প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে, তারপরও এই ক্ষেত্রে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা রয়েছে। সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত রয়ে গেছে স্বল্প তহবিল ও স্বল্প কর্মীর একটি বিভাগ হিসেবে, যার ফলস্বরূপ পরিচর্যার মান খারাপ, পরিষেবাগুলোতে সীমিত অ্যাক্সেসেও ক্রমাগত স্বাস্থ্যসেবা বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রধান কিছু সমস্যা নিয়ে এই প্রবন্ধে আমি আলোচনা করব।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অপর্যাপ্ত তহবিল। স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়ানোর জন্যে সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও খাতটি এখনও জাতীয় বাজেটের একটি অপেক্ষাকৃত ছোট অনুপাতে বরাদ্দ পায়। এর ফলে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব দেখা দেয়, সেইসাথে অপর্যাপ্ত কর্মীস্তর স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের জন্যে খারাপ কাজের অবস্থা তৈরি করে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের অনেক মানুষ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পেতে অক্ষম, বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারীরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আরেকটি বড় সমস্যা হলো, জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী সহ স্বাস্থ্যসেবায় পেশাদারদের অভাব। দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। এটি দীর্ঘ অপেক্ষার সময়, বিশেষায়িত যত্নে সীমিত অ্যাক্সেস এবং সামগ্রিকভাবে নিম্নমানের যত্নের দিকে ধাবিত করছে। উপরন্তু, বাংলাদেশের অনেক স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের খুব কম বেতন দেওয়া হয়, যার কারণে উচ্চ পর্যায়ের টার্নওভার এবং দক্ষ পেশাদারগণ অন্য দেশে বা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে পরিচর্যার মান একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও অনেক স্বাস্থ্য সুবিধার যত্নের মান খারাপ রয়ে গেছে। এটি স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের জন্য অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, খারাপ কাজের অবস্থা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাব সহ বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণে ঘটে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের অনেক মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় যত্ন পাচ্ছেন না, যাতে প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর উচ্চ হার বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আরেকটি সমস্যা হলো যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু জ্বরের মতো সংক্রামক রোগের উচ্চ প্রকোপ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও এই রোগগুলো বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্যে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, পরিষ্কার জল এবং স্যানিটেশন সুবিধায় অ্যাক্সেসের উল্লেখযোগ্য অভাব রয়েছে, যা কলেরার মতো জলবাহিত রোগের বিস্তারেও অবদান রেখেছে।
স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির জন্য যে ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়া যায় তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হলো :
উন্নয়ন সহায়তা : বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) থেকে উন্নয়ন সহায়তা পেয়েছে। এই সহায়তা স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প এবং প্রোগ্রামগুলোকে সমর্থন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন হেলথ, নিউট্রিশন এবং পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রাম (HNPSP) এবং এসেনশিয়াল সার্ভিস ডেলিভারি প্রোগ্রাম (ESDP)।
প্রযুক্তিগত সহায়তা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (USAID)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য নীতি উন্নয়নে সহায়তা এবং স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা।
মানবিক সহায়তা : বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে মানবিক সহায়তা পেয়েছে। এই সহায়তা জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকে সমর্থন করার জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা সরবরাহ, সরঞ্জাম এবং কর্মীদের বিধান।
অংশীদারিত্ব কর্মসূচি : দেশে স্বাস্থ্য সেবা পরিষেবার উন্নতির জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ক্লিনটন হেলথ অ্যাকসেস ইনিশিয়েটিভ (CHAI)-এর সাথে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের অ্যাক্সেস উন্নত করতে এবং তাদের খরচ কমাতে অংশীদারিত্ব করেছে।
গবেষণা সহযোগিতা : বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা গবেষণা উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (icddr,b) কলেরা, ডায়রিয়া এবং যক্ষ্মা রোগের গবেষণায় WHO এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে সহযোগিতা করেছে।
সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার উন্নতিতে আন্তর্জাতিক সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এটি দেশের জন্য সমর্থনের একটি অপরিহার্য উৎস হতে থাকবে।
কানাডার স্টেপ টু হিউম্যানিটি এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ নর্থ মার্কিন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের কোস্টাল ১৯ গ্রুপের সহযোগে স্বাস্থ্য শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণাও স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা : দাতব্য সংস্থা স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন, পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধের মতো বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রমের আয়োজন করবে।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য প্রদান : দাতব্য সংস্থা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার জন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সামগ্রী যেমন ব্রোশিওর, প্যামফলেট এবং পোস্টার বিতরণ করবে।
স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ : দাতব্য সংস্থাগুলোর স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা উন্নত করতে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা দিবে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সাথে সহযোগিতা : দাতব্য সংস্থাগুলোর সমন্বিত পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচার করতে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করবে।
সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার : দাতব্য সংস্থাগুলোর স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং স্বাস্থ্যকর আচরণ প্রচার করতে সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারে। সামাজিক মিডিয়া সফলতার গল্প শেয়ার করতে এবং স্বাস্থ্যসেবায় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ কে উৎসাহিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা প্রদান করুন : দাতব্য সংস্থাগুলোর সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়গুলো বিনামূল্যে বা কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে পারে, যা স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলো অ্যাক্সেস উন্নত করতে এবং স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
উপসংহারে বলবো, দাতব্য সংস্থাগুলো লক্ষ্য যুক্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারাভিযান বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, স্বাস্থ্য তথ্য প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে দাতব্য সংস্থাগুলোর বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ফলাফলের উন্নতির বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী।