মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০৮:২৫

বাংলা গান : প্রবীণের মনপ্রাণ

হাসান আলী
বাংলা গান : প্রবীণের মনপ্রাণ

বাংলা গান প্রবীণদের জন্যে স্মৃতির সেতু, জীবনীশক্তি, মনের খোরাক, আত্মার আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। গান প্রবীণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে, জীবনের প্রতি ভালোবাসা জাগায় এবং অন্তরে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করে। গান মনে করিয়ে দেয় জীবনের গভীরতা, যোগায় সাহস, দেয় আনন্দ এবং দেয় প্রেরণা নতুন করে বাঁচার।

প্রবীণরা সেই সব গান বেশি শুনে, যাতে অভিজ্ঞতা, আবেগ, স্মৃতি, আধ্যাত্মিকতা এবং জীবনের অর্থের সঙ্গে বেশি মিলে যায়। বাংলাদেশের প্রবীণরা স্মৃতি মধুর, আধ্যাত্মিক, দেশাত্মবোধক, বাউল গান, লোকগানের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেন।

বয়স ভাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গান শোনার রুচি ও চাহিদা বদলে যায়। প্রবীণদের জন্যে সংস্কৃতি চর্চায় এমন গান শুনতে এবং গাইতে উৎসাহ দিলে মানসিক এবং সামাজিকভাবে তাদের গুণগত মান বাড়িয়ে দেয়।

নিচের কয়েকটি গান প্রবীণদের মধ্যে জনপ্রিয় বলে মনে হয়েছে--

১. ‘বুড়ো হয়ে গেছি’।গানটি রুদ্র রায়ের গাওয়া একটি গভীর আবেগময় এবং আত্মান্বেষণধর্মী বাংলা গান। যেখানে বয়স, সময়, নিঃসঙ্গতা এবং স্মৃতিময়তা উঠে এসেছে। এই গানে একজন প্রবীণ মানুষের আত্মবোধ, বিষণ্নতা, অতীত স্মৃতি আর বর্তমানের নিঃসঙ্গতার এক অসামান্য ছবি ফুটে উঠেছে। গানটি সময়ের নিষ্ঠুরতার কথা বলে। কীভাবে সময় আপনজন, কাছের মানুষ, শক্তি, সাহস, আনন্দ সব কিছু কেড়ে নেয় তার বর্ণনা।

২. ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতাটি পরবর্তীতে গান হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি মরতে চান না, কারণ এই পৃথিবী অনেক সুন্দর। এই প্রেম শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি নয় বরং মানুষের জীবনের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি, সমাজের প্রতি।

জীবন একাকী নয়, মানুষের মাঝে, সমাজে, সম্পর্কের ভেতর জীবন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছে।

৩. ‘ভয় কি মরণে’।এই গান হলো কাজী নজরুল ইসলামের এক অমর প্রবীণ চেতনার গান। যেখানে রয়েছে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সত্যকে আঁকড়ে ধরার বীরত্ব; বয়সের গণ্ডি পেরিয়ে জীবনের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। প্রবীণ আত্মায় মহত্ত্ব, সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে নতুন উপলব্ধি। জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে গিয়েও মানুষ হার মানে না, বরং আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

৪. ‘প্রভাত তোমারই জন্যে’। এই গানটি দেব জ্যোতি মিশ্রের কণ্ঠে দারুণ ভালো লাগে। সেই ভোর নিজের জন্যে নয় অন্যের জন্য। এই গানটি যেন সেই প্রবীণের, যিনি নিজে অনেক কিছু দেখে বুঝেছেন এবং এখন নিজের আলো, সময়, ভালোবাসা দিয়ে নতুন কাউকে জাগাতে চান।আত্মত্যাগ, সময়ের উপলব্ধি, নতুন প্রজন্মের প্রতি গভীর ভালোবাসা, নিজেকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে যুক্ত হবার প্রয়াস। ‘আমি নই-আমি নই-তুমি’ এখানে প্রবীণ জীবনের আত্মবোধ সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রকাশ পায়। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে সামনে রাখা আত্ম বিলুপ্তি নয়, বরং আত্মমুক্তি।

