প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
রক্তাক্ত কারবালা ও আজকের প্রেক্ষিত
মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম
কারবালা রক্তস্নাত চেতনার নাম। কারবালা সত্যের ওপর অটল থাকার চেতনার নাম, দীপ্তশিখায় জ্বলে ওঠার নাম। কারবালা অন্যায়ের সাথে আপসহীন থাকার নাম। কারবালা মানে মাথা নত না করা, কারবালা মানে দীপ্তসাহসে এগিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ! এ কারবালা সংঘটিত হয় হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমে। মহররমের দশম দিবসকে আরবিতে আশুরা বলা হয়। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাসসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবতারণা হয়েছে দশ মহররম তথা আশুরা দিবসে। সঙ্গত কারণেই আশুরার তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। আশুরার গুরুত্ব সকল নবীর যুগেই স্বীকৃত ছিল। আদি মানব হজরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি, বেহেশত, দোজখ, আকাশ, পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, বায়ু, আগুন, পানিসহ মৌলিক সবই সৃষ্টি হয়েছে এ আশুরা দিবসে। নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ইবরাহিম (আঃ)-এর মুক্তিলাভ, ফেরাউনের কবল থেকে মুসা (আঃ)-এর নীলনদ পাড়ি দিয়ে মুক্তিলাভ, মাছের উদর থেকে ইউনুস (আঃ)-এর মুক্তিলাভ, মহাপ্লাবন হতে নূহ (আঃ)-সহ ঈমানদার মুসলমানদের মুক্তিলাভ, ঈসা (আঃ)-এর আকাশে উত্তোলনসহ ইসলামের ঐতিহাসিক সবই ঘটেছে এ আশুরা দিবসে। অবশেষে এ দিবসেই ইসলামের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে নবী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতবরণের মাধ্যমে। সর্বশেষ কেয়ামতও এ দিবসেই সংঘটিত হবে হবে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে।
|আরো খবর
মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আদরের দুলাল এবং ইসলামের ইতিহাসের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রাঃ) ও নবিদুলালী ফাতিমাতুজ্জাহরা (রাঃ)-এর পুত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ)। চতুর্থ হিজরির ৩ শাবান শনিবার মদিনায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অসত্যের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সত্য পথযাত্রীদের প্রাণের সান্ত¡না। স্বৈরশাসক ও জালিম শাহির পতন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল আপসহীন। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, দুঃশাসনের জগদ্দল পাথর সরিয়ে জাতির কল্যাণে মানবতাবাদীদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। ৬১ হিজরির ১০ মহররম সপরিবারে তাকে নির্দয়ভাবে শহিদ করা হয়। তার হত্যাকারী ছিল সিনান ইবনে আনাস মতান্তরে আমর ইবনে জিলসাওসান।
ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করার কাহিনি বড়ই মর্মান্তিক। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, পিতা আলী (রাঃ)-এর শাহাদাতলাভের পর ইমাম হোসাইন (রাঃ) স্বীয় বড়ভাই হজরত হাসান (রাঃ)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৬ মাস পর হজরত হাসান (রাঃ) আমিরে মোয়াবিয়ার সঙ্গে পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার হাতে খেলাফতের দায়িত্বভার তুলে দেন। এতে ইমাম হোসাইন (রাঃ) অসন্তুষ্ট হয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু পরে বড়ভাইয়ের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
