প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
প্রবীণ ভাবনা ও বাতিল সংস্কৃতি
আজকের প্রবীণরা যখন তরুণ ছিলেন তাদের অধিকাংশের ভাবনা ছিলো একটা চাকরি জোটানো। চাকরির বাজার ছোট থাকায় অনেকেই আশানুরূপ চাকরি পান নি। উপায়হীন সাহসী তরুণরা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে কেউ সফল, কেউ ব্যর্থ, কেউবা কোনোরকমে টিকে রয়েছেন। এই প্রবীণদের শৈশব-কৈশোর, যৌবনে থাকা-খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদের সঙ্কট ছিলো।
|আরো খবর
শৈশব-কৈশোরে ভাই-বোনদের সাথে খাবার-দাবার, বইপত্র, বিছানা, কাপড়-চোপড় ভাগাভাগি করেছেন। জামা-জুতা ছোট হলে ছোটরা পেত। বড় ক্লাসে উঠলে ছোট ক্লাসে থাকা ভাই-বোনরা বই পেত। নতুন বই কেনা অনেক পরিবারের পক্ষে সম্ভব হতো না। বাড়ির সবাই মিলে ছেলে-মেয়েদের জন্য লজিং মাস্টার রাখতেন।
এগিয়ে থাকা তরুণরা বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সুযোগ পেত। এই তরুণরা হলে-মেসে থেকে টিউশনি করে পড়াশোনা চালিয়ে যেত। হলে-মেসে মানসম্মত খাবার পাওয়া কঠিন ছিলো। বাড়ি থেকে যার টাকা আগে আসতো তিনি অন্যদের ধার দিতেন। শার্ট-প্যান্ট, জামা, জুতা রুমমেটদের সাথে ভাগাভাগি করে পরতে হতো। বই, নোট, টিউশনির ব্যবস্থা করে একে অপরকে সহযোগিতা করতো।
জেলা শহরে তুলনামূলক কম মেধাবী, আর্থিক সঙ্কটে থাকা তরুণরা স্নাতক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করতো। পাসের হার কম থাকায় অনুত্তীর্ণদের মধ্য থেকে কেরানী, স্কুলশিক্ষক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দিতে পারতো। স্নাতক উত্তীর্ণরা তুলনামূলক ভালো চাকরি পেত।
পঞ্চাশ বছর আগের তরুণদের বড় একটি অংশ বাতিল সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে উঠে।
তারা পুরাতন চিন্তা-চেতনা-রুচি সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আনতে চাইলো। সমাজ পরিবর্তনের নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা সামনে নিয়ে আসলো। আরেকদল তরুণ সমাজের চলমান চিন্তা-চেতনা, রুচি-সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ একদল বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার করে চলমান রাখতে চেয়েছেন আরেক দল সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে লড়াই জারি রেখেছেন।
শেষ পর্যন্ত ৫০বছর আগের তরুণরা প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে তাঁদের সময়কালকে স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। জীবনযুদ্ধে তাদের লড়াই সংগ্রামকে মহিমান্বিত করার জোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের যাপিত শৈশব-কৈশোর, যৌবন কতটা রঙিন আনন্দের, লড়াই-সংগ্রামের ছিলো তা তুলে ধরেন। সমাজে মেনে চলার, মানিয়ে নেয়ার সংস্কৃতি জোরদার হতে শুরু করে। সংসারে সমাজে রাষ্ট্রে ছাড় পাবার এবং ছাড় দেবার মানসিকতা গড়ে উঠতে থাকে। সম্পর্কের টানাপোড়েনকে মেডিটেশন, ইয়োগা, ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তির কষ্ট উপশমের নানান প্রচেষ্টা জনপ্রিয় হতে থাকে। যেসব কারণে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয় সে কারণের আমূল পরিবর্তন করতে গেলে সম্পর্ক টিকে না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে নানান রকমের উদ্যোগ নিতে হয়। এক সময় বিয়ের পর বিশেষ করে মেয়েদের বলা হতো, এক আগুনে এক পানিতে সিদ্ধ হওয়া ভালো। অর্থাৎ স্বামী যেমনই হোক না কেন তার সংসার করতে হবে। সংসার ভেঙ্গে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোষ নারীর ওপর চাপানো হতো। স্বামীর সংসার করতে না পারা নারীর প্রতি চরম অবহেলা করা হতো। দাম্পত্য টিকিয়ে রাখার জন্য বান-টোনা, ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ, পীর-ফকির, মাজার-মন্দিরের সাহায্য গ্রহণ ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সন্তান জন্মদানের লক্ষ্য ছিল দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পেয়ে সুদিন আসবে এই আশায়।
যোগাযোগ মাধ্যম টেলিফোন নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হাওয়া ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। লাইনম্যান, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, টেলিফোন বিল, ক্রস কানেকশন, টেলিফোনে চাঁদাবাজি, হুমকি অনেকে ভুলে যান নি। সেইসব সংকট নিরসনে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। সংকট নিরসন হয়েছে মোবাইল কোম্পানির আগমনে, অর্থাৎ পুরানো ব্যবস্থা বহাল রেখে সংকট নিরসন করা যায় না।
ডাক বিভাগের চিঠিপত্র বিলি বন্টন, টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ছিলো।
সংকট নিরসন হয়েছে ই-মেইল, কুরিয়ার সার্ভিস, ইএফটিসহ উন্নত পদ্ধতি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে।
রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক লড়াই-সংগ্রাম, বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া হয়েছে। শাসক শ্রেণী চাহিদা অনুযায়ী দাবি পূরণ করে নি। এখন বেসরকারি টেলিভিশন, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটার, প্রিন্ট মিডিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশিত হয়ে যায়। বলতে গেলে কোন ঘটনা আর গোপন থাকছে না।
আমাদের নতুন প্রজন্ম বাতিল সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে বলে আমার ধারণা। নতুন প্রজন্ম যেসব বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করে, কষ্ট পায় সেসব বাতিল করে দিচ্ছে। তারা আর খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। গড়ে ওঠা সম্পর্ক বোঝা হয়ে গেলে নতুন প্রজন্ম সেটা আর বয়ে বেড়াতে রাজি না। কোনো কিছু ভালো না লাগলে তা মুখের উপর সরাসরি বলতে পারে। বাবা-মা যেভাবে সন্তানকে পরিচালিত করতে চান সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। এখন তরুণদের একটা অংশ বাবা-মার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
প্রেম, ভালোবাসা, দাম্পত্য, সন্তান লালন-পালনে নারী-পুরুষ কেউই নির্যাতন, চাপ, বাধ্যবাধকতা পছন্দ করছে না। ব্রেক আপ, তালাক খুব-ই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। সমাজ এবং ধর্ম যৌনতাকে যে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আটকে রেখেছে সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। পুরানো মূল্যবোধ তরুণদের কাছে ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তরুণদের মধ্যে বিয়ে না করার প্রবণতা যেমন বাড়ছে, একই সাথে সন্তান নেবার প্রবণতা কমছে। একটা সময় ছিল রাত দশটা বাজলে ঘুমিয়ে পড়তে হতো, এখন দেশের অধিকাংশ তরুণ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। মোবাইল ইন্টারনেটের আসক্তি নিয়ে অনেক সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু করোনার সময় উল্টো শিশু কিশোরদের হাতে তো মোবাইল, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট দিয়ে শিক্ষাজীবন সচল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণের নতুন পরিস্থিতি বর্তমান। তরুণদের বড় অংশ নিয়ম করে কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নন। ক্লাসে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক না হলে উপস্থিতি হতাশাজনক হয়ে পড়তো। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ প্রচ- প্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে। তরুণদের যে অংশ কৃষক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তারা সংসারের যাঁতাকলে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিদেশে কর্মরত তরুণ শ্রমিকরা কঠিন পরিশ্রম করে বৈদেশিক উপার্জন করছে কিন্তু সম্মান প্রাপ্তির ঘাটতি আছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে রয়েছে তারা নানান ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
আমাদের আজকের প্রবীণরা যখন নবীন ছিলেন তখন তাদের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে তার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ বর্তমান প্রজন্মকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন নবীনরা দ্রুত আয়ত করে ফেলেছে। অতীতের সাফল্য, ব্যর্থতা, অর্জন, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস মোবাইল ফোনে এক মুহূর্তে জানার সুযোগ রয়েছে। ফলে প্রবীণের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, বুদ্ধি, বিবেচনা, বুঝতে পারা খুব জরুরি কোনো বিষয় নয়। প্রবীণদের একটি অংশ নবীনদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তারা মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম ঠিক পথে নেই। প্রবীণদের মধ্যে অনেকেই ভাবতে পারছেন না যে, নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি কে ব্যবহার করে পৃথিবীর বর্তমান চেহারা পাল্টে দিতে পারে। মানুষের বসবাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী নতুন প্রজন্ম আমাদের উপহার দিতে পারে।
জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার পৃথিবীর বর্তমান সংকটকে গৌণ করে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র সমাজ গড়ে উঠতে পারে। একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রে বা সমাজে প্রবীণরা সবার সাথে সম্মান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁরা বুঝতে পারবেন নতুন প্রজন্ম পুরানো চিন্তা-ভাবনা, জীবন-যাপন বাতিল করে স্বস্তিদায়ক মর্যাদাপূর্ণ মানবজীবন উপহার দিয়েছে।
নতুন প্রজন্ম সকল অনিয়ম, দুর্নীতি নিপীড়ন নির্যাতনকে বাতিল করে দিবে। তারা আপোষ সংস্কৃতিকে না করে বাতিল সংস্কৃতির দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে এগিয়ে আসছে। আজ যেটাকে আমরা বিশৃঙ্খলা বলে মনে করছি একদিন সেটাই হবে কাক্সিক্ষত শৃঙ্খলার পূর্ব শর্ত।
লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম।