প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৪
সংগীত নিকেতন : সুর ও শুদ্ধ সংগীত চর্চায় চাঁদপুরে অর্ধ শতাব্দীর এক বাতিঘর

চাঁদপুর শুধু পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়ার মিলনস্থল নয়, এ জেলা এক অর্থে সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চার উর্বর ভিটে। সেই ভিটার গৌরবোজ্জ্বল ধারক ও বাহক হিসেবে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আলো ছড়াচ্ছে সংগীত নিকেতন। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি আজও শুদ্ধ সংগীত চর্চার ধারায় নিজস্ব মর্যাদা ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তার যাত্রার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হাজারো শিক্ষার্থীকে সংগীতের মায়াবী জগতে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
চাঁদপুরে সংগীত নিকেতন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ জেলার সংস্কৃতি অঙ্গনে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছে। পূর্বে সংগীত শিক্ষা মানেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কারো বাড়িতে গিয়ে শিখে নেওয়া, অথবা শহরের বাইরে গিয়ে বড়ো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। সংগীত নিকেতনের প্রতিষ্ঠা চাঁদপুরের সেই ধারা বদলে গিয়েছে। শুদ্ধ সংগীতচর্চায় এখানে প্রথমবারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এই প্রতিষ্ঠান। কণ্ঠ, নৃত্য, তবল, চিত্রাঙ্কন--সব ক্ষেত্রেই নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা শুরু হয়। শিশুশিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা এক ছাদের নিচে সমানভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, বরং তাদের জন্যে নিয়মিত আয়োজন করা হয় বার্ষিক অনুষ্ঠান, সনদ বিতরণ, মৌসুমি উৎসব, জাতীয় দিবস উদযাপন এবং গুণীজন সংবর্ধনা। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিভা প্রকাশের মঞ্চ খুঁজে পায়, একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। বলা যায়, সংগীত নিকেতন চাঁদপুরের শিল্প-সংস্কৃতির ভুবনকে কেন্দ্রীয় এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, যা স্থানীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রয়েছে।
ষাটের দশকে যখন গ্রামীণ-নগর জীবনে সংগীত চর্চা সীমিত, তখন চাঁদপুর শহরে সংগীত নিকেতনের জন্ম হয়। কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যে নয়, বরং প্রজন্মকে সুরের মাধ্যমে দেশপ্রেম, মানবিকতা ও সৌন্দর্যবোধে গড়ে তোলার জন্যই এর প্রতিষ্ঠা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও প্রতিষ্ঠানটির শিল্পী ও শিক্ষকরা মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনতে যে গানগুলো তৎকালীন সময়ে জনমানসে আলোড়ন তুলেছিলো, সংগীত নিকেতনের শিল্পীরাও সেসব গানে কণ্ঠ মেলান। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই সংগীত নিকেতনের অগ্রযাত্রা।
বর্তমানে সংগীত নিকেতনে চারটি শাখা সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে কণ্ঠ বিভাগ, চিত্রাঙ্কন বিভাগ, নৃত্য বিভাগ ও তবল বিভাগ।
প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী এবং ১৫ জন প্রশিক্ষক নিয়ে সংগীত নিকেতন প্রতিদিন সুর, লয়, তাল, নৃত্য ও শিল্পচর্চায় মুখরিত থাকে।
শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছর মেয়াদী কোর্স সম্পন্ন করে সনদ অর্জনের সুযোগ পান। প্রতি বছর নিয়মিত দুটি পরীক্ষা নেওয়া হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা ধারাবাহিকভাবে নিজেদের পারদর্শিতা মূল্যায়ন করতে পারেন।
চাঁদপুর শহরের কোড়ালিয়া রোডে সংগীত নিকেতনের নিজস্ব একাডেমিক ভবন রয়েছে। ২০১২ সালে উদ্বোধন হওয়া এই স্থায়ী ভবনটির ভেতরে রয়েছে সুপরিসর ক্লাসরুম এবং চন্দ্রকান্ত সাহা মিলনায়তন। এ মিলনায়তনে নিয়মিত সাংস্কৃতিক আসর, প্রশিক্ষণ কর্মশালা, মৌসুমি অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবস সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমকে বলা যায় বারোমাসি উৎসব। শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি সংগীত নিকেতন আয়োজন করে মাসিক সুরসভা, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপন এবং পহেলা বৈশাখের বৈশাখী উৎসব। পাশাপাশি গুণীজন সংবর্ধনা ও শিল্পী সম্মাননা এবং ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠান বর্ষা, শরৎ, বসন্ত ইত্যাদি। এছাড়া করে বিশেষ স্মরণসভা ও একক সংগীত আসর, জাতীয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান।
এসব কর্মকাণ্ডের বাইরেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে।
সংগীত নিকেতনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, লোকসংগীত ও স্বর্ণযুগের গান। শুদ্ধ সংগীত চর্চা ও প্রসারকেই প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
চাঁদপুর সংগীত নিকেতন থেকে শিক্ষা নিয়ে বহু শিল্পী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এস ডি রুবেল, গজলশিল্পী রুহুল আমিন বাদল, ভারতের সংগীত শিক্ষাবিদ রজত চক্রবর্তী, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের শিল্পী বাবুল চক্রবর্তী, শংকর আচার্যী, রিয়া চক্রবর্তী, কল্লোল সেনগুপ্ত, সুপ্তা সাহা, পুতুল দাস সহ আরও অনেকে। এরা সংগীত নিকেতনের সাফল্যগাথাকে বহন করে চলেছেন দেশ-বিদেশে।
চাঁদপুর সংগীত নিকেতন একটি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। যার নিবন্ধন নম্বর কুম ৫৩৮/৭৭। জেলা প্রশাসন পদাধিকার বলে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন চাঁদপুরের সুপরিচিত মুখ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জীবন কানাই চক্রবর্তী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ,
বর্তমানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব স্বপন সেনগুপ্ত। বিগত বছরগুলোতে এর আগে অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন প্রয়াত শ্যামল সেনগুপ্ত, ওস্তাদ মমতাজ উদ্দিন, সুরেশ চন্দ্র দাস ও পীযুষ চক্রবর্তী। তাঁদের অবদানই আজকের সংগীত নিকেতনের ভিত্তি দৃঢ় করেছে।
চাঁদপুরে সংগীত নিকেতন শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম। এ প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে, সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিবেশে যে কোনো জেলা থেকেও দেশবরেণ্য শিল্পীর জন্ম হতে পারে। শুদ্ধ সংগীত চর্চা প্রজন্মকে আলোকিত করে, মুক্তচিন্তার পথ উন্মুক্ত করে। সংগীত কেবল বিনোদন নয়, এটি সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মুক্তচেতনারও বাহক।
চাঁদপুর সংগীত নিকেতন ইতোমধ্যে অর্ধশতকেরও বেশি পথ অতিক্রম করেছে। অভিনন্দনযোগ্য বিষয় হলো, এখনও চাঁদপুর সংগীত নিকেতন সেই প্রেরণাদায়ী সুরের ভুবনকে অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে। আধুনিকতার স্পর্শে গান ও শিল্পচর্চার ধরণ যেমন বদলেছে, তেমনি সংগীত নিকেতনও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে। তবুও মূল চেতনা অপরিবর্তিত--শুদ্ধ সংগীতের সাধনা ও প্রসার। চাঁদপুরবাসীর কাছে এই প্রতিষ্ঠান শুধু একটি সংগীত বিদ্যালয় নয়, বরং একটি গৌরবময় ঐতিহ্য, এক অবিনশ্বর সুরধারা।