বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৩

সংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সা.)

ড. আজিজুল আম্বিয়া
সংস্কারক হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বের ইতিহাসে একজন ধর্মসংস্কারক একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের নাম খুঁজলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম আসে সবার আগে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন মহান সমাজ সংস্কারক। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। গোত্র কলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিলো গোটা সমাজ। সামাজিক সাম্য, শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, নারীর মর্যাদা ইত্যাদির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। জঘন্য দাসত্ব প্রথা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, পাপাচার, অন্যায়, অত্যাচারের চরম বাস্তবতায় সমাজ কাঠামো ধসে পড়েছিল। ঠিক এমন এক দুর্যোগময় যুগে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব। তিনি আরবের বুকে বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে নবুওতের আলোকে উদ্ভাসিত করেন। তিনি বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করে সেখানে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং সুন্দর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তৎকালীন আরবের নানা কুসংস্কারের অবসান করেছিলেন। আর এই মহামানবকে জানার প্রথম উৎস হলো কোরআন।

আনুমানিক ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং মাতার নাম আমিনা বিনতে ওহাব। মুহাম্মাদের জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। মুহাম্মাদের ছয় বছর বয়সে তাঁর মাতা আমিনা মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তিনি এতিম বনে যান। এতিম মুহাম্মাদ তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং পরে তাঁর চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড়ো হন। পরবর্তী জীবনে, তিনি মাঝে মাঝে নূর পর্বতের হেরা নামক গুহায় রাত কাটাতেন এবং একাগ্রচিত্তে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। হেরা গুহায় অবস্থানকালে জিবরাঈল নামক ফেরেশতা মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে আসেন এবং তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহি বা বাণী পৌঁছে দেন। তখন মুহাম্মাদ (সা.)-এর বয়স ছিল ৪০ বছর। জানা যায় , ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ (সা.) সর্বসমক্ষে এসব বাণী প্রচার করা শুরু করেন এবং তিনি ঘোষণা করেন, "আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়", আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ (ইসলাম) হলো জীবনের একমাত্র সঠিক পথ (দ্বীন) এবং ইসলামের অন্যান্য নবীর মতোই তিনি আল্লাহর একজন নবী ও রাসূল। আসুন আমরা মুহাম্মদ নামের অর্থটা জেনে নেই। মুহাম্মাদ নামের বাংলা অর্থ 'প্রশংসনীয়' এবং এই নামটি পবিত্র কুরআন শরীফে মোট চারবার এসেছে। পবিত্র কুরআনে মুহাম্মাদ (সা.)কে বিভিন্ন উপাধির মাধ্যমে সম্বোধন করা হয়েছে। উপাধিগুলো হলো-- আহমাদ, কুরআন ৬১:০৬ নবী, রাসূল, আল্লাহর বান্দা ('আবদ'), ঘোষক ('বশির'), কুরআন ২:১১৯ সাক্ষী ('শহীদ'), কুরআন ৩৩:৪৫, সুসংবাদদাতা ('মুবাশ্বীর'), সতর্ককারী ('নাজির'), কুরআন ১১:২,স্মরণকারী ('মুজাক্কির'), কুরআন ৮৮:২১, সৃষ্টিকর্তার বার্তাবাহক ('দাঈ')কুরআন ১২:১০৮, আলোকিত ব্যক্তিত্ব ('নূর'), কুরআন ০৫:১৫ এবং আলো-প্রদানকারী বাতি ('সিরাজ মুনির'), কুরআন ৩৩:৪৬।

ইসলামী সাহিত্যে আরব সমাজের ইসলামপূর্ব যুগকে 'আইয়ামে জাহেলিয়া' বা মূর্খতার যুগ বলা হয়ে থাকে। ইসলামী যুগে উদ্ভূত এই শব্দটি কুরআন ও হাদিসে আরবদের ইসলাম পূর্ব বিশ্বাস, মনোভাব ও আচরণ, সামাজিক জীবন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাধারণভাবে ব্যক্তি ও সমাজের পাপ ও বিদ্রোহ, গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্তহীন রক্তক্ষয়ী বিবাদ, ডাকাতি, দাসপ্রথা, বিশেষ করে নারীর দাসত্ব এবং পণ্যের মতো ক্রয়-বিক্রয়, নারীর প্রতি এমন অবমাননা যে জাহেলিয়া সমাজের মানুষদের কাছে মেয়ে সন্তানকে লজ্জা বলে মনে করা হতো এবং কন্যাসন্তানকে জীবন্ত অবস্থাতেই কবর দেয়ার নিদর্শনও ছিল। এছাড়া ইসলামী ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে, জাহেলিয়াতের যুগের কবিতায় নারীর উপলব্ধি সমাজজীবনে প্রতিফলিত হয়নি। নারীকে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হিসেবে দেখা হতো। সীমাহীন বহুবিবাহ প্রচলিত ছিলো। পতিতাবৃত্তি একটি সাধারণ পেশায় পরিণত হয়েছিলো এবং দাস মালিকরা তাদের ক্রীতদাসদের এটি করতে বাধ্য করতো। নারীদের পিতা বা স্বামীর উত্তরাধিকারের অংশ পাওয়ার অধিকার ছিলো না। সন্তানরা চাইলে বাবার মৃত্যুর পর তাদের সৎ মাকে বিয়ে করতে পারতো। বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারও শুধুমাত্র পুরুষদের ছিলো এবং তা সীমাহীন ছিলো। যখন সম্ভ্রান্তদের কন্যা সন্তানের জন্ম হতো, তখন তারা এটিকে লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখতে এবং তাদের হত্যা করতেও পিছপা হতো না। ইসলামী সমাজের স্মৃতিতে, জাহেলিয়া যুগে জীবিত কন্যা শিশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।

কুরআনের সূরা তাকভীর-এর ৮ম ও ৯ম আয়াতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে এই ঘটনার সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,” যখন জীবন্ত পুঁতে-ফেলা কন্যা- শিশুকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে ?'' --সূরা তাকভীর, আয়াত ৮-৯।

কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়ার প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো না, তবে মাঝে মাঝে এটি করা হতো। কিছু গোত্রের মধ্যে এই ঘটনা বেশি দেখা গেলেও, অন্যদের মধ্যে এটি খুবই বিরল ছিল। এছাড়াও, শহরের তুলনায় মরুভূমি ও গ্রামাঞ্চলে এটি বেশি দেখা যেতো। তবে, মুহাম্মাদ (সা.)-এর গোত্র কুরাইশদের মধ্যে এই প্রথা বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয়, তবে তা ব্যাপক ছিলো না। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক যে, কোরবানি দেওয়া বা অন্য কারণে শিশু হত্যার ক্ষেত্রে আরবরা অন্য জাতিদের তুলনায় খুব বেশি আলাদা ছিলো না। ইসলামপূর্ব আরবের প্রতিটি গোত্র তাদের নিজস্ব দেবতা ও দেবীকে রক্ষাকর্তা হিসেবে মনে করতো। এই দেবতা ও দেবীদের আত্মা পবিত্র বৃক্ষ, পাথর, পানির উৎস এবং কূপের সাথে সম্পর্কিত ছিল। আরব পৌরাণিক কাহিনী ও সংস্কৃতিতে, প্রতীকী দেবতা ও দেবীর কারণে মূর্তিগুলোকে পবিত্র মনে করা হতোএবং পূজার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ইসলামপূর্ব আরব উপদ্বীপে অসংখ্য পবিত্র স্থান এবং সেখানে নির্মিত ঘনক্ষেত্রাকৃতি দেবালয় ছিলো। জানা যায়, এই পবিত্র স্থান ও দেবালয়গুলো আরবরা হারাম (নিষিদ্ধ) মাসগুলোতে পরিদর্শন করতো এবং এই মন্দিরগুলোতে বিভিন্ন উপাসনা ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো। মক্কার কাবা ৩৬০টি মূর্তির আবাসস্থল ছিল, যা বিভিন্ন গোত্রের রক্ষাকর্তা দেবতা হিসেবে বিবেচিত হতো। মানাত, লাত ও উজ্জা নামক তিন দেবীকে প্রধান দেবতা ইলাহ-এর কন্যা বলে মনে করা হতো। এই সময়ের অধিকাংশ আরব বাসিন্দা বহুঈশ্বরবাদ ও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিলো। কিছু আরব গোত্র আল্লাহ'র অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল, তবে পরকাল ও কিয়ামতের ধারণা তাদের মধ্যে ছিল না। বেশিরভাগ মূর্তিপূজক মূর্তিগুলোকে ঈশ্বর হিসেবে গ্রহণ করতো না, বরং ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর জন্যে এক ধরনের মাধ্যম হিসেবে দেখতো। যুদ্ধ নিষিদ্ধ তীর্থের মাসগুলোতে (হারাম মাস) আরব গোত্রগুলো উৎসব ও মেলায় অংশগ্রহণ করতো। এই উৎসবগুলোতে তারা নিজ নিজ গোত্রের মূর্তির প্রতি প্রার্থনা, সিজদা ও সম্মান প্রদর্শন করতো, মূর্তির নামে কুরবানি দিতো এবং দান করতো। এরপর প্রতিটি গোত্র কাবা তাওয়াফ করতো। এই তাওয়াফ সাধারণত উলঙ্গ অবস্থায় করা হতো। এই পরিদর্শনগুলোতে তারা দেবতাদের বিভিন্ন উপহার দান করতো, সুগন্ধি ব্যবহার করতো এবং এমনকি এই পরিদর্শনগুলোর পূর্বে রোজা (উপোস) রাখতো। এই সময়ে বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তাবিজ ও কবজ ব্যবহার করাও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এই সকল বহুঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিক রীতিনীতির পাশাপাশি খ্রিস্টান, ইহুদি এবং মাজুসদের মতো একঈশ্বরবাদী বিশ্বাসে বিশ্বাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ও আরব উপদ্বীপে বিদ্যমান ছিল। শক্তিশালী ইহুদি গোষ্ঠীগুলো দক্ষিণে ইয়েমেন এবং উত্তর-পশ্চিমে মদিনার মতো কৃষিভিত্তিক মরুদ্যান শহরগুলোতে বসতি স্থাপন করেছিলো। খ্রিস্টানরাও ইয়েমেন এবং পূর্ব আরবে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে শুরু করেছিলো। যদিও একঈশ্বরবাদী বিশ্বাস বেদুঈন আরবদের ঐতিহ্যবাহী বহুঈশ্বরবাদী বিশ্বাসের উপর প্রভাব ফেলেছিলো, তবুও বহুঈশ্বরবাদ তখনো খুবই শক্তিশালী ছিলো। মুহাম্মাদের সময়ে, আরব উপদ্বীপ সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে উত্তাল ও অস্থিতিশীল ছিল। আরব উপদ্বীপের স্থানীয় আরবদের মধ্যে হানিফরা ছিলো একঈশ্বরবাদী বিশ্বাসীদের একটি সম্প্রদায়। তাদেরকে ভুলভাবে মাঝে মাঝে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সাথে শ্রেণীবদ্ধ করা হতো। ইসলামী শিক্ষা অনুসারে, ইসলামপূর্ব যুগে ইব্রাহিম কর্তৃক প্রচারিত ধর্মের অনুসারীদের হানিফ বলা হতো। কুরআনের কিছু আয়াতে 'হানিফ' শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে এবং হানিফ ধর্মকে মুশরিক ও পৌত্তলিকদের বহুঈশ্বরবাদী ধর্মের থেকে আলাদা ও তার বিপরীত এবং ইব্রাহিম-এর ধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূরা বাকারার ১৩৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা বলে, ‘তোমরা ইহুদী বা নাসারা (খ্রিস্টান) হয়ে যাও, তাহলে সঠিক পথ পাবে’। বল, ‘বরং একনিষ্ঠ হয়ে ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্গত ছিলেন না’।" সূরা বাকারা, আয়াত ১৩৫।

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মুহাম্মাদ (সা.) একজন হানিফ ছিলেন এবং তিনি ইব্রাহিমের পুত্র ইসমাইল এর বংশধর ছিলেন। মদিনায় পৌঁছানোর পর মুহাম্মাদ মদিনার সনদ নামক সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সেখানকার গোত্রগুলোকে একত্রিত করেন। মক্কার গোত্র এবং পৌত্তলিকদের সাথে আট বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর তার অনুসারীর সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

