বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

বাঙালির মুক্তির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান
অনলাইন ডেস্ক

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এই শব্দ তিনটি একইসূত্রে গাঁথা। প্রতিটি শব্দই একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনাও করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর জাতিগত পরিচয়, জীবন, কর্মপরিধি ও দেশাত্মবোধ এতই গভীরে প্রোথিত যে, আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের পক্ষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লেখা সত্যিই দুরহ কাজ। তারপরও শৈশব-কৈশোর থেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুজিববাদী ছাত্রলীগের রাজনীতির সংস্পর্শে থাকার সুযোগ হয়েছিল বন্ধু ও সহপাঠীদের কল্যাণে। কিন্তু লেখালেখির অভ্যাস থেকে পরবর্তীতে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ার পর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ হয়ে উঠেনি। গণতন্ত্রের মানসকন্যা, ডিজিটাল বাংলাদেশের রুপকার জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নয়ন, বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল, স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমার প্রেরণা ও আমার বিশ্বাস মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩ তম জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে তার গৌরবোজ্জ্বল জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখার আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পরোক্ষভাবে এবং ২৬শে মার্চ প্রত্যক্ষভাবে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তারই আহ্বানে ও নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র জন্ম নেয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি জাতীয় পতাকা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ দিয়েছেন। সে মূল্যায়নে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি এ দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তার জীবনের এক চতুর্থাংশেরও বেশি সোনালি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নাম একই সূত্রে গাঁথা। তাই বঙ্গবন্ধু মানেই সোনার বাংলা এবং স্বপ্নের বাংলাদেশ।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের নিভৃতপল্লী টুঙ্গী পাড়ায় শেখ বাড়ীতে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের সংসারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা মা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালেই তার সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, বাগ্মিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণেই এই ছাত্রনেতা সমসাময়িক অনেককে পেছনে ফেলে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র সংঘের সম্মেলনে যোগ দেন। বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাশ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। স্বদেশপ্রেমের আবেগেই তিনি প্রথম যৌবনে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাস না পেরোতেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন বাঙালিরা স্বাধীন হলেও মুক্তি পায়নি। সেই অনুভূতি ও বিশ্বাস থেকেই সমমনা প্রগতিশীল ছাত্র নেতা-কর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিব গঠন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ যা আজকের ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামে পরিচিত। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জনক ও গভর্নর জেনারেল কায়েদণ্ডই আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা গোষণা করলে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্র নেতাকর্মী সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। পরদিন ভাষার দাবিতে সচিবালয়ের সামনে মিছিল থেকে তাকে আবারো গ্রেফতার করা হয়।

নতুন রাষ্ট্র প্রাপ্তির মোহভঙ্গ হলে এই নব রাষ্ট্রেরই প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠিত অনেক রাজনীতিকের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তারিখে ঢাকার বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং কারাগারে অন্তরীণ শেখ মুজিবকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ৫২ ’র ভাষা আন্দোলনকালে রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ ও তা আরো বেগবান করার লক্ষ্যে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিব ও মঠবাড়িয়ার মহিউদ্দিন আহমেদ জেলখানায়ই আমরণ অনশন শুরু করেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারির পুলিশের গুলিতে নিহতদের সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছালে তারা অনশন ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি অনশনের ১১তম দিনে শেখ মুজিবের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সরকার তাকে মুক্তি এবং বাইরের হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়।

১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি এবং হক-ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের কারণে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের তরুণ অথচ প্রভাবশালী মন্ত্রী হন।

১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ইসকান্দর মির্জাকে হটিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন এবং সামরিক শাসন জারি করেন। আর নিজ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী ও ঝামেলামুক্ত করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবকে দ্রুতই কারাগারে পাঠানো হয়। ১৯৬২ সালের ৮ জুন সামরিক শাসন প্রত্যাহার হওয়ার পর তিনিও জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে শেখ মুজিব প্রথম সারির কয়েকজন বিশ্বস্ত দলীয় নেতা এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং নিজের লক্ষ্য ঐতিহাসিক ছয় দফা (বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ) ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তুলে ধরেন। ছয় দফা নিছক তাঁর স্বায়ত্ব শাসনের দাবি নয়, ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাওয়ার সুক্ষ্ম পরিকল্পনাও। পরদিনই শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফিরে আসেন। পহেলা মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সভপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফাকে জনগণের দাবিতে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি এবার পূর্ব পাকিস্তানের মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর চষে বেড়ান। ছয় দফার দাবিতে খুব দ্রুত গণজাগরণ সৃষ্টি হয় ফলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৭ জুন ‘৬৬ তার মুক্তির দাবিতে আহুত ধর্মঘট চলাকালে তেজগাঁওয়ে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক মনু মিয়া মারা যায়। এরপর গ্রেফতার দেখিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বার আসামী করে ৩৪ জন বাঙালি আমলা, রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবেশি দেশ ভারতের সহায়তায় তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও মুজিবের মুক্তির দাবিতে জনগণ সোচ্চার হয়, আন্দোলনে রাস্তায় নামে। স্লোগান তোলে-‘জেলের তালা ভাঙব-শেখ মুজিবকে আনবো’। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলনের আগুন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আইয়ুব সরকার ১লা ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ রাওয়ালপিন্ডিতে সকল রাজনৈতিক দলের এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। নজিরবিহীন হলেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ এবং প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমতাবস্থায় আগরতলা মামলা সত্য কি মিথ্যা তা প্রমাণের পূর্বেই ১২ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ শেখ মুজিব ও তার সহযোগীদেরকে সরকার বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছয় দফা দাবি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ঘটে যাওয়া সফল গণঅভ্যুত্থান এই অঞ্চলে তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। মুক্তিলাভের পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে গণসংবর্ধনায় জাতির পক্ষে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন থেকে শেখ মুজিব নিজ নাম অপেক্ষা ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে অধিক পরিচিতি লাভ করেন।

১০ মার্চ ‘৬৯ বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত শেখ মুজিবুর রহমান পিন্ডির গোলটেবিলে তার ছয় দফার সঙ্গে ছাত্রদের এগারো দফা দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু পূর্বের ন্যায় শাসক গোষ্ঠী তা অগ্রাহ্য করে। ২৫ মার্চ তারিখে আইয়ুব খানকে হটিয়ে ইয়াহিয়া খানের আবির্ভাব ঘটে। তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। ফলে রাজনীতি আবারও অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিপতিত হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির নাড়ীর স্পন্দন বুঝতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, হাজার বছরের ঘুমন্ত জাতি এবার জেগে উঠেছে এবং তারা তাঁর পেছনে আছে ও তার প্রতি বাঙালিদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণের জন্য এখন বাঙালিদের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট প্রয়োজন। অতপর তিনি নতুন সামরিক সরকারের কাছে এক ব্যক্তির এক ভোটের নির্বাচন দাবি করেন। ৫ ডিসেম্বর ‘৬৯ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক অলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি যে আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি পুনঃনির্বাচিত হন। ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর ‘৭০ জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদের নির্বাচনে যথাক্রমে ১৬২ ও ২৬৪ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়ে যায়। নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে ইয়াহিয়া খান বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিনন্দন ও ৩রা মার্চ ‘৭১ তারিখে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেন। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আনন্দের বাতাস বইতে থাকে।

১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়টি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনাবহুল অধ্যায়। এর মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে নতুন পথ দেখায়। কোন প্রকার কাগজী সহায়তা ছাড়া আঠারো মিনিটের যে বক্তৃতা তিনি করলেন, তা রীতিমতো যুদ্ধের অপারেশন অর্ডার। যেন আজ তিনি এক গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞ সেনাপতি হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছেন। বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, কণ্ঠের উত্থান-পতন সবই ছিল চুম্বকের ন্যায়, আকর্ষণীয় মন্ত্রমুগ্ধকর এবং সর্বোপরি সময়োপযোগী। শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র নিয়ে শঙ্কিত শেখ মুজিব বলেন, ‘‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল... আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, রাস্তা-ঘাট যা কিছু আছে, তোমরা সব বন্ধ করে দেবে... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’’ বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সবুজ সংকেত দিয়ে দিলেন।

৮ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নির্দেশ বাঙালিরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ চালাতে থাকে পাশাপশি চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি। ১৬ মার্চ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সাংবিধানিক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনা শুরু করলেও শেখ মুজিব প্রতিপক্ষের মুখচ্ছবি দেখে মনের সম্পূর্ণ চিত্রই পড়তে পারছিলেন যে আলোচনার নামে ইয়াহিয়া-ভুট্টো কালক্ষেপন করছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করলে শেখ মুজিব বুঝতে পারেন তার অনুমানই সত্য। তিনি দ্রুত তাঁর সহকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া, আক্রান্ত হলে তাদেরকে সীমান্ত অতিক্রম এবং ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার বিস্তারিত দিক নির্দেশনা দিয়ে বিদায় করেন। কিন্তু নিজে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে ৩২ নম্বরেই থেকে যান।

২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং তাঁকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হলেও নয় মাস যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি ছিলেন বাঙালির চেতনায় উপস্থিত। তাঁকে ফাসিঁ দেয়ার সবরকেমের আয়োজন ও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। সত্য ও ন্যায়ে অবিচল অটল শেখ মুজিব সেদিন দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন “ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলবো আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা”। পাকিস্তানে বন্দী থাকলেও তিনিই ছিলেন যুদ্ধের মূল শক্তি, অনুপ্রেরণাদাতা এবং প্রাণ পুরুষ। ভয়াবহ রক্তক্ষয়, অসহনীয় দুর্ভোগের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় হয়েছে হাজার বছরের পরাধীন জাতির। বুক টান করে দাঁড়িয়েছে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরদর্পে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন এ মহানায়ক।

যুগে যুগে অসংখ্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ও নেতার জন্ম হয়েছিল এই দেশে: কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানই কেবল হেমিলনের বংশীবাদকের ন্যায় এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যে মোহনায় নিয়ে এসেছিলেন, সেখানেই সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বাধীনতার। জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। অতএব সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালিদের মুক্ত করতে এই বাংলায় প্রেরণের জন্য। এই দেশের যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির জন্য বারবার যেন জন্ম হয় শেখ মুজিবুর রহমানের।

স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসষÍুপ থেকে বাংলাদেশকে তুলে আনতে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। ক্ষুধা, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেন তিনি। প্রবর্তন করে ছিলেন ‘সবুজ বিপ্লব’ কর্মসূচী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের মদদপুষ্ট কতিপয় উচ্চাভিলাষী, পথভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্যদিয়ে তাঁর সে অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ পথ হারিয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে চলতে শুরু করে। স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি রাজাকাররা আবার পুনর্র্বাসিত হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় এবং স্বৈরাচার ও সামরিক জান্তার কবলে পড়ে দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যে নিমজ্জিত হয়।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শেখ হাসিনার জীবনে যে দুঃসহ বেদনা এনে দিয়েছে, এই শোক তাঁকে শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল করেছে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে। সেই বেদনাকে সঙ্গী করে দেশী-বিদেশী সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তিনি তাঁর পিতার অসমাপ্ত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। আজ তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বদরবারে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আগামীতে আত্মজার হাতে পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স¦প্ন সফল হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশ পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াবে-এই বিশ্বাস আমাকে অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশ আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক, সম্মানিত সদস্য চাঁদপুর প্রেসক্লাব।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়