প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৩, ০০:০০

গ্রেট ব্রিটেনের রাজকবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসনের একটি বিখ্যাত কবিতার নাম 'হোম দে ব্রট হার ওয়ারিয়র ডেড'। এ কবিতার সারমর্ম হচ্ছে : দেশের জন্যে জীবন দেয়া কমবয়সী যোদ্ধার লাশ আনা হলো তার বাড়িতে। অকাল বিধবা হওয়া তার স্ত্রী শোকে পাথর হয়ে গেলেন। তিনি কেঁদে, বিলাপ করে কিংবা অন্য কোনোভাবে তার শোক প্রকাশ করছিলেন না। এতে চারপাশে ভিড় করা লোকজন উদ্বিগ্ন হলেন। তারা ভাবলেন, গভীর শোকে বাকরুদ্ধতায় এই বিধবার মৃত্যু হতে পারে। এমন সময় নব্বই বছর বয়সী এক নার্স তার অভিজ্ঞতার আলোকে মৃত যোদ্ধার ঔরসজাত শিশু সন্তানকে ওই বিধবার হাঁটুর ওপর রাখলেন, যাতে তার মাতৃত্ব জাগ্রত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোকস্তব্ধতা কাটিয়ে বিধবা অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন, হে প্রিয় বৎস! তোমার জন্যেই আমার বেঁচে থাকতে হবে।
শাহরাস্তি উপজেলায় একইভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন এক নারী। যিনি শুধু অকাল বৈধব্যই বরণ করেননি, দুর্ঘটনায় একই সাথে হারিয়েছেন নাড়িছেঁড়া ধন দু সন্তানকে। তারতো শোকে পাথর হয়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু না, তিনি সেটি হলেও বেঁচে থাকার এক কষ্টকর লড়াই করছেন শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্যেই। গত শুক্রবার তার হৃদয়বিদারক জীবন সংগ্রাম নিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন লিখেছেন চাঁদপুর কণ্ঠের শাহরাস্তি ব্যুরো ইনচার্জ, শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মোঃ মঈনুল ইসলাম কাজল। তিনি লিখেছেন, ১৫ বছর ধরে খাঁচায় বন্দি প্রতিবন্ধী পুত্র ফাহাদ। সোয়া দু বছর আগে হয়েছে স্বামীর মৃত্যু। দেড় মাস আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু ঘটেছে দু সন্তানের। তবুও প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন নাছিমা বেগম। জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী তার ২৩ বছর বয়সী বড়ো সন্তান আঃ আজিজ ফাহাদ। হাঁটা চলা সহ কথাও বলতে পারে না সে। ছোট থেকে বড় হওয়ার পর এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে ক’বার পুকুরে পড়ে গিয়েছিল। বড় হওয়ার সাথে সাথে পরিবারের সদস্যরা তাকে ঘরে আটকে রাখতে না পেরে ঘরের ভেতরে খাঁচায় বন্দি করে রাখছে। প্রায় ১৫ বছর যাবৎ সে লোহার খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তার এলোমেলো ডাকে ছুটে আসেন মা নাছিমা বেগম। পরিবারের পক্ষ থেকে জন্মের পর চিকিৎসা করা হলেও বর্তমানে নাছিমা বেগম স্বামী-সন্তান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০২০ সালে চার সন্তানের জননী নাছিমা বেগমের বড় মেয়ের বিয়ে হলে হাজীগঞ্জ উপজেলার বলাখালের রামপুর এলাকায় স্বামীর বাড়িতে চলে যায় এবং সেখানে বসবাস করছে। তারপর হঠাৎ করেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় নাছিমা বেগমের সংসার। সাজানো গোছানো সংসার নিমিষেই তছনছ হয়ে যায়। স্বামী ছিলেন শাহরাস্তি উপজেলার ঠাকুর বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহজাহান ভূঁইয়া। ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিন সন্তান নিয়ে জীবন যুদ্ধ শুরু করেন নাছিমা বেগম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! চলতি বছরের ১৮ মার্চ নিজ বাড়িতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নাছিমার দুই সন্তান (১৬ বছর বয়সী ফাহিমা আক্তার ও ৬ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী আঃ রহমান) মৃত্যুবরণ করে। সেই থেকেই একা হয়ে পড়েন নাছিমা বেগম। শাহরাস্তি পৌর এলাকার ১নং ওয়ার্ডের উপলতা ভূঁইয়া বাড়িতে স্বামীর ভিটায় অসুস্থ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে জীবনযাপন করছেন নাছিমা বেগম। চোখে মুখে শুধুই অন্ধকার। স্বামীর ঋণ ও সংসার চালাতে প্রতিদিনই বোঝা বাড়ছে তার। হতাশার চাদরে ঢাকা নাছিমা বেগম জানান, ১০ লাখ টাকার ঋণ মাথায় নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। ঘরে প্রতিবন্ধী সন্তান ও স্বামীর সম্মানের দিকে তাকিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারছেন না। দিনদিনই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বসতঘরটি। আশপাশের দু-একজন ও বাবার বাড়ি থেকে মাঝেমধ্যে সহযোগিতা নিতে হয় তার। প্রতিবন্ধী ফাহাদ দিনভর লোহার খাঁচায় বন্দি থেকে রাতে মায়ের আঁচলের নিচে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেও নাছিমা বেগমের চোখে মুখে শুধুই অন্ধকার। কতোটা রাত তার নির্ঘুম কেটেছে সেই হিসেব জানা নেই তার। জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া স্বামী ও আদরের দুই সন্তানের স্মৃতি বুকে নিয়ে প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন নাছিমা বেগম। সমাজের সচেতন মহল ও সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় আলোর মুখ দেখতে পারে নাছিমা ও ফাহাদের জীবন।
আমরা জানি না নাছিমা বেগম বিধবা ভাতা এবং তার পুত্র ফাহাদ প্রতিবন্ধী ভাতা পান কি না। যদি না পেয়ে থাকেন, শাহরাস্তি পৌরসভার সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের ত্বরিৎ উদ্যোগে মেয়র মহোদয় আশা করি সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে এ দুটি ভাতার ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন সর্বোপরি স্থানীয় এমপি মহোদয় এবং চিত্তবান বিত্তবান প্রতিটি মানুষ বিধবা নারী নাছিমা বেগমের পাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ানো উচিত বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় শোক ও ঋণের ভারে একসময় ভেঙ্গে পড়তে পারেন এই নারী এবং কোনো একদিন সকলের অগোচরে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারেন কিংবা অপ্রকৃতিস্থও হয়ে যেতে পারেন। এমনটি নিশ্চয় কারো কাম্য হবে না। ভুপেন হাজারিকার কালজয়ী গান 'মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?'-এর আলোকে সংবেদনশীল মানুষরা এগিয়ে আসলে নাছিমা বেগমের বেঁচে থাকার লড়াই সফল হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।