৬৩০ সালের শুরুতে দশ হাজার সাহাবির এক বিশাল মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে মক্কা অবরোধের পর একটি চুক্তির মাধ্যমে রক্তপাতহীনভাবে মক্কার নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। তিনি শহরে প্রবেশ করে সকল মূর্তি ভেঙে ফেলেন এবং তারপর তার অনুসারীদের পূর্ব আরবে অবশিষ্ট সকল পৌত্তলিক মন্দির ধ্বংস করার জন্যে পাঠান। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক সকল অভিযান পরিচালনা করে তিনি আরবের বেশিরভাগ অংশ জয় করেন। তিনিও সর্ব প্রথম এই রকম জঘন্য কাজ থেকে মানুষকে সরে আসার আহবান জানিয়েছিলেন।

আরবের জাহেলী সমাজে নানা কুসংস্কার ছিলো। ভাগ্য নির্ধারক তীর, দেবদেবীর সাথে অলীক পরামর্শ, মৃতের অজ্ঞাতযাত্রার ধারণা প্রভৃতি চালু ছিলো। শুধু তা-ই না, আরো নানা প্রকার ভূত-প্রেত, দৈত্য, পরী প্রভৃতিকে বিশ্বাস করতো। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তাদের মন-মগজ থেকে সমস্ত কুসংস্কার দূর করেন। প্রাচীন আরব নিষ্ঠুরতায় ভরপুর ছিলো। ভোগবাদী আরবরা দাস-দাসী, এমনকি শত্রু গোত্রের লোকদের সাথে অমানবিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতো। বিত্তবানরা খেলার ছলে দ্রুতগামী ঘোড়ার লেজের সাথে নারীকে বেঁধে দিতো। যার ফলে হতভাগা নারীর প্রাণ-প্রদীপ নিভে যেতো। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) সমাজ হতে এরূপ বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা দূর করে সমাজের অমূল পরিবর্তন অনয়ন করেন। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরিত করে সমাজের সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণের নিমিত্তে হযরত মুহাম্মদ (সা.) যাকাতের বিধান প্রবর্তন করেন। যাতে করে সমাজ হতে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম হয়। তিনি ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য সমাজ হতে চিরতরে উৎখাত করেন। মানুষে মানুষে সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূরীভূত করে মানবতার অত্যুজ্জ্বল আদর্শে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের এটাই প্রথম দৃষ্টান্ত। আরবে বহু যুগ ধরে গোলামীপ্রথা বা দাসপ্রথা প্রচলিত ছিলো। মনিবরা গোলামদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করতো। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদাই ছিলো না। তারা পশুর মতো জীবনযাপন করতো। তাদেরকে বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মনিবদের নির্দেশ দিলেন, ক্রীতদাসদের প্রতি সদাচরণ করো। তোমরা যা খাও, পরিধান করো, তা তাদের খেতে এবং পরিধান করতে দাও (সহিহ মুসলিম- ১৬৬১)।

মহানবী (সা.) নারীদের সমাজে অভূতপূর্ণ মর্যাদা দিলেন। তিনি নারী-পুরুষ সকলকে সমমর্যাদা দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সাথে তা সম্পাদন করেছে সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আবরণ বা প্রতিবন্ধক হবে।’ (তিরমিজি, হাদীস নং- ১৯১৩, ১৯১৫)। বিধবাদের সাহায্যকারীদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকীনের জন্যে (খাদ্য যোগাতে) সচেষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি সমতুল্য এবং যারা রাতে (নফল) ইবাদত করে ও দিনে সিয়াম রাখে তাদেরও সমতুল্য।’ (সহিহ বুখারী- ৫৩৫৩; সহিহ মুসলিম- ২৯৮২; নাসায়ী- ২৫৭৭; তিরমিজি ১৯৬৯; ইবনে মাজাহ- ২১৪০)।

তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকতো। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বাজতো আর দীর্ঘকাল যাবত তা দাবানলের মতো জ্বলতে থাকতো। রক্তপাত ও লুণ্ঠন ছিল তাদের নিত্যদিনের পেশা। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এ সমস্ত অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রাক-নবুওয়াত ‘হিলফুল ফুজুল’ এবং পরে ‘মদিনা সনদ’- এর মাধ্যমে সমাজে শান্তি আনয়ন করেন।কুসীদ প্রথা বলতে এক প্রকার সুদের কারবার প্রথা। আরব সমাজে জঘন্য কুসীদপ্রথা বিদ্যমান ছিলো। তারা এত উচ্চহারে সুদের কারবার করতো, যে সুদ পরিশোধ করতে না পারলে সুদগ্রহীতার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির সাথে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে নেওয়া হতো। আরবে প্রচলিত ব্যবস্থা সুস্থ সমাজ বিকাশে প্রচণ্ড বাধাস্বরূপ ছিল। নবীজী (সা.) সুদ হারাম ঘোষণা করেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে ‘করজে হাসানা’ দানে উৎসাহিত করেন।কুসীদ প্রথা বলতে এক প্রকার সুদের কারবার প্রথা। আরব সমাজে জঘন্য কুসীদপ্রথা বিদ্যমান ছিলো। তারা এতো উচ্চহারে সুদের কারবার করতো যে সুদ পরিশোধ করতে না পারলে সুদগ্রহীতার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির সাথে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে নেওয়া হতো। আরবে প্রচলিত ব্যবস্থা সুস্থ সমাজ বিকাশে প্রচণ্ড বাধাস্বরূপ ছিলো। নবীজী (সা.) সুদ হারাম ঘোষণা করেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে ‘করজে হাসানা’ দানে উৎসাহিত করেন।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আর্থ-সামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, হটকারিতা, মজুতদারি, কালোবাজারি, ইত্যাকার যাবতীয় অনাচার হারাম ঘোষণা করে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করে একটি সুন্দর, পবিত্র সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং কারো সম্পদ গ্রাস করা যাবে না; সকলের জীবন-সম্পদ পবিত্র আমানত--এ বিশ্বাসের উপর সমাজ কাঠামোকে গড়ে তোলেন। ৬৩২ সালে বিদায় হজ্জ পালন করেন এবং আরাফাত পর্বতে এক লক্ষেরও বেশি সমবেত মুসলিমের উপস্থিতিতে বিদায়ী ভাষণ প্রদান করার পর মদিনায় ফিরে আসেন। এর কয়েক মাস পর তিনি অসুস্থ হয়ে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করে এবং তিনি আরব উপদ্বীপকে একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে একত্রিত করেছিলেন। হযরত মুহাম্মাদকে যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, তাঁর স্ত্রী আয়েশার ঘরেই তাঁকে দাফন করা হয়।

উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ প্রথমের শাসনামলে মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করা হয় এবং মুহাম্মাদের সমাধি (রওজা মোবারক) স্থানটিকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ত্রয়োদশ শতকে মামলুক সুলতান মনসুর কালাউন নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সমাধির উপর সবুজ গম্বুজটি নির্মাণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ষোড়শ শতকে উসমানীয় সুলতান সুলতান সুলাইমান গম্বুজটির রঙ সবুজে পরিবর্তন করেন। নবী মুহম্মাদ (সা.)-এর কবরের ঠিক পাশে তাঁর সাহাবী এবং প্রথম দুই খলিফা আবু বকর ও উমর ইবনুল খাত্তাব-কে দাফন করা হয়েছে।

পরিশেষে বলবো, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ছিলেন সমস্ত মুসলিম জাহানের জন্যে আশীর্বাদ এবং বিশ্ব সমাজ সংস্কারক হিসেবে ছিলেন একজন অবিস্মরণীয় নেতা। তিনিই সর্বপ্রথম অন্ধকারে আচ্ছন্ন দিশেহারা আরব জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই বলবো, যতোদিন আমরা এই মহামানবকে অনুসরণ করবো ততোদিন অবশ্যই আমরা দিকভ্রান্ত হবো না।

ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও গবেষক; ইংল্যান্ড প্রবাসী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়