প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫, ১১:২৯
রোজার ইতিহাস, ফজিলত ও গুরুত্ব

মহান আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে রোজা অন্যতম নেয়ামত হিসেবে গণ্য হয়। রোজা কেবল উম্মতে মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্যে ফরজ নয়, বরং তা অতীত নবী-রাসুলদের উম্মতদের জন্যও ছিল। কিন্তু রোজার সময়, পদ্ধতি ও ধারা ভিন্ন ছিল। রোজা ফারসি শব্দ, অর্থ উপবাস থাকা। কোরআন-হাদিসে এটিকে সিয়াম বলে। রোজা শব্দটিই প্রচলিত। সাওম বা সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া, পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম, সিয়াম বা রোজা বলে। শুধু পানাহার ত্যাগ ও স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম পালন নয়। বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই হলো (প্রকৃত) সিয়াম বা রোজা। যদি তা-ই না হয়, তবে আমরা কেন রোজা রাখবো? ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্যে রমজান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, যার অর্থ অবশ্য পালনীয়। রমজান মাস ইবাদতের বিশেষ মৌসুম। রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। রমজানের প্রধান ইবাদত ‘সিয়াম’ বা রোজা পালন। রমজানের মূল প্রতিপাদ্য ‘আল-কোরআন’।
হজরত আদম আলাইহিস সালাম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমন করার পরে প্রত্যেক মাসে তিনটি রোজা রাখতেন। আইয়ামে বিজ বা প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতে হতো। ‘আইয়ামে বিজ’ অর্থ শুভ্রতার দিনসমূহ। আদম ও হাওয়া (আ.) জান্নাতে থাকাকালে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলায় তাঁদের গায়ের রং কালো হয়ে যায়। তাই ফেরেশতারা তাঁদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁরাও তওবা করেন। ফলে তাঁদের গায়ের রং সাদা ও সুন্দর হয়। এরপর আল্লাহ আদম (আ.) ও তাঁর উম্মতকে প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখার নির্দেশ দেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) আইয়ামে বিজের সিয়াম পালন করতেন।’ (নাসায়ি)। তাহলে বলা যায়, হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে রোজার ধারাবাহিকতা শুরু হয়।তার পরবর্তী যুগে হজরত নূহ আলাইহিস সালাম এই রোজা রাখতেন। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামও রোজা রাখতেন। এ ব্যাপারে হাদিসে নববিতেও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাওয়া যায়। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহ তাআলার সাথে কথোপকথনে গমন করেন, তখন তিনি ৪০ দিন রোজা রাখেন। হজরত দাউদ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার রাজত্বও দিয়েছিলেন। আবার নবুয়তও দিয়েছিলেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, একদিন ইফতার করতেন। বছরে ছয় মাস রোজা রাখতেন। হাদিসে নববিতে একে রোজা রাখার উত্তম পদ্ধতি বলা হয়েছে।
কোরআনে আছে, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের পথপ্রদর্শক ও সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন। এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মীমাংসারূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে-কেউ এ-মাস পাবে, সে যেন এ-মাসে অবশ্যই রোজা রাখে। আর যে রোগী বা মুসাফির তাকে অন্য দিনে এ-সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না, যাতে তোমরা নির্ধারিত দিন পূর্ণ করতে পার ও তোমাদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতে পার, আর তোমরা কৃতজ্ঞ হলেও হতে পার।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন : আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় রোজা হলো হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের নিয়মে রোজা পালন করা। তিনি একদিন সওম পালন করতেন, আরেক দিন বিরত থাকতেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৩১] হজরত জাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আ.) সালামও রোজা রেখেছেন। হজরত ঈসা আলাইহিস সালামও দুমাসের রোজা রাখতেন। হিন্দু ব্রাহ্মণরাও রোজা রাখেন। অতএব, বোঝা গেলো প্রত্যেক ধর্মে ঋধংঃরহম (রোজা) ইবাদত রয়েছে।
ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় ঋধংঃরহম (রোজা) শিরোনামের অধীনে লেখা হয়েছে, ‘আমরা দুনিয়ার এমন কোনও ধর্ম পাইনি, যে ধর্মে রোজার ইবাদত নেই।’ হিজরত করে মদিনায় আসার কিছু দিন পর থেকেই মুসলিমরা আশুরার রোজা পালন করতে শুরু করেন। এই সময় আশুরার রোজাই তাদের ওপর ওয়াজিব ছিল। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসেন তখন দেখতে পান, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তাদের রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা ও বনি ইসরাইলকে ফিরাউনের ওপর বিজয় দিয়েছিলেন। তাই আমরা ওই দিনের সম্মানে রোজা পালন করি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আলাইহিস সালামের বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি সবাইকে রোজা পালনের নির্দেশ দেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯৪৩] হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন : জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করতো এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই রোজা পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনও এই রোজা পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজা ছেড়ে দেওয়া হয়। যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০২]
বেশিরভাগ ফকিহ ও মুহাদ্দিসের মতে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল, যা পরবর্তী সময়ে নফলে পরিণত হয়। আর প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান সবসময় মুস্তাহাব ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ হয়। প্রথমে ইচ্ছাধিকার ছিল : রমজানের রোজা যখন প্রথম ফরজ হয়, তখন রোজা রাখা ও ফিদিয়া দেওয়ার ইচ্ছাধিকার দেওয়া হয়। এরশাদ হচ্ছে :(তোমাদের ফরজ করা হয়েছে) রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এটা যাদের মারাত্মক কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য হলো, এর পরিবর্তে ফিদিয়া—একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। অবশ্য রোজা পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। [সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৪] ফরজ বিধান : এরপর কোনও প্রকার অবকাশ না রেখেই রোজা ফরজ করা হয়।কোরআনে আছে,‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের জন্য সিয়াম (রোজা)-র বিধান দেওয়া হলো। যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পার। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩) এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫]
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে রায়্যান নামক একটি বিশেষ তোরণ আছে। এ তোরণ দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করবেন। তাঁদের প্রবেশের পরে এই দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে, তাঁরা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’
রোজা রাখলে কিডনীতে সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন দূরীভূত হয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, এর উপকারিতা হলো, সারা বছর অতিভোজ, অখাদ্য, কুখাদ্য, ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে যে জৈব বিষ জমা হয় তা দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। এক মাস রোজা পালনের ফলে তা সহজেই দূরীভূত হয়ে যায়। ইসলামের বিধানগুলো মানবজীবনে কল্যাণ বয়ে আনে—এটি মুসলমানদের বিশ্বাস। আধুনিক বিজ্ঞানও প্রমাণ করছে যে, ইসলামের বিভিন্ন বিধান, যেমন রোজা, শুধু আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেই নয়, শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। নিচে রোজা রাখার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা তুলে ধরা হলো-- জাপানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমির গবেষণায় উঠে এসেছে যে, রোজা কোষের অটোফেজি প্রক্রিয়া সক্রিয় করে। অটোফেজি কোষের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো মেরামত করে, যা দেহে তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে। এটি আলঝেইমার্স ও পারকিনসন্সের মতো রোগের ঝুঁকিও কমায়। রোজা শরীরের মেটাবলিক সুইচকে সক্রিয় করে, যা চিনি থেকে চর্বিতে শক্তির উৎস স্থানান্তরিত করে। এতে দেহে জমে থাকা চর্বি পুড়ে এবং হার্ট, ব্লাডপ্রেসার ও সুগারের নিয়ন্ত্রণে উন্নতি হয়। রোজা নাড়ি-ভুঁড়িতে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ৩৫টি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, রোজা গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি ওজন কমাতে পারে। এটি দেহের অতিরিক্ত চর্বি হ্রাসে সহায়ক। রমজানের রোজা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং ডায়াবেটিস ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, রোজা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্যেও উপকারী হতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। রোজা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করে। ২০১৯ সালের ‘লন্ডন রমজান স্টাডি’ দেখিয়েছে যে, রোজা সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেসার কমাতে সহায়ক। ফলমূলের পরিমাণ বাড়িয়ে রোজার খাদ্যতালিকা আরও স্বাস্থ্যসম্মত করা সম্ভব।রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতাগুলো শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যেই নয়, বরং মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। সঠিক নিয়মে রোজা পালন করলে এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির পাশাপাশি শরীরের জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে উঠে।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রোজা পালন করে তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যায়।” আবু হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “শাইতান ও দুষ্ট জিনদেরকে রমজান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং এর দরজাও তখন আর খোলা হয় না, খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো এবং এর একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন : হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে।” আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর মর্জি হলে আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ্ বলেন, তবে রোজা ব্যতীত, তা আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যেই ত্যাগ করে। রোজাদারের জন্যে দুটি আনন্দ। একটি আনন্দ তার ইফতারের সময় এবং আরেকটি আনন্দ রয়েছে তার প্রভু আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাতের সময়। রোজাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। সিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মিটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব, তার ব্যাপারে এখন আমার শাফা‘আত কবুল করো। কুরআন বলবে, হে রব! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।” কিছু কিছু কারণে রোজা ভঙ্গ হতে পারে। তাই রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ সকল মুসলমানের জানা উচিত বলে বিজ্ঞজন মনে করেন।
আসুন কী করলে রোজা ভঙ্গ হয় তা আমরা জেনে নেই--
১। ইচ্ছা করে বমি করা, ২। বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা, ৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব, ৪. ইসলাম ত্যাগ করলে, ৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে, ৬. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে ৭. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে ৮. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে ৯. মুখ ভরে বমি করলে ১০. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরও কিছু খেলে ১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে ১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে ১৩. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে ১৪. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে ১৫. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।
রোজা মাকরুহও কিছু কারণে হতে পারে, আসুন জেনে নেই কী কারণে রোজা মাকরুহ হয়?
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো। *গরমের কারণে বারবার কুলি করা। *টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা। *বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্যে স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা। *মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। *অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা। *ঝগড়া-বিবাদ করা।
কোনো কারণে যদি রোজা ভঙ্গ হয়ে যায় তবে একজন মুসলমান হিসেবে আপনার করণীয় কী? সে বিষয়ে আলোচনা করছি এখন। বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে।একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজার মাঝে কোনো একটি ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে। কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেট ভরে খাওয়াতে হবে। গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।
যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে, কিন্তু পরে কাজা করতে হয়, তা হচ্ছে-- মুসাফির অবস্থায়, রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে, মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে, শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে, কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে।মহিলাদের মাসিক হায়েজ-নেফাসকালীন রোজা ভঙ্গ করা যায়।
রমজানের একটি বিশেষ ফজিলত বা মাহাত্ম্য হচ্ছে,এই পবিত্র রমজান মাসে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রমজান মাসের রোজা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়, মানুষের কুপ্রবৃত্তি ধুয়ে মুছে দেয় এবং আত্মাকে দহন করে ঈমানের শাখা প্রশাখা সঞ্জীবিত করে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
রমজান মাসের উপহার তারাবির নামাজ। আর বিশেষ উপহার ‘শবে কদর’। এই রাতের ফজিলত পবিত্র কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে, ‘কদরের এ রাতটি এক হাজার মাসের (ইবাদতের) চেয়ে উত্তম। ‘এক হাজার মাসে তিরাশি বছর চার মাস হয়ে থাকে। ওই ব্যক্তি ভাগ্যবান, যে এই রাতটি ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারে। কেননা, এর মাধ্যমে সে তিরাশি বছর চার মাসের চেয়েও বেশি সময় ইবাদতে লিপ্ত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে। রমজান মাসে প্রতিটি নেক আমলের ফজিলত ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। একেকটি নফল ইবাদতের সওয়াব অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং আল্লাহর ইবাদতে নিজেদের মশগুল রাখা। আর রমজানের সব নেক আমল নিজেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা।
ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও গবেষক।