শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২২, ১২:২৯

‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী’ একজনই

মীর আব্দুল আলীম
‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী’ একজনই

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একটি নাম, একটি ইতিহাস। এদেশের সাংবাদিক, পাঠকসমাজের কাছে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই বাহান্ন থেকে ২০২২ সাল অব্দি তাঁকে ঘিরে অনেক স্মৃতি। সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে রচনা করেন। এ কালজয়ী গানের রচয়িতাই তিনি নন, বাঙালি জাতির ক্রান্তিকালে তাঁর কলম সবসময় গর্জে উঠেছে নানামুখী লিখনিতে। তবে বাস্তবতা এটাই, এ একটি গানই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে হাজার বছর। তাঁর অন্য অবদানের কথা না হয় না-ই বললাম।

সৃষ্টিশীল মানুষ, কলমের জাদুকর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। নতুন কিছু লেখার নেশায় বিভোর থাকতেন সারাটা সময়। তাঁর ছিলো চমৎকার লিখনিশক্তি। তিনি আমৃত্যু দেশের জন্যে লিখেছেন, দেশের মানুষের জন্যে লিখেছেন। তাঁর কলম কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েও তিনি সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তবে তা ছিলো দিকনির্দেশনামূলক, দেশের কল্যাণে লেখা। তাইতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে ভালোবাসতেন, সমীহ করতেন। শক্তিমান এ লেখক যাঁদের সমালোচনা করে লিখতেন তাঁরাও কখনো চটে যাননি তাঁর উপর। কারণও ছিলো একটা। তিনি সবসময় গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। যে বিষয়ে সমালোচনা করেছেন তার সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। লেখনির সে কী এক অনবদ্য জাদু ছিলো তাঁর মধ্যে। সেই নতুনধারার আজকের কাগজ আর জনকণ্ঠের দাপুটে লেখক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এ দুটি পত্রিকায় আমিও শুরু থেকে শেষ অব্দি কাজ করেছি। আজও জনকণ্ঠের সাথে যুক্ত আছি। বহুবার তাঁর সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।

আমি সবে ছাত্রজীবন শেষ করে লেখালেখি করি। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী কোথাও এসেছেন জানতে পারলেই ছুটে যেতাম তাঁর কাছে। মানুষটির লেখার অসম্ভব ভক্ত ছিলাম আমি। একদিন বললাম, আমি আপনার ছোট ভাই হয়ে থাকতে চাই, তাই ভাই বলে ডাকার অনুমতি দিবেন দয়া করে। মিষ্টি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, তুমিতো আমার ছোট ভাইই। সেই থেকে প্রিয় গাফ্ফার ভাইকে অনুসরণ করেই পথ চলছি আমি। আজকের কাগজ কিংবা জনকণ্ঠে লেখা ছাপা হতো সম্পাদকীয় পাতার শুরু থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত। দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে কখন যে শেষ হতো, ভাবতাম আরেকটু যদি লিখতেন। কী জাদুই-না ছিলো তাঁর লেখায়। শুরু করলে শেষ না করে ক্ষ্যান্ত ছিলো না। প্রিয় লেখক গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে এদেশের হাজারো পাঠকের কত না স্মৃতি রয়েছে। সেসব স্মৃতি হয়তো কখনোই লিখে শেষ করবার নয়।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একজন পরিচ্ছন্ন লেখক। তিনি ছিলেন যেনো এদেশের জীবন্ত এক আর্কাইভ। তাঁর ভাণ্ডারে এতো তথ্য জমা ছিলো যা অন্য কোনো লেখকের কাছে আছে কি না তাতে আমি সন্দিহান। যেটাই লিখতেন সেটা হতো তথ্যবহুল। আমি যতো দূর জানি, তিনি কাগজ-কলমেই লিখতেন। কম্পিউটারে নয়। একদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে চায়ের আড্ডায় বসেছিলাম। হঠাৎ দৌড়-ঝাঁপ শুরু হলো। বলাবলি হচ্ছে ‘গাফ্ফার ভাইয়ের লেখা এসেছে’। ফ্যাক্সের এক গাদা কাগজ সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধানের টেবিলে আনা হলো। সেই থেকে জানি, তিনি পত্রিকাগুলোতে হাতে লিখে পাঠাতেন। সেসব লেখা আসতো ফ্যাক্সে করে। এতো আরও ১০/১২ বছর আগের কথা। সর্বশেষ পত্রিকাগুলোতে কীভাবে লেখা পাঠাতেন তা জানতে আমি আজ (৭ জুন) দেশের কয়েকটি শীর্ষ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সাথে কথা বলি। তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত হাতেই লিখেছেন-এটা নিশ্চিত হয়েছি। তবে প্রিয় এ লেখকের মেয়ে বিনতী চৌধুরী জীবিত থাকতে পিতার লেখা স্কেনিং করে ফ্যাক্সের পরিবর্তে ই-মেইলে পাঠাতেন। জানলাম মেয়ে বিনীতা লন্ডনেই তাঁর সাথে থাকতেন। শিক্ষকতা করতেন। মেয়ের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন প্রিয় লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। আসলে হাতে লেখার কথা টেনে আনলাম এ কারণে, বিজ্ঞানের এ যুগে বিশেষ করে আমরা যারা লেখালেখি করি, গুগল আমাদের সব সহজ করে দিয়েছে। কোনো তথ্য-উপাত্তের জন্যে গুগলে সার্চ দিলেই তাৎক্ষণিক তথ্য পেয়ে যাই। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর গুগল আর কম্পিউটার ছিলো তাঁর মাথাতে। তাইতো তাঁকে আর্কাইভ, তথ্য-ভাণ্ডার বলি আমরা। মাথার মথ্যেই সব ডাটা সংরক্ষিত থাকতো তাঁর। অনেক পত্রিকা অফিসের কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে গুগল থেকে না পেলে তাঁকে রিং করে তথ্য নিতেন এমন কথাও আমরা জানি।

সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে কবি হেলাল হাফিজের কবিতার আলোচনা একং কবিতা-সন্ধায় আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ পাই। সেখানে অনেক কবি ছিলেন। আলোচক হিসেবে ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন আপাও। ছিলেন কবি নাসির ভাই। আলোচনা শেষে আলাপকালে নাসির ভাই বললেন, ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে আপনি একটা লেখা লিখেন’। দৈনিক জনকণ্ঠ যখন রমরমা শীর্ষ পত্রিকা তখন কবি নাসির আহম্মেদ ওই পত্রিকাতে ছিলেন। পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা মানেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা। সবসময় তাঁর লেখা থাকতো জনকণ্ঠে। সেই থেকে নাসির ভাই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরকে মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন অন্যভাবে। সেই ভালোবাসা থেকেই তিনি আমাকে এ শক্তিমান লেখককে নিয়ে লেখতে বললেন। আমি সেদিন একটা কথাই বললাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরকে নিয়ে লেখার শক্তি আমার নেই। কোথায় ভুল হয়ে যায় সেই ভয়ও আছে। তবুও বললেন, লিখেন। তাই সাহস করে লিখছি। এ অল্প এক-দেড় হাজার শব্দে প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে কী এমন লিখতে পারবো। তাঁকে নিয়ে লিখলে তো একটা বিশাল মোটা বই হয়ে যাবে।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জীবনে আর কিছু হয়তো পাওয়ার নেই। এক জীবনে মানুষের কতইবা প্রয়োজন আছে। সাত দশকের অসংখ্য লেখালেখির পরও একটি গানের রচয়িতা হিসেবেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একটি গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। একটা মানুষের জন্যে এতো ভালোবাসা। কী চাই আর তাঁর।

একটু ’৫২-এর কথায় আসি। ঢাকায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে যেদিন গুলি চলেছিলো, তার দুদিন পর দুই বন্ধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর শফিক রেহমান যোগ দিয়েছিলেন এক প্রতিবাদ মিছিলে। দুজনেই তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, শফিক রেহমান তখন পরের মাসে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছাত্রজীবনেই দেশের জন্যে ত্যাগী ছিলেন প্রিয় এ লেখক। মিছিলটি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছে, পুলিশের হামলায় আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একসময় ঢাকার সাড়া জাগানো পত্রিকা যায়যায়দিনের সম্পাদক শফিক রেহমান সেদিন মিছিলে ছিলেন তাঁর সাথে। তিনি লিখেছেন, ‘তখনই বেশ লম্বা-চওড়া, মোটা-সোটা ছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। আমি ছুটে গিয়ে তাকে তুললাম, আমার কাঁধে ভর দিয়ে কিছুদূর হাঁটার পর একটা রিকশা পাওয়া গেলো। সেই রিকশায় করে আমি তাকে নিয়ে গেলাম ৩৭ নম্বর বেচারাম দেউরিতে, সেই বাড়িতেই তখন আমরা থাকি। আমার বাবা তখন ঢাকা কলেজের হোস্টেