সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

হাতে ভাজা মুড়ির বিলুপ্তি রোধ চাই
অনলাইন ডেস্ক

আমাদের জীবন এখন যান্ত্রিক বলেই যন্ত্র দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের প্রতি যেনো অনেক দুর্বলতা। কিন্তু এ দুর্বলতা সব ক্ষেত্রেই সঙ্গত নয়। খাদ্যপণ্যে বিশুদ্ধতার প্রশ্নে, স্বাদের প্রশ্নে, স্বীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্নে কখনও কখনও যান্ত্রিকতা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এটি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া মানুষ বোঝে না। সংস্কৃতিবান ও ঐতিহ্যসচেতন মানুষ বুঝলেও অনেক দেরিতে বুঝে, ততক্ষণে অনেক পিছিয়ে যেতে হয়। যন্ত্রে রাসায়নিক দ্রব্য বা কেমিক্যালের ব্যবহার অপরিহার্য, সেটা খাদ্য উৎপাদন বা অন্য যে কিছুই হোক না কেন। কৃষিপণ্য ও প্রাকৃতিক অনেক উপাদানকে প্রক্রিয়াজাত করে যন্ত্রের সাহায্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও চাহিদাবহুল খাদ্যপণ্য করা সম্ভব। কিন্তু যান্ত্রিকতায় সবক্ষেত্রে খাদ্যমান ও স্বাদ সঠিক রাখা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের জনপ্রিয় খাবার মুড়ির কথা উল্লেখ করা যায়। যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি কেমিক্যালযুক্ত মুড়ি আর হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদের মধ্যে পার্থক্য যে কোনো ভোক্তাই সহজে অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু যন্ত্রে উৎপাদিত সস্তা মুড়ির আধিক্যে হাতে ভাজা সুস্বাদু মুড়ি কোথাও কোথাও বিলুপ্তির পথে।

এই হাতে ভাজা মুড়ি নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি এমরান হোসেন লিটন পরিবেশন করেছেন একটি সরেজমিন প্রতিবেদন। গতকাল সোমবার তার এ প্রতিবেদনটি চাঁদপুর কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ‘ফরিদগঞ্জে বিলুপ্তির পথে গিগজ ধানের হাতে ভাজা মুড়ি ॥ দরকার সরকারি সহযোগিতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে তিনি লিখেছেন, আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জীবনমানের অগ্রগতির পথে আজ প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক কিছু বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এই হারানো ঐতিহ্যগুলোর অন্যতম হলো হাতে ভাজা গিগজ ধানের দেশি মুড়ি। গত কয়েক বছর পূর্বেও ফরিদগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম আলোনিয়া, পূর্ব আলোনিয়া, রূপসা, সুবিদপুর ইউনিয়ন ও গুপ্টি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম মুড়ির গ্রাম হিসেবে খ্যাত ছিলো। রমজান মাস আসলেই ওই গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই মুড়ি ভাজার ধুম লেগে থাকতো। গিগজ ধানের মুড়ি, যার খ্যাতি ছিল সর্বত্র। কিন্তু কালক্রমে যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির বাজার দখল হয়ে গেছে। উপজেলার ১১নং চর-দুঃখিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম আলোনিয়া গ্রামের ছৈয়াল বাড়ির পলাশ দাস বলেন, মুড়ি শিল্প বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। এ এলাকায় শত শত মুড়ি ভাজার লোক ছিলো। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে কোনোরকম সহযোগিতা এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরকম দান অনুদান না পাওয়ার কারণে ঐতিহ্যবাহী এই গিগজ ধানের মুড়ি হারিয়ে যাওয়ার পথে।

খোকন নামের একজন বলেন, এক সময় আলোনিয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই মুড়ি ভাজা হতো এবং এই গ্রামের মুড়ি দিয়ে আশপাশের উপজেলাগুলোতে মুড়ির চাহিদা পূরণ করা হতো। তিনি আরো বলেন, এখানে কয়েকটি পরিবার গিগজ ধানের হাতে ভাজা মুড়ি এখনও ভাজে। তার কারণ হলো, বাপ-দাদাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা এবং অন্য কোনো কাজ পারে না বিধায় সংসার চালানোর প্রয়োজন মিটানো।

