প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৫১
মূল্যবান কী যেনো হারিয়ে ফেলেছি
গত ২০ আগস্ট ২০২১ তারিখে আমার ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়েছি এমন-‘ইদানীং চাঁদপুরের এককালের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সামর্থ্যবান উত্তরসূরিদের কাউকে কাউকে যখন মরহুমদের মৃত্যুবার্ষিকীসহ কোনো উপলক্ষেই তাঁদের স্মরণ করতে দেখি না, তাতে বিস্মিত নয়, বিব্রতও হই’।
|আরো খবর
অনেক মনোবেদনায় এমন পোস্ট দিয়েছি। আমরা চাঁদপুর কণ্ঠের পক্ষ থেকে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃত্যুবার্ষিকীতে অন্তত একটি সংবাদ পরিবেশনে খুবই আন্তরিক ছিলাম। কিন্তু এ মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারের পক্ষ থেকে কী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে সেটি জানতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি। কারণ কোনো কোনো পরিবার মৃত্যুবার্ষিকীর তারিখই মনে রাখে না, আবার কোনো কোনো কর্মসূচি গ্রহণের তাগিদও অনুভব করে না। ভাবখানা এমন, তিনি মরে যাবার পর কুলখানি-চেহলামের আয়োজন করেই তো মরণোত্তর সব দায়িত্ব পালন শেষ করে ফেলেছি, অনেক খরচ হয়ে গেছে; বছর বছর খরচ করতে যাবো কেনো?
বিখ্যাত পিতার রেখে যাওয়া বাসস্থান, অর্থ-সম্পদের ওপর নির্ভর করে চলেন, বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, এমন পিতার সন্তানদেরকেও যখন পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালনে বিরত থাকতে দেখি, বাসা-বাড়িতে দূরে থাক, মসজিদে দোয়া-মিলাদ পড়িয়ে জিলাপি বিতরণের খরচটুকু করতে কৃপণতা প্রকাশ করতে দেখি, তখন বিব্রত হই, মনোবেদনা টের পাই।
মন্ত্রী-এমপি ছিলেন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে অনেক দূর এগিয়েছেন তথা জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন, ২-৩টি ব্যতিক্রম ছাড়া এমন প্রয়াত লোকদের জন্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলীয়-পারিবারিক কোনো ক্ষেত্রেই সন্তোষজনক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ তো করাই হয় না, ন্যূনতম স্মরণও করা হয় না। এমন রূঢ় কঠিন বাস্তবতাতে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও সাবেক এমপি ফ্লাঃ লেঃ (অবঃ) এবি সিদ্দিকের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী পালনে তাঁর ভক্তকুল ও পরিবার বিভিন্ন পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জেনে আমি চমকিত হয়েছি। সেজন্যে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করিনি।
২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ জনাব এবি সিদ্দিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর এ তারিখটি নিয়ে কোনো দ্বিমত না থাকলেও জন্ম তারিখ নিয়ে দু ধরনের তথ্য আছে। উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার বরদিয়া সরকার বাড়িতে ১৯২৭ সালে তাঁর জন্ম। আর ‘চাঁদপুর পরিক্রমা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামক গ্রন্থে তাঁর জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ১৯২৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। সে যা-ই হোক, মৃত্যুকালে তিনি অশীতিপর ছিলেন অর্থাৎ তাঁর বয়স হয়েছিলো আশির অধিক। কিন্তু তিনি তাঁর এতোটা জীবনকালে নানা বিবেচনায় বয়সের সীমারেখাকে অতিক্রম করেছিলেন বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞে। নানা বয়স এবং শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে মিশে যাবার এক জাদুকরি ক্ষমতা ছিলো এবি সিদ্দিকের। সেজন্যে তিনি নিজের মর্যাদা, অবস্থান ও ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করেছেন-এমনটি কিন্তু নয়। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনসহ বিভিন্ন অঙ্গনে তিনি নিজেকে এতোটা জড়িয়ে রেখেছিলেন, যাতে তিনি বয়সের সকল পর্যায়ে প্রাণবন্ত থাকতে পারেন। থেকেছিলেনও। আশি-উত্তীর্ণ বয়সেও তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতির যথার্থ বিকাশে নিজের অবস্থান থেকে সক্রিয় ছিলেন, দায়িত্বপরায়ণ ছিলেন।
প্রচণ্ড রকমের পড়ুয়া একজন মানুষ ছিলেন এবি সিদ্দিক। তিনি ছোট-বড় সকল ধরনের লেখকের লেখাই পড়তেন এবং যে লেখকের লেখা তাঁর মনে ন্যূনতম দাগও কাটতো, তিনি তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতেন এবং তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখককে উৎসাহ দিতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে উৎসাহ পাওয়া লোকদের অন্যতম। তিনি আমাকে নামের আগে ‘এডিটর’ বলে সম্বোধন করতেন এবং লেখার নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। তিনি নিজেও লিখতেন। গবেষণাধর্মী লেখার পাশাপাশি প্রবন্ধ, গল্প, এমনকি উপন্যাস লিখতেন।
আমার সাথে তাঁর যখন পরিচয় ঘটে, তখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব, আর আমি পঞ্চাশে। বয়সে বিশ বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন অগ্রণী। সরাসরি সাক্ষাতে আলাপচারিতায় এবং দীর্ঘ ফোনালাপে আমি বার বার সমৃদ্ধ হয়েছি তাঁর জ্ঞানের গভীরতায়। এতে আমি ধন্য হয়েছি, কৃতার্থ হয়েছি।
এবি সিদ্দিকের মৃত্যুপূর্ব অসুস্থতায় চাঁদপুর কণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শ্রদ্ধেয় ইকবাল ভাই (অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার)সহ তাঁকে মতলব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখতে গিয়েছি। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুননাহার চৌধুরীর সাথেও গিয়েছি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে-বসে তিনি যে মানসিক শক্তি-সাহস প্রদর্শন করেছেন, সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সুন্দর স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন, তাতে বিমুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এসেছি। তখন ভাবতেও পারিনি, তিনি আমাদের ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন।
২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সকালে এবি সিদ্দিকের কনিষ্ঠ পুত্র জাবেদ সিদ্দিক আমাকে মুঠোফোনে জানালেন, কাকা! আব্বা আর বেঁচে নেই। আমার কাছে মনে হলো, মনের ভেতরে লালিত আমার কিছু সুন্দর স্বপ্নেরই বুঝি মৃত্যু হলো। আমি স্বপ্নবাজ মানুষটির স্মরণে তাৎক্ষণিক কিছু করার তাগিদে চাঁদপুর কণ্ঠে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেই। এতে ভীষণ তৃপ্তি অনুভব করি। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় নিজের আবেগ উজাড় করে যে লেখাটি আমি লেখি, তার শিরোনাম ছিলো ‘হে প্রিয় বন্ধু! তোমার ভালোবাসার মূল্য আমি দিতে পারিনি.............।’ সত্যি কথা বলতে কি, স্থানীয়ভাবে ফ্লাঃ লেঃ (অবঃ) এবি সিদ্দিকের মতো স্বপ্নবাজ মানুষ এখন খুব একটা খুঁজে পাই না, প্রাণ খুলে সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে করো সাথে কথা বলতে পারি না। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে এখনও অনুভব করি, আমি আমার জীবন থেকে মূল্যবান কী যেনো হারিয়ে ফেলেছি.......শত চেষ্টাতেও সেটি করায়ত্ত করতে পারছি না।
পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল আল্লাহ তাঁর সর্বোচ্চ ঔদার্যে জনাব এবি সিদ্দিককে তাঁর সকল ভালো কাজের বরকতে চিরসুখের জান্নাত দান করবেন-নিরন্তর এ প্রার্থনা জানাচ্ছি।
লেখক : মহাপরিচালক, সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর; প্রধান সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।