প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি উৎসব ও পুনর্মিলনী তথা প্লাটিনাম জুবিলি অনুল্লেখযোগ্য ত্রুটি ছাড়া গত ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্র ও শনিবার চাঁদপুর স্টেডিয়ামের বিশাল পরিসরে সুসম্পন্ন হয়েছে। এই জুবিলিতে অংশগ্রহণকারীরা যতোটা না আশা করেছিল তারচে’ বেশি পেয়েছে--এটা সমালোচকরাও যুক্তির আলোকে স্বীকার করতে হবে। চাঁদপুর কলেজ কেনো, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যে এমন জুবিলি বা অন্য যে কোনো উৎসব/ বড়ো ধরনের অনুষ্ঠান একদিনের ১২ ঘণ্টাব্যাপী অর্থাৎ সকাল ৯/১০টা থেকে রাত ৯/১০ টা পর্যন্ত আয়োজন যেখানে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে দুদিনব্যাপী এর চেয়েও বেশি সময় ও অনেক ব্যয়বহুল (প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে) কিছু করা এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের নিবিষ্ট করে রাখা অবিশ্বাস্য ব্যাপারই হয়ে যায়। তাই চাঁদপুর কলেজের প্লাটিনাম জুবিলি করতে গিয়ে আয়োজকরা স্মরণকাল শুধু নয়, স্মরণাতীতকালের মধ্যে অন্তত বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলে অনন্য, অসাধারণ মহাযজ্ঞ সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয়।
এই প্লাটিনাম জুবিলিকে ঘিরে আয়োজকদের ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার নমুনা বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকেই লক্ষ্য করা যায়। কলেজ প্রাঙ্গণকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে নিবন্ধিত অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় উপহার সংগ্রহের জন্যে। এই আমন্ত্রণেই বেলা ২ টার পর থেকে মধ্যরাত অবধি কলেজ প্রাঙ্গণ শত শত প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীর মিলনমেলায় পরিণত হয়। এ সময় কার আগে কে উপহার নেবে এমন প্রতিযোগিতায় কিছুটা আবেগিক বিশৃঙ্খলাও দেখা যায়। কিন্তু প্লাটিনাম জুবিলিকেন্দ্রিক কলেজের মোহনীয় রূপে এবং ছবি তোলার বহু স্পট পেয়ে মুগ্ধতায় কিছুটা আড়ালে পড়ে যায় বিশৃঙ্খলার বিষয়টি। আর উপহারেও ছিলো ব্যাপকতা! ট্রাভেল ব্যাগ, টি-শার্ট, মগ, চেস্ট কার্ড, খাবার কুপন, নিবন্ধনকারী সকলের চাররঙ্গা ছবিসহ সংক্ষিপ্ত তথ্য সম্বলিত বইরূপী ৪৮০ পৃষ্ঠার সুদৃশ্য ডিরেক্টরী (তথ্যপঞ্জি) ও ‘স্বর্ণস্মৃতি’ নামক ৩২৮ পৃষ্ঠার স্মারকগ্রন্থের স্লিপ। বলা বাহুল্য, জাতীয় মানের অনুষ্ঠানেও সাধারণত কাগজ বা কাপড়ের ব্যাগ, টি-শার্ট, মগ, চেস্ট কার্ড, খাবার কুপন, বিভিন্ন খাবারের মিনি প্যাকেট/ সাবান/ শ্যাম্পু/ টিস্যু এবং এ-ফোর সাইজের গতানুগতিক স্মরণিকা উপহারস্বরূপ অংশগ্রহণকারীদের দেয়া হয়। আর চাঁদপুর কলেজের প্লাটিনাম জুবিলিতে প্রাক্তন ২৫৯৮ জন শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ২০০০ টাকা, তাদের এক হাজার অতিথির মাথাপিছু ১০০০ টাকা ও বর্তমান আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ১২০০ টাকা নিবন্ধনের বিপরীতে দু হাজার টাকারও বেশি মূল্যের উপহার প্রদান এবং দুদিনে তিন বেলা অন্তত ৮০০ টাকা মূল্যের খাবারে আপ্যায়িত করার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের মাথাপিছু বাড়তি ব্যয় মিটানোর ক্ষেত্রে স্পন্সর জোগাড়ে আয়োজকদের সক্ষমতা অবশ্যই দক্ষতাপূর্ণ ছিলো। তবে বিনামূল্যে চা, কফি, স্যুপ, ¯œ্যাকস্ ইত্যাদি খাওয়াতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা কিছু কোম্পানির অব্যবস্থাপনায় উক্ত জুবিলিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কম-বেশি অসন্তোষ তৈরি হয় এবং কেউ কেউ তার উৎকট বহিঃপ্রকাশও ঘটায়। জুবিলি সুসম্পন্ন হবার পর যেটিকে নিতান্তই ‘চাঁদেরও কলঙ্ক আছে’ বলে পর্যবেক্ষক ও সমালোচকদের কাছে মনে হয়েছে। অবশ্য এ অঘটনটি অকপটে স্বীকার করে জুবিলি কমিটির সদস্য সচিব, চাঁদপুর পৌরসভার সুযোগ্য মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল তাঁর স্বাগত বক্তব্যে ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছেন।
দুদিনব্যাপী উৎসবের দুদিনই সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি মানসম্পন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিতে আয়োজকদের বিপুল ব্যয় এবং সাবিনা ইয়াসমিনের মতো কিংবদন্তিতুল্য ও নচিকেতার মতো উপমহাদেশখ্যাত শিল্পীসহ দেশখ্যাত অন্যান্য শিল্পী ও নামকরা ব্যান্ড তারকাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা ছিলো অনেক বড়ো সাফল্য।
আর সাজসজ্জা? চাঁদপুর স্টেডিয়ামকে ইতঃপূর্বে আর কখনও কেউ এতোটা অপরূপ সাজে দেখতে পায়নি, যতোটা চাঁদপুর কলেজের প্লাটিনাম জুবিলিতে দেখতে পেয়েছে। আর সাউন্ড? সেটা তো ছিলো প্রকৌশলগত নিপুণতায় পুরোপুরি অবিঘিœত। উপর্যুপরি প্রথমদিন আতশবাজি ও দ্বিতীয় দিন লেজার শো ছিলো অংশগ্রহণকারীদের জন্যে বোনাস। আর প্রতিজন অংশগ্রহণকারীর জন্যে বাঁধাইকৃত উন্নতমানের অভিবাদনপত্র ছিলো ওভার বোনাস। বিশাল আনন্দ শোভাযাত্রা, মোটরসাইকেল ও ঢাকা-ব্যাংকক এয়ার টিকেটসহ ৪০টি দামী পুরস্কার সম্বলিত র্যাফেল ড্র, শিশুদের জন্যে ভ্রাম্যমাণ পার্ক, অংশগ্রহণকারীদের সুবিধার্থে পোর্টেবল (সহজে বহনীয়) টয়লেট ও পর্যাপ্ত ওয়াশরুম, ছবি তোলার আকর্ষণীয় স্পট ছিলো উক্ত জুবিলির স্বস্তিপূর্ণ দিক।
আসলে কি চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তিতে প্লাটিনাম জুবিলি হয়েছে? ১৯৪৬ সালের ১ জুন প্রতিষ্ঠিত হওয়া কলেজটির প্লাটিনাম জুবিলি ২০২১ সালের ১ জুন আয়োজন করাটাই বাঞ্ছনীয় ছিলো। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনা সেই আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই অজুহাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ সুকৌশলে বলতে পারতো, আচ্ছা ৭৫ বছরপূর্তি যখন করাই গেলো না, ২০৪৬ সালে শতবর্ষপূর্তির অপেক্ষায় না হয় থাকি। কিন্তু প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের চাপে, বিশেষত বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ দাশ এই কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র হওয়ার কারণে উক্ত অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ আর পাননি। এতে ইতিহাসের পাতায় যে স্থানটুকু তিনি করে নিলেন এবং প্লাটিনাম জুবিলির নামে কলেজ প্রতিষ্ঠার ৭৭ বছরে যে মহাযজ্ঞ মেয়র জুয়েলের মতো এক ঝাঁক সাংগঠনিক দক্ষতাপূর্ণ-ত্যাগী-বহুমুখী যোগ্যতাসম্পন্ন প্রাক্তন শিক্ষার্থী, দাতা ও স্পন্সরদের মাধ্যমে সম্পাদন করলেন, তার আনন্দরেশ মন থেকে মুছতে অংশগ্রহণকারীদের কতোদিন যে লাগতে পারে সেটা বলা সত্যিই ভীষণ মুশকিল!