সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

আমাদেরকে মনেপ্রাণে বাঙালি হয়ে উঠতে হবে
অনলাইন ডেস্ক

পহেলা বৈশাখ সর্বজনীন বাঙালির আবহমানকালের উৎসব। বাংলা নববর্ষ বরণ বাঙালির প্রাণের উৎসব। নিজেকে বাঙালি বলার মধ্যে যে আত্মশ্লাঘা অনুভূত হয় তার উৎস নিহিত আছে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের মতো আনন্দযজ্ঞে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ কিংবা ধর্মীয় অনুষঙ্গে জাতপাত ভেদকে পহেলা বৈশাখ নাকচ করে আসছে আবহমানকাল থেকে। এই বাঙালিয়ানার জোরেই আমরা টিকে আছি হাজার বছর। কোনো উছিলায় বাঙালির এ উৎসবকে পাশ কাটানোর কিংবা খর্ব করার সুয়োগ নাই। গ্রামীণ জনপদ কিংবা পার্বত্য ভূমি, শহর-নগর কিংবা সুরম্য অট্টালিকা, বাংলার মাটির সর্বত্রই পহেলা বৈশাখের আবেদন অনস্বীকার্য ও অপরিহার্য। কৃষিভিত্তিক বাঙালি গ্রামীণ সমাজে এক সময় নতুন ফসল ঘরে উঠলে তথা অগ্রহায়ণ মাসের নবান্ন দিয়ে বরণ করা হতো নতুন বছরকে। কিন্তু মোগল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাঙালিকে পহেলা বৈশাখে নববর্ষ বরণে উদ্বুদ্ধ করেন। নববর্ষ বরণ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করার মাধ্যমে জাতীয় চেতনায় সম্মিলিত করে গ্রামীণ হতে শহুরে সকলকে। ঘরে ঘরে ভালোমন্দ খাদ্যের আয়োজনে, মেলা ও জমায়েতে পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠে অবর্ণনীয় আনন্দের। বৈশাখী মেলায় পুতুল-মুড়ি-মুড়কি-মুরলি ও নাগরদোলা-চরকির আনন্দ আজো মাতিয়ে তোলে বড়ছোট সবাইকে। মৃৎশিল্পের নানারঙে নানা আলপনায় সজ্জিত কলস ও বিবিধ মাটির পাত্র আমাদের আবহমান ঐতিহ্য। মাটির টমটম, বাঁশি-ঢোলের আওয়াজ আমাদের জানিয়ে দেয় নতুন বছরের আগমনী। সবার গায়ে উঠে যথাসাধ্য নতুন পোশাক। কিছুদিন আগেও গ্রামের মা-বোনেরা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সাংবাৎসরিক পোশাক-পরিচ্ছদ বানিয়ে নিতো। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ্বে আজকাল বিদেশি সংস্কৃতি এসে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির দৌরাত্ম্যে আমবাঙালি আজ রুচির বিকৃতায়নে মেতে উঠেছে। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুলভ প্রবেশগম্যতার কারণে সহজ পথে তারকা হতে গিয়ে সোঁদা মাটির সংস্কৃতিকে অসম্মানিত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়াররূপে ব্যবহারের কারণে বাঙালি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিধিকে পারস্পরিক সাংঘর্ষিক অবস্থানে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে কথায় কথায়। একদিকে ধর্মভীরু মানুষের বোধ আর অন্যদিকে নিজ জন্মভূমির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক চেতনা, এই দুই অনুষঙ্গকে বলির পাঁঠা বানিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতির লুটেরাদের উন্মাদনায় বাঙালিয়ানা হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর সাথে অবশ্য কর্পোরেট বেনিয়াদেরও কূটকৌশল কম নেই। ফলে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ পুনরাবর্তিত হওয়ার প্রাক্কালে আমরা চাপান-উতোরের মকশো দেখি। এতে কার কী লাভ হয় জানি না, তবে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা হীনবল হয়ে পড়ছি। বিশ্বমানব হতে হলে যে শাশ্বত বাঙালি হয়ে ওঠা প্রয়োজন এবং তা সর্বার্থেই, এ কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি। জাতি হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে কখনোই নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো না, সে যতই অর্থনৈতিক উন্নতি আসুক না কেন।

ধর্মীয় মূল্যবোধেই বলি কিংবা বাঙালি চেতনাতেই বলি, সৎ ও সাধারণ হওয়াটাই মুখ্য। কিন্তু সেদিকে কারোই খেয়াল নেই। আমরা সবাই অসৎ ও অসাধারণ হওয়ার প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব লড়ছি অহেতুক। অথচ একদিন মানুষ বলতো, বাঙালি আজ যা চিন্তা করে, অন্যরা তা আগামীকাল মাথায় আনে। এই বাঙালি আজ হতবল কেবলমাত্র জাতীয় জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন ও বাঙালি চেতনাকে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কারণে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আমাদের জরুরি। রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আমাদের যেমন চেতনার সঙ্কট দূর করে, তেমনি সর্বার্থেই সঠিক ধর্মাচরণ আমাদের সবার জন্যে প্রযোজ্য। যে যার অবস্থানে থেকে খাঁটি ও সত্যকে আঁকড়ে ধরলে সুন্দরের আবাহন অনিরুদ্ধ হয়ে জানান দিবে।

বিগত কয়েক বছর আমরা করোনার চোখ রাঙানিতে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলাম। অতিমারির দৌরাত্ম্যে আমাদের উৎসব হয়ে পড়েছিল ঘেরাটোপে বন্দি। এবার সে অবস্থার উত্তরণ ঘটেছে। প্রাণে প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে আজ আমরা হয়ে উঠবো প্রাণবন্ত। আজ আমাদের নৈতিক সংযম অটুট রেখে চেতনার রঙে রঙিন হওয়ার দিন। পহেলা বৈশাখ কেবল একটি দিনমাত্র নয়, বরং এটি একটি পবিত্র অনুভূতি। আমরা যে বাঙালি, আমাদের শেকড় যে এ মাটির গভীরে তা হতে অনুধাবনের দিন হলো পহেলা বৈশাখ।

এবারের বৈশাখ তাপ-প্রবাহ নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে আসবে বাঙালির মৃত্তিকামঞ্চে। কাজেই দাবদাহ মোকাবেলার সাবধানতা নিয়েই শোভাযাত্রা ও রাজপথে নামা জরুরি। দিন যতই গড়াচ্ছে আমাদের জানা ও জ্ঞান চর্চা ততই ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল পথনির্দেশে চলছি। প্রগতির প্রধান বাহন হলো সুন্দরের চর্চা ও সুন্দরকে লালন করা। অথচ আমরা দিনকে দিন সুন্দরকে বাধা দিয়ে মুকুলে মেরে ফেলাটাকেই প্রধান কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছি। ফলে সম্প্রীতি নয় বিভেদ, ঐক্য নয় ফাটলেই আমরা পড়ে রয়েছি। আমাদের এ অবস্থা হতে উত্তরণ ঘটাতে হবে। তবেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সার্থকতা তৈরি হবে। ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা’ বলে যে আশাবাদ আমরা ব্যক্ত করি প্রতিবছর, তাকে বাস্তবায়িত করার ভার আমাদেরকেই নিতে হবে। পহেলা বৈশাখের সার্থকতা কেবল নতুন পোশাকে নয়, নয় কোনো অনুষ্ঠানসর্বস্বতায়। আমাদের মনেপ্রাণে বাঙালি হয়ে উঠতে হবে। মাটির সানকিতে একদিন পান্তা খেলেই যেমন বাঙালি হওয়া যায় না, তেমনি ধর্মব্যবসায়ীর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে বাঙালি চেতনাকে ঠেকিয়ে দিলেই কাঙ্ক্ষিত পরকাল নিশ্চিত হওয়া যায় না। জীবনের সর্বস্তরে মনুষ্যত্ববোধ, বাঙালিয়ানার শাশ্বত চেতনা ও ধর্মীয় উদারতার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেই আমাদের সকল আয়োজন লাভ করবে সার্থকতা।

সবাইকে ১৪৩০ বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছা। নতুন বছর সবার জন্যে নিয়ে আসুক সমৃদ্ধি ও কল্যাণ। অতীতের জীর্ণতা দূর হোক, কাঙ্ক্ষিত সুন্দরে ভরে উঠুক মানবিক বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়