৫. ‘মরে যাব তবু মুখ ফুটে কিছু বলবো না’। কবির সুমনের কণ্ঠে চমৎকার স্বাদ পাওয়া যায়। চিৎকার, রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ, নালিশ নয় বরং নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, নীরব থাকা-- এটা প্রতিবাদ।

৬. ‘মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম’। এই গানটি ফকির আলমগীরের কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। মায়ের প্রতি ভালোবাসা এবং দায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

৭. ‘ও তুমি জিন্দা থাকতে একমুঠো ভাত দাও নাই বাবা মার মুখে/মরলে খাওয়ায় পাড়ার লোক ডেকে’। এই গানটি তাপস বিশ্বাসের কণ্ঠে অন্তর ছুঁয়ে যায়।

৮. ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, উড়ে যায় আকাশে ঝলমলে।’ গানটি ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে সাড়া জাগিয়েছে। এখানে মানুষকে ‘রঙিন ফানুস ‘ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা জীবনের রঙিন অথচ ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোর প্রতীক। গানটিতে মানুষের জীবন ও সম্পর্কের মায়াময় অথচ ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে তুলে ধরে।

৯. ‘ভালো আছি ভালো থেকো’।

চিঠি লেখো নিয়মিত,

তোমার সেই চিঠি পড়ে

কেটে যায় একেকটা দিন।’ এই গানটি নচিকেতার কণ্ঠে দারুণ আবেগ সৃষ্টি করে।

গানের নিচের লাইনগুলো প্রবীণ জীবনকে তুলে ধরে।

‘চুলে পাক ধরেছে জানিস্,

হাঁটার সময় পা কাঁপে,

তবু আমি চলি একা।”

১০. ‘বাবা কতোদিন দেখি না তোমায়’। প্রিন্স মাহমুদ রচিত জেমসের কণ্ঠে এই গান তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। এই গান বাবাকে কেন্দ্র করে হারানো বেদনা, স্মৃতি আর স্নেহকে এতো সরল ও আবেগময়ভাবে তুলে ধরে যে, এটি পরিবারের সঙ্গে শ্রোতাদের মানসিক বন্ধনকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।

জেমসের কণ্ঠে ‘মা’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়, কালজয়ী, আবেগঘন। এই গানটি মায়ের স্নেহ, হারানোর বেদনা এবং পারিবারিক আবেগের এক অম্লান প্রতীক।

১১. ‘আবার আসিবো ফিরে’ সত্যজিৎ রায়ের গাওয়া এই গানটি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে জন্মভূমিতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা প্রবীণতার এক মর্যাদাপূর্ণ অনুভূতি।

১২. ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। মান্না দের কণ্ঠে এই গান দারুণ আবেগ সৃষ্টি করেছে। জীবনের যাত্রা চলুক অবিরত। প্রবীণ বয়সেও নতুন অভিজ্ঞতা ও আনন্দের প্রত্যাশা থাকে। এতে বয়সকে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

১৩. ‘একবার বিদায় দে মা’। গানটি হেমন্ত কুমার মুখোপ্যাধায়ের কণ্ঠে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে নতুন পথে যাত্রা। এখানে মা প্রবীণতার প্রতীক, যার আশীর্বাদ সন্তানদের জীবনের পথপ্রদর্শক। প্রবীণ মায়ের মর্যাদা এখানে শীর্ষ স্থানে।

১৪. ‘বাবা বলে ছেলে বেলা’। গানটি অনুপ ঘোষালের গাওয়া একটি হৃদয় স্পর্শী গান যা প্রবীণ জীবনের বিভিন্ন দিককে সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরে। প্রবীণ জীবনের মর্যাদা তাদের ভূমিকা এবং পারিবারিক বন্ধনের গভীরতা এতে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলা গান স্মৃতি, অতীত মগ্নতা, নিঃসঙ্গতা, সন্তানহীনতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কের ভাঙ্গন, প্রেম, ভালোবাসা, বার্ধক্য, মৃত্যু, মর্যাদা, সম্মানকে তুলে ধরে। বাংলা গান প্রবীণ জীবনের এক অমূল্য সম্পদ।

হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়