বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ০৫:৪০

সময়ের প্রান্তরেখায় দাঁড়িয়ে আমরা শুধু স্মৃতি বহন করি!

আমরাই শেষ প্রজন্ম!

দুই যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হারিয়ে ফেলা শৈশবের দিনগুলোর সাক্ষী একটি প্রজন্ম

মো. জাকির হোসেন
আমরাই শেষ প্রজন্ম!

“এক সময় ছিল, যখন জীবন ছিল প্রাণে—আজ আমরা কেবল যন্ত্রের শরীর চিনি, অনুভবটুকু হারিয়ে ফেলেছি।”

আমরাই সেই শেষ প্রজন্ম—যাদের জীবন শুরু হয়েছিল খোলা মাঠ, পুকুরের ঘাট, গরুর গাড়ি, আর হারিকেনের আলোয়। আর শেষ হল চশমায় প্রতিফলিত LED স্ক্রিন, ইনবক্সের 'Seen' স্নায়ুক্ষয়ী প্রতীক্ষা আর স্মার্টফোনে বন্দী ‘বন্ধুত্ব’ দিয়ে।

আমরাই শেষ প্রজন্ম, যারা সত্যিকারের দুই যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সময়কে দু’হাতে ছুঁয়েছি। যারা নাড়ার বল দিয়ে ফুটবল বানিয়েছি, আবার চোখের সামনে ড্রোন উড়তে দেখেছি। আমাদের মধ্যে দিয়েই পৃথিবী হারিয়েছে তার মাটির গন্ধ, আর পেয়ে গেছে কৃত্রিম গ্ল্যামার।

চিঠি যখন ছিল ভালোবাসার একমাত্র বাহন

আমাদের ভালোবাসা এসেছিল পোস্টম্যানের ঝোলায় ভর করে, যেখানে চিঠি এলেই বুক ধকধক করত। ইনল্যান্ড লেটার, খাম, পোস্টকার্ডের একেকটা লাইন মানে ছিল—"তুমি কেমন আছো?" আর আজ—'Seen at 7:12 PM'–এই বাক্যটাই হয়ত শেষ বার্তা।

আমরা চিঠির কালি শুকাতে কাগজের ফুঁ দিয়েছি, এখন সেই কালি নেই, শুধু ফেসবুক টাইমলাইন।

খেলা যখন মাঠে হত, স্ক্রিনে নয়

আজকের প্রজন্মের কাছে খেলা মানে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, PUBG, Free Fire, FIFA। কিন্তু আমাদের খেলাধুলার জায়গাটা ছিল ধুলো, বালি আর হাসির অবাধ রাজত্ব। কানামাছি, ডাঙ্গুলি, মার্বেল, বাঘবন্দি, গোল্লাছুট —এই শব্দগুলো এখন শুধু অভিধানে ঠাঁই নিয়েছে। ঘুড়ির লাটাই ঘুরিয়ে আকাশে উড়ানো ঘুড়িটা ছিল আমাদের ইচ্ছের প্রতীক, আর প্রতিটি কাটাকাটি যেন একেকটা জয়।

শিক্ষা মানে ছিল কঠোরতা, কিন্তু স্নেহময়

স্কুল মানে ছিল নিয়ম, বেতের বাড়ি, শিক্ষকের গর্জন। তবুও সেই কঠোরতার মধ্যে ছিল শাসনের গভীর ভালোবাসা। আজকের ডিজিটাল ক্লাস, স্মার্টবোর্ড, ই-লার্নিং—সবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু খাতার পৃষ্ঠায় নিজের হাতে লেখা অক্ষরগুলোতে যে আত্মিক যোগাযোগ ছিল, তা অনুপস্থিত।

আমরাই সেই প্রজন্ম, যারা ‘ভুল করলে শিক্ষকের হাতে মার খাওয়া’কে অপমান নয়, শিক্ষার অংশ ভাবতাম।

প্রযুক্তি এসে জীবনের সরলতা কেড়ে নিল

আমরা সেই সৌভাগ্যবান প্রজন্ম, যারা ঘরে প্রথমবার রেডিও, পরে সাদা-কালো টিভি, এরপর VCR, ক্যাসেট রেকর্ডার, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট মনোক্রোম মনিটর থেকে শুরু করে আজকের AI চিপ পর্যন্ত দেখতে পেরেছি। তবে প্রযুক্তির এই সব রঙিন আলো আমাদের মন থেকে হারিয়ে দিয়েছে ঝিনুকের দুল, ম্যাচের বাক্সের ফোন, আর মাটির গন্ধমাখা শৈশব।

আত্মীয়তা ছিল আত্মায়, এখন কেবল স্ট্যাটাসে

এক সময় আত্মীয় আসত ঘরে, আর এখন আসে নিউজফিডে। দাওয়াতের জন্য রান্নাঘরে গরম মসলা ছড়াত, এখন শুধু মেসেঞ্জারে ‘রিমাইন্ডার’ চলে। আমরাই সেই প্রজন্ম, যারা ‘একটু দেখা করতে এসো’ কথাটার মাধুর্য জানি। আজ ‘ভাই, টাইম নাই’—এই বাক্যই সম্পর্কের শেষ রেখা।

বন্ধুত্ব মানে ছিল শরীর-মন জুড়ে থাকা

আমরা বন্ধুকে কল করে খুঁজতাম না, পুকুরপাড়ে গিয়ে ডাকতাম। সাইকেলের টায়ার চালানো, সুপারির খোলার গাড়ি, টিনের বাস্কেট বল, বা কাঁঠালের আঠা দিয়ে ঘুড়ি তৈরি—এইসব ছিল একেকটা বন্ধুত্বের ভিত্তি। আজ বন্ধুত্ব মানে ‘গ্রুপ চ্যাটে রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া।

আমরা ভালোবাসতাম মন দিয়ে, চিৎকার দিয়ে নয়

আমাদের প্রেম ছিল চিঠির খামে, দোলনায়, নদীর পাড়ে। ছিল চোখে চোখে চাওয়া, মুখে না বলা কথার ভার। এখন ভালোবাসা মানে একের পর এক রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আপডেট।

আমরাই সেই শেষ প্রজন্ম, যারা - বিদ্যুতের অভাবে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়েছি, - একজোড়া নতুন জামা দিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছি, - স্কুলে মার খেয়েও অভিভাবকের স্নেহে বড় হয়েছি, - আর সবচেয়ে বড় কথা, এখনও পর্যন্ত 'মানুষ' হয়ে আছি।

এই প্রজন্মকে কী রেখে যাচ্ছি?

আমাদের হাতে ছিল কম, কিন্তু আমরা পেয়েছি বেশি। আমাদের চারপাশে ছিল না স্মার্ট স্ক্রিন, কিন্তু ছিল মানুষের গায়ে গা লাগিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ।

আমরা সেই শেষ প্রজন্ম, যারা সময়কে ছুঁয়েছিলাম — এখন সময় ছুঁয়েছে আমাদের স্মৃতি। আমরা যাচ্ছি, আমাদের সাথে যাচ্ছে এক সময়ের সভ্যতা। যে প্রজন্মের কাছে জীবনের মানে ছিল সংযোগ, আজ সেখানে শুধু নেটওয়ার্ক

লেখক পরিচিতি: মো. জাকির হোসেন একজন সামাজিক বিশ্লেষক ও প্রজন্মান্তরের স্মৃতি-লেখক। যিনি প্রযুক্তির অগ্রগতির মধ্যেও মানুষের ভেতরের সরলতা ও আবেগের গুরুত্ব তুলে ধরতে ভালোবাসেন।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়