বিনয় কৃষ্ণ দাস নামের একজন বলেন, ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা এই গিগজ ধানের মুড়ি অত্যন্ত সুস্বাদু। বর্তমান বাজারে সচরাচর যে মুড়িগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো কেমিক্যালযুক্ত এবং যান্ত্রিকভাবে তৈরি। কিন্তু আমাদের হাতে ভাজা গিগজ ধানের মুড়িতে শুধু আমরা লবণ ব্যবহার করি। এতে করে শারীরিক কোনো সমস্যা হয় না।

শীতল নামের একজন জানান, চাঁদপুর জেলায় বেশির ভাগ মুড়ির চাহিদা ফরিদগঞ্জের আলোনিয়া থেকে মেটানো হতো। অনেক কষ্টে মুড়ি ভেজে হাটে নিয়ে মুড়ি বিক্রি করতাম। তখন প্রচুর চাহিদাও ছিল। কিন্তু এখন ধানের দাম, চালের দাম, লাকড়ির দাম দুই-তিন গুণ বেড়ে যাওয়ায় এই মুড়ি শিল্প থেকে অনেকে সরে গেছে। জনপ্রতিনিধি ও সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোনোরকম সহযোগিতা পাই না বলে এখন এই শিল্প বিলুপ্তির পথে।

মুড়ি ভাজা ছেড়ে দেওয়া মদন চন্দ্র দাস বলেন, ‘এক মণ চালের মুড়ি তৈরি করতে ২-৩ দিন সময় ব্যয় হয়। বর্তমানে ধানের দাম বৃদ্ধি, পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত খড়ি ছাড়াও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি মুড়ি উৎপাদনে গড়ে খরচ হয় প্রায় ১০০ টাকা। হাতে তৈরি মুড়ি কেমিক্যাল মুক্ত, খেতে সুস্বাদু হয়। এছাড়া ৩০/৪০ দিন ঘরে রাখলেও এর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। মুড়ি শিল্পের কারিগরদের কথা, সরকারের একটু সহায়তা পেলে এই শিল্প বাঁচানো সম্ভব।

চাঁদপুর জেলায় হাজীগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের উচ্চঙ্গা গ্রাম ও মৈশাদী ইউনিয়নের পাল বংশের লোকজন হাতে ভাজা সুস্বাদু মুড়ি উৎপাদনের সাথে প্রাচীন কাল থেকেই জড়িত। যন্ত্র দ্বারা উৎপাদিত মুড়ির দাপটে এই হাতে ভাজা মুড়ি হারিয়ে যেতে বসলেও চাঁদপুরের প্রসিদ্ধ ঢাকা কনফেকশনারী এই মুড়ির বিপণনে গত দেড় দশক ধরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হামীম পাটোয়ারী ২০০৭ সাল থেকে উচ্চঙ্গার এ মুড়ি সংগ্রহ করে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্যাকেটজাত করে তাঁর বড়ো ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান ঢাকা কনফেকশনারীর ৭টি শাখার মাধ্যমে প্রধানত বিপণন করছেন। বাজারের অন্যান্য মুড়ির তুলনায় দামী হলেও এর রয়েছে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক। ফরিদগঞ্জের হাতে ভাজা মুড়ির বাজারজাতকরণ ও বিপণনে একজন হামীম পাটোয়ারীর মতো উদ্যোক্তা বড়োই প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারি অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ সহ সহজ শর্তের ঋণ নিয়ে ব্যাংক ও এনজিও'র পক্ষে ফরিদগঞ্জের হাতে ভাজা মুড়ির সাথে জড়িত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো অতীব প্রয়োজন।

বলা দরকার, চাঁদপুরের পার্শ্ববর্তী জেলা লক্ষ্মীপুরে বছরে ৫০০ টন হাতে ভাজা গিগজ ধানের মুড়ি উৎপাদন হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ মুড়ি বিদেশেও রপ্তানি হয়। এই মুড়ি লক্ষ্মীপুর জেলাকে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি ও খ্যাতি। চাঁদপুরের তেমন খ্যাতি আমরা চাই না, তবে এখানকার হাতে ভাজা মুড়ির কাজটি বিলুপ্ত না হয়ে অতি প্রয়োজনীয় আনুকূল্যে বেঁচে থাকুক সে প্রত্যাশা করছি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়