৬০ হিজরি। আমিরে মোয়াবিয়া (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। এর কিছুদিন পূর্বে তিনি অন্তিম শয়ানে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে স্থলাভিষিক্ত করেন এবং তার হাতে সংঘবদ্ধভাবে উম্মতের বাইয়াত প্রদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেই সময়ে যেহেতু ইয়াজিদের চেয়েও খেলাফতের উপযুক্ত সাহাবিগণ জীবিত ছিলেন, তাই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এ প্রস্তাবে আপত্তি তোলেন। এমনকি অধিকাংশ সাহাবি তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
এদিকে ইয়াজিদ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সর্বপ্রথম যারা তার বাইয়াত গ্রহণ করেনি, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সঙ্গত কারণেই শুরু হয়ে যায় ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের ওপর ইয়াজিদি নির্যাতন। এতে সত্যের পতাকাবাহী আপসহীন সংগ্রামী ইমাম হোসাইন (রাঃ) মদিনা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক সেই সময়ে ইরাকের কুফাবাসী বিভিন্ন চিঠিপত্র এবং প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-কে রাষ্ট্রাধিনায়ক মেনে নেওয়া এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব পাঠায়। তারা একই সঙ্গে ইয়াজিদি দুঃশাসনের যাঁতাকল থেকে জাতির মুক্তি-সংগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার অঙ্গীকার জানায়। ইতোমধ্যেই আঠারো হাজার কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর নামে বাইয়াত গ্রহণ করে। তাই ইমাম হোসাইন (রাঃ) নিশ্চিন্তে কুফায় আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এদিকে কুফার হাজার হাজার নাগরিকের পক্ষ হতে ইমাম হোসাইনের নামে বাইয়াত গ্রহণের কথা ইয়াজিদের কানে পৌঁছে যায়। ইয়াজিদ কালবিলম্ব না করে তৎকালীন গভর্নর নোমান বিন বশিরকে বরখাস্ত করে ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে তদস্থলে গভর্নর মনোনীত করে। নবনিযুক্ত ওবায়দুল্লাহ কুফায় এসেই কঠোর নীতি অবলম্বন করে। একইভাবে ইয়াজিদের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর বিশ্বস্ত সহচর মুসলিম বিন আকিলকে গ্রেফতার করে হত্যা করে।
ইমাম হোসাইন (রাঃ) পথিমধ্যে এ নির্মম কাহিনি শুনতে পান। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিও আঁচ করতে সক্ষম হন। তারপরও দৃঢ়প্রত্যয়ী হোসাইন (রাঃ) দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে রাস্তা থেকে ফিরে আসাকে সঙ্গত মনে করলেন না। এক পর্যায়ে মাঝপথে ফোরাত নদীর তীরবর্তী ‘কারবালা’ নামক স্থানে ওবায়দুল্লাহর সৈন্যবাহিনী তাকে অবরোধ করে দাঁড়ায়।
ইমাম হোসাইন (রাঃ) নির্ভয়ে দীপ্তকণ্ঠে ইয়াজিদের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে আবেগবিহ্বল ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন : “উপস্থিত বন্ধুরা! তোমরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করছ। অথচ আমার একটি মাত্র অপরাধ যে, আমি ইয়াজিদের মতো একজন পথভ্রষ্ট ও অধার্মিক ব্যক্তিকে মুসলমানদের আমির স্বীকার করতে পারিনি। আর সে অপরাধেই তোমরা আমার রক্ত প্রবাহিত করতে দাঁড়িয়েছ?”
ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর এ আবেগময় বক্তব্য শোনার পর ইয়াজিদের একমাত্র সেনাপতি ‘হোর’ ইয়াজিদি দল ত্যাগ করে হোসাইন (রাঃ)-এর দলে এসে যোগ দেন। ফলে শুরু হয় যুদ্ধ। বীর বিক্রমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইমাম বাহিনীর সবাই। ঈমানি বলে বলীয়ান নির্ভীক সৈনিকরা একে একে সবাই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। শহিদদের তাজা খুনে লাল হয়ে যায় ফোরাতের তীর। এ হলো কারবালা ও ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনায় দৃষ্টি নিবন্ধ করলে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের বেশ কিছু কারণ উদ্ঘাটিত হয়। মূলত ইমাম হোসাইন (রাঃ)-কে শহিদ হতে হয় জালিম শাসক ইয়াজিদ সরকারের বিচ্যুতির প্রতিকার চাইতে গিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন শাসনব্যবস্থাকে তার সঠিক অবস্থানে নিয়ে আসতে। তিনি চেয়েছিলেন মজলুম মানবতার মুক্তি। তাঁর সংগ্রাম কোনো কাফের শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না; বরং তা ছিল নামধারী মুসলিম শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে। ইসলামের লেবেল গায়ে জড়িয়ে যারা অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডকে জায়েজ বানাতে চায়, ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর সংগ্রাম ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর সংগ্রাম ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধ। সেটি ছিল মানবতার মুক্তি, দুঃশাসন থেকে মুক্তি। এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অপশক্তির সাথে যে কখনও আপস হতে পারে না, ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের স্মৃতি বিজড়িত আশুরা ও মহররম তা-ই শিক্ষা দেয়। কখনও জাতির স্বাধীনতা হরণ করা হলে কিংবা স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে যে গর্জে ওঠতে হয় আশুরা ও মহররম তা-ই শেখায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী নেটওয়ার্ক যে অত্যন্ত সুবিস্তৃত। এ জন্য সত্য পথযাত্রীদের টুঁটি চেপে হত্যার পরম্পরায়ই ইমাম হোসাইনকে শহিদ হতে হয়।
নিষ্ঠুর ইতিহাসের সংঘটক কেউই মহান আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় বিধান হতে রেহাই পায় না। কারবালায় ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর এ সত্যই প্রমাণিত হয়েছে। হজরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর নির্মম মৃত্যুসংবাদ শুনে মক্কা, মদিনা ও কুফায় বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। বিক্ষুব্ধ জনতা ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে দুরাত্মা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। এ বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী নেতা মুখতার। তিনি কুফার ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর হত্যাকাণ্ডে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। এ সংঘর্ষে ইয়াজিদ সেনাপতি সীমারসহ ২৮৪ জন ঘাতক প্রাণ হারায়। এক পর্যায়ে মুখতার সদলবলে কুফার গভর্নর আবদুল্লাহ বিন জিয়াদের সম্মুখীন হয়। টাইগ্রিস নদের শাখা জাবের তীরে উভয়ের যুদ্ধ চলাকালে কুখ্যাত জিয়াদ এক সাধারণ সৈনিকের বর্শাঘাতে বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
জাতি যখন ইয়াজিদি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছিল না, সত্য উপলব্ধি করার পরও যখন তারা অনিয়ম, নির্যাতন নীরবে হজম করে চলছিল, তখন ঈমানের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সাহসের বলিষ্ঠ উচ্চারণে ইমাম হোসাইন (রাঃ) ফোরাতের তীরে ছুটে আসেন। ইয়াজিদি স্বৈরশাসন মেনে নিলেই তাকে এমন নির্মমভাবে কারবালার মরুপ্রান্তরে প্রাণ দিতে হতো না। সামান্য আপসকামী হলেই শহিদি রক্তের ফোঁটায় ফোরাত নদীর পানি রক্তবর্ণ ধারণ করত না। কিন্তু ইমাম হোসাইন (রাঃ) আপসহীনভাবে জাহেলিয়াতের কালো পর্দা উন্মোচন করে সত্যকে প্রোজ্জ্বল করেন। তাইতো জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের ও জিল্লতের পরিবর্তে নাজাতের মহিমায় ভাস্বর ঐতিহাসিক দিবসের নাম আশুরা।
পৃথিবীর ইতিহাসে সত্য প্রতিষ্ঠাকারীদের আদর্শে শানিত মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের স্মৃতি বিজড়িত কারবালার ঘটনা বাতিলের বিরুদ্ধে হকের চিরন্তন সংগ্রামের এক নবতর সংযোজন। প্রতি বছর সেই কারবালা দিবস এসে আমাদেরকে ঈমান ও দেশমাতৃকার প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে যুগের ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে শেখায়। প্রয়োজনে বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের শিক্ষা দেয়। আর এ জন্যে প্রয়োজন ধৈর্যের-ত্যাগের। তাইতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন : ‘ফিরে এসেছে পুনঃ মহররম, মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস) আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স।