প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৭
একজন অসহায় বৃদ্ধার পাশে দাঁড়াবার মতো কি কেউ নেই?
'মতলব উত্তরে স্বামী-স্ত্রীর দাপটে বিদ্যুৎবঞ্চিত ও গৃহবন্দী বৃদ্ধা সুফিয়া' শিরোনামের সংবাদটি গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠে লীড নিউজ হয়েছে। এ সংবাদটিতে মাহবুব আলম লাভলু লিখেছেন, স্বামী বিদ্যুতের মিটার রিডার আর স্ত্রী ইউপি সদস্য। বিদ্যুৎ বিভাগের সামান্য একজন মাঠকর্মী আর স্ত্রী হচ্ছেন ইউপি মেম্বার! তাতেই স্বামী-স্ত্রীর এতো ক্ষমতা প্রদর্শন! ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক অসহায় বৃদ্ধা নারীকে শুধু বিদ্যুৎবঞ্চিত করে ক্ষান্ত নেই। গৃহবন্দী করেও রেখেছে ওই বৃদ্ধাকে। মতলব উত্তর উপজেলার ফতেহপুর পূর্ব ইউনিয়নের সাবাজকান্দি গ্রামের সুফিয়ার বাড়িতে এ ঘটনা ঘটেছে। সোমবার (৩০ ডিসেম্বর ২০২৪) সরজমিনে গিয়ে জানা যায় স্বামী- সন্তানহীনা ৮০ বছর বয়সী এক অসহায় সুফিয়ার মানবেতর জীবনযাপনের কথা। নিঃসন্তান হওয়ায় একটি মেয়েকে দত্তক এনে করেছেন লালন-পালন। তাকে পাত্রস্থ করেছেন। তারপর এখন তিনি একা। একটি চৌচালা টিনের ঘরে তার বসতি। নেই বিদ্যুৎ, থাকতে হয় অন্ধকারে। রাতের খাবার ও নামাজ পড়েন মোমবাতি এবং কুপি জ্বালিয়ে।
সুফিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি অসহায়। আমার অংশীদারদের সম্পত্তি প্রতিবেশী দেবরপুত্র খোরশেদ আলম ও তার ভাইয়েরা ক্রয় করে। এখন আমার সম্পত্তি জোর করে দখল করার চেষ্টা করছে। বাড়ির রাস্তায় বেড়া দিয়ে পথ বন্ধ করে রেখেছে। কোথাও বের হতে পারি না। ২০ বছর আগে এই গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও একমাত্র আমার ঘরেই নেই বিদ্যুৎ। যতোবার বিদ্যুৎ সংযোগের জন্যে আবেদন করি, ততোবারই নানা অজুহাতে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগে বাধা দেয়। মৃত্যুর আগে একটু বিদ্যুতের আলো দেখে যেতে চাই। সুফিয়া আরো বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া এবং বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিবেশী খোরশেদ গং। স্থানীয়ভাবে একাধিকবার মীমাংসার চেষ্টা করলে খোরশেদ আলম আদালতে মামলা আছে বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খোরশেদ আলম নারায়ণগঞ্জ বিদ্যুৎ অফিসে মিটার রিডার হিসেবে কর্মরত আছেন। কী ধরনের অভিযোগ দিলে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস নতুন সংযোগ দিবে না সে বিষয়টি জেনেই তিনি ওই ধরনের অভিযোগ করে সুফিয়াকে বিদ্যুৎ বঞ্চিত করে রেখেছেন। এছাড়া তার স্ত্রী সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য, এর প্রভাব বিস্তারও করছেন। স্থানীয়রা জানান, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সকল কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে খোরশেদ তার স্ত্রীকে ইউপি সদস্য নির্বাচিত করিয়ে নেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এখন আবার বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এসব বিষয়ে খোরশেদ আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, সুফিয়া যে জায়গায় বাসবাস করছেন সে জায়গা নিয়ে কোর্টে একাধিক মামলা রয়েছে। এই জায়গা আমার। মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একি মিত্র চাকমা বলেন, বিষয়টি জেনে খুবই মর্মাহত। পল্লী বিদ্যুৎকে বলেছি বিষয়টি দেখার জন্যে। পল্লী বিদ্যুতের এজিএম রায়হানুল ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের থেকে জেনে আমি সুফিয়ার বাড়িতে গিয়েছি। যেহেতু আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে, তাই বিষয়টি একটু জটিল। তারপরও চেষ্টা করছি সুফিয়াকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার জন্যে। মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. রবিউল হক বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মতলব উত্তরে সাধারণ্যে বোধকরি কোনো প্রতিবাদী মানুষের অস্তিত্ব নেই। কোনো মানবাধিকার কর্মীও আছে বলে মনে হয় না। আর সেই কারণে গণমাধ্যমকর্মীরা অসহায় বৃদ্ধা সুফিয়ার মানবেতর জীবনযাপনের কথা তুলে ধরেছেন। আশা করি, এবার স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিক ও সচেতন ব্যক্তিরা বৃদ্ধার পাশে দাঁড়াবার উপায় খুঁজে বের করবেন।
মানবাধিকার হচ্ছে এক বিমূর্ত বাস্তবতা। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সকল মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে 'মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা' গৃহীত হয়। সে ঘোষণার আলোকে হলফ করে বলা যায়, মতলব উত্তরের বৃদ্ধা সুফিয়া মানবাধিকার বঞ্চিত। তার পাশে সচেতন মানুষ মাত্রেরই দাঁড়ানো উচিত। যদি না দাঁড়ায় কেউ, তাহলে মতলব উত্তর যে প্রতিবাদী মানুষের সঙ্কটে ভুগছে সেটাই প্রমাণিত হবে।