাকে বিশ্রাম দিতে বলি। তাকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে বলি। পরদিন সকালবেলায় তার শরীরের পুরনো জামা কাপড় পরিবর্তন করে আমাদের কাছে থাকা পায়জামা ও গেঞ্জি তাকে দেই। তাকে গোসল করার জন্যে বলি। এসএসআই শাহাদাত হোসেন ও কনস্টেবল মোশারফ হোসেন তাকে পুকুরে নিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দেন। অতঃপর তাকে নাস্তা খাওয়াই। আমি তাকে আমার পাশে বসাই। তাকে বিভিন্ন কৌশলে অনেকক্ষণ কথা বলার পর সে কয়েকটি ঠিকানা দেয়। ময়মনসিংহ জেলায় তার বাড়ি বলে সুস্পষ্ট বোঝা যায় না। ময়মনসিংহ বলতেছে নাকি অন্য কোনো জেলার নাম বলতেছে কিছুই ভালো করে বুঝা যায় না। অনুমান করে আমি ময়মনসিংহ ধরে নেই। ময়মনসিংহ জেলার থানার নাম তার কথার সাথে মিলাইতে পারিনি। যাই হোক, এক পর্যায়ে সে একটি থানার নাম পূর্ব নামে কিছু একটা বলল। ময়মনসিংহ বিভাগের সকল জেলার থানার নাম খুঁজে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা নামে একটি থানা খুঁজে পাই। তারপর গ্রামের নাম তাকে জিজ্ঞাসা করার পরে সে কয়েকটি গ্রামের নাম বলে। আমি পূর্বধলার থানার ওসি সাহেবের সাথে কথা বলে কয়েকটা গ্রামের নাম বলার পর একটি গ্রামের নাম তিনি চিনতে পারেন। পরবর্তীতে আমি বাংলাদেশ পুলিশের বিট পুলিশিং কার্যক্রমকে কাজে লাগাই। পূর্বধলা থানার সংশ্লিষ্ট এলাকার বিট অফিসারের সাথে কথা বলি। বিট অফিসারকে লোকটির ছবিসহ পাঠাই। বিট অফিসার এসআই শফিউল্লাহ সংশ্লিষ্ট বিটের ওয়ার্ড মেম্বারদের লোকটির ছবি পাঠানোর পর একজন মেম্বার জনাব মতিউর রহমান তাকে চিনতে পারেন। তখন মেম্বারের কাছ থেকে লোকটির চাচাতো ভাইয়ের নাম্বার পাওয়া যায়। আমি তার চাচাতো ভাই কাজলের সাথে কথা বলে ছবি পাঠিয়ে পুনরায় নিশ্চিত হই। তিনি জানান, তারা তার চাচাতো ভাইকে গত প্রায় ছয়-সাত মাস হবে খুঁজে পাচ্ছে না। তার স্ত্রী সন্তানরা তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। তারা ভেবে নিয়েছে সে হয়তো পৃথিবীতে আর নেই। আমি এই লোকটির গার্ডিয়ানকে থানায় এসে লোকটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তারা আমাকে জানায়, তারা খুবই অসহায়। গাড়ি ভাড়া করে আসার মত তাদের সামর্থ্য নেই। পরবর্তীতে আমি রাঙ্গামাটি জেলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার জনাব মীর আবু তৌহিদ বিপিএম (বার) মহোদয়ের সাথে কথা বলে তাকে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি গ্রহণ করি। থানার এএসআই আলমগীর হোসেন ও একজন ফোর্স দিয়ে তাকে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠাই। রাঙ্গামাটি জেলা হতে দীর্ঘ প্রায় ২৬ ঘন্টা জার্নি করার পর তারা লোকটিকে নিয়ে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানায় হাজির হন। অতঃপর পূর্বধলা থানার অফিসার ইনচার্জের সহযোগিতায় বিট অফিসার, ডিউটি অফিসারের উপস্থিতিতে লোকটির আত্মীয়, আপন ভাই ও স্থানীয় মেম্বারদের মাধ্যমে লোকটিকে তার আপনজনের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
এভাবে একটি অসহায়, মানসিকভাবে অসুস্থ, নিখোঁজ ব্যক্তিকে তার আপনজনের কাছে পৌঁছে দিতে পেরে আমি মানিসক শান্তি পেলাম। এভাবে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠিকানা সংগ্রহ না করলে হয়তো সে তার আপনজনকে ফিরে পেতো না। সে হয়তো নিরাপদ হেফাজতেই পড়ে থাকতো। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, তিনি আমাকে এই কাজ করার জন্যে দায়িত্ব দিয়েছেন।