প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২১
মুখ ও মুখোশ

‘নীতি-নৈতিকতার এক অভাবনীয় অপুষ্টিতে আড়ষ্ট হয়ে আছে এক সময়ের চরম অবস্থার বাংলাদেশটি। সাথে জড়িয়ে আছে দেশটির স্থায়ী অভিভাবকত্বে প্রকট এক অমীমাংসীত সমস্যা। দেশ আজ মনোনয়ন সজ্জিত অভিভাবক দ্বারা পরিচালিত। নির্বাচিত সরকার গঠনের মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যে অপেক্ষমান হয়ে আছে দেশের প্রায় আঠারো কোটি জনগণ। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই হলো কর্মক্ষম জনগণ।
শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য-যৌবন-আর মধ্যবয়সী পর্যন্তই মানব জীবনটি একটি উদ্দাম-শক্তিশালী-সম্ভবনাময় পর্যায়। এরপর আসে অনেক অভিজ্ঞতা-দায়িত্ব এবং পরিবর্তনের পর্যায়। তারপর এসে যায় স্থবিরতার বার্ধক্য। তারুণ্যের মধ্যে থাকে সজীবতা-জীবনী শক্তি-উদ্দীপনার প্রাবল্য অনেক বেশি, যার ফলে ‘মেন্টাল সেট’ সুদৃঢ় হয়। কিন্তু যায়যায়দিনের ‘উইকিপিডিয়া’ অনুযায়ী প্রতি ১৭ জন তরুণের মধ্যে একজন থাকে মাদকাসক্ত। একজন মাদকাসক্ত তার চাহিদার অর্থ যোগান দিতে নিজেই বেছে নেয় অন্ধকার জগতের জঘন্য মানবতা বিরোধী অপরাধগুলো।
আমরা যারা এই সামাজিক চলমান অপসংস্কৃতিকে রুখে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তারাই কেউ কেউ এই অপসংস্কৃতির কালো আঁধারে নিজকে নিভিয়ে দিচ্ছি। আমরা কি এমন মাদকাসক্ত তরুণ সমাজ চেয়েছিলাম? যাদের স্বাভাবিক মুখের উপর অগণিত ‘মুখোশ’। এক সময় মুখোশ ছিলো বাংলার লোকশিল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু আজকের এই ডিজিটাল যুগের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে এটি এমনভাবে মানুষের মাথায় ‘ট্রন্সপ্লানটেড’ হয়েছে যেন তা তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। যা একই অঙ্গে অন্তর্নিহিত বহুরূপী চরিত্রের সমাহার ঘটিয়েছে। ফলে এই বাংলার রাজনীতি, সমাজনীতি এবং শিক্ষানীতি এক অপাংক্তেয় পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়ে মানব সমাজকে মরুভূমির মরীচিকাময়তার মধ্যে নির্বাসিত করেছে। এই ডিজিটাল যুগের তাগিদে জড়তা এবং সীমাবদ্ধতা বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টিশীলতা এবং গতিশীলতার উন্মেষ ঘটাতে পারে একমাত্র প্রগতিশীল তরুণ সমাজই। যেখানে থাকবে শুধুমাত্র তারুণ্য শক্তি-সজীবতা-এগিয়ে যাওয়ার কর্মোদ্দীপনা। এখানে স্বীয় মননশীলতার সাথে শিষ্টাচারিতা অপরিহার্য।
মনে রাখা প্রয়োজন, যারা আজকের তরুণ সমাজ তারাই আগামীদিনের দেশ পরিচালকের ভূমিকায় থাকবে। এক্ষেত্রে আজকের অভিভাবকদের ভূমিকা একমাত্র চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, পশু-পাখি ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য নিয়েই জন্মায়, কিন্তু মানুষকে মনুষ্যত্বটা অর্জন করে নিতে হয়। আর এজন্যেই বলা হয় : অ সধহ রং শহড়হি নু যরং পড়সঢ়ধহরড়হ ঃযধঃ যব শববঢ়ং. মানুষ মনুষ্যত্ব অর্জন করে অনেক কিছু শিখেছে। যেমন উড়োজাহাজে আকাশে উড়ে-সাবমেরিনে পানির নিচে বেড়ায়, অথচ রাস্তায় চলতে শিখে নাই। কিন্তু পশুত্বটা হাড়ে হাড়ে অর্জন করে ফেলেছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের সর্বত্রই বিরাজমান এক নৈরাশ্যব্যঞ্জক পরিস্থিতি। কারণ ‘নিজেকে অবশ্যই মাপকাটিতে রেখে অপরের সাথে ব্যবহার করতে হবে।’ প্রত্যেক মানুষের জন্যে স্বতঃসিদ্ধ একটা কথা আছে ‘ইরৎঃয ৎরমযঃ.’ আমাদের সমাজে এগুলো কায়েম করতে হলে নৈতিকতাবহুল নিয়মানুবর্তিতা অপরিহার্য। অতৃপ্ত জীবনবোধেই হিংসা এবং পরশ্রীকাতরতা জন্মে। এতেই নিছক রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতানৈক্যের বাতাবরণে সংখ্যাল্প সম্প্রদায়কে আজ চরম নিঃস্বতায় আড়ষ্ট করে ফেলেছে। তারা আজ দিশেহারা এবং ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ আর সর্বস্বহারা। দেশ আজ জাতিগত বিভেদের উস্কানিতে রসাতলে নিমজ্জিত। জাতিগত উন্মাদনায় মনুষ্যত্ব হারায়, আর বাস্তব ধর্মীয় উন্মাদনায় মনুষ্যত্ব গজায়। এ ভারতবর্ষের মানুষ স্বভাবতই আবেগ তাড়িত এবং অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে বিবেক তাড়িত হয়। সংখ্যাধিক্যে আছে আবেগ তাড়িতরা, আর সংখ্যাল্পতে আছে বিবেক তাড়িতরা, যারা জাগতিক সুপ্ত শক্তিকে অর্জন করে জীবনকে ছন্দময়তায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।
স্রষ্টার সৃষ্টি-বৈচিত্র্য মানুষের বোধগম্যতার অতীত। এখানে কালো-ধলো, সহজ-জটিল, বুদ্ধিমান-নির্বোধ, অহংকারী-বিনয়ী, ধনী-নির্ধন, কষ্ট সহিষ্ণু-অলস এবং পণ্ডিত-মূর্খ এসব কিছু মিলে আমরা এক বিশেষ নিয়মে সহাবস্থান করছি, তার বিপরীতে প্রাণী জগৎ কিন্তু খাদ্য আর খাদক হিসেবেও অন্য এক ‘ইকো সিস্টেমের’ আওতায় বসবাস করে আসছে। এখানে কেউ কারো দুশমন নয়। পরমতসহিষ্ণুতা এবং পরস্পর সহনশীলতা জাগতিক ধর্ম হওয়াই মুখ্য। কিন্তু ধর্মী-বিধর্মী এবং নাস্তিক্যবাদীর মধ্যকার কলহ গৌণ হওয়াই শ্রেয়। এদের কাউর মধ্যে আধ্যাত্মিকতায় বিকশিত হওয়ার লক্ষণ বিদ্যমান, কারো বা অজ্ঞতার গোঁড়ামি বজ্রকঠিন পথে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। যে কোনো শাসক দলের অপরিণামদর্শী এবং অনভিজ্ঞ সিদ্ধান্তে যদি শাসিত গোষ্ঠির স্বাধিকার ব্যাহত হয়ে বাক্ স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়, তবে অবশ্যই এই শাসন কাল নাতিদীর্ঘ হবে। আবার বাঙালি স্বভাবসিদ্ধ আবেক-তাড়িত বিপ্লব ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবেই। তবে একথা অনিবার্য, শাসিতের বাক্ স্বাধীনতা-হরণে শাসকের পতন সময়সাপেক্ষ। উন্মত্ততার প্রতিবাদে নিষ্ফল আর্তনাদ পতনের সময়কে ত্বরান্বিত করে দেয়।
মানুষই একমাত্র লম্বালম্বি মেরুদণ্ড প্রাণী। অন্য সব সমান্তরাল মেরুদণ্ডী প্রাণী। এ কারণেই মানুষের চিন্তা-চেতনা-অনুভূতি এবং সামাজিকতার সহনশীলতায় মানুষই অনন্য। ধরাধামে আগে মানুষ এসেছে, পরে মানুষের নিয়ন্ত্রিত চলাচলের জন্যে ধর্ম এসেছে। প্রত্যেকটি মানুষের সৃষ্টিতে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিরাজমান। অনেক ক্ষেত্রেই আবার অভিন্ন, যেমন : রক্ত-মাংস-অস্থিমজ্জা এবং বাহ্যিক অবয়বে। শুধু মন-বুদ্ধি-অহংকারে ভিন্নতা মাত্র। মানুষের পারস্পরিক সংবেদনশীলতাই মানব সমাজ গঠিত। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ঐতিহ্যজাত অহংবোধকে পাশ কাটিয়ে একটি নতুন মানব সমাজ গঠন করে বৈষম্যের বিষ বাষ্প মুক্ত সমাজ গঠনই মূল সার্থকতা। অন্য সবই নিথর সফলতা মাত্র। প্রতিটি মানব সন্তান অবশ্যই তার নিজ স্বপ্নের সমান। আইন আমলে কোনো রুগ্ন সমাজই নিরোগ হয় না। সুস্থ মানব সমাজের প্রধান নিয়ামকই হলো হৃদয় নিংড়ানো পারস্পরিক ভালবাসা এবং সর্বোচ্চ মুক্ত পরমতসহিষ্ণুতাকে কন্টকমুক্ত করা। যা শিখিয়েছে এ বিশ্ব চরাচরের সব কিছুই যুগোপযোগী পরিবর্তনের স্বয়ংক্রিয়তার বাস্তব প্রভাব।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ (জেএন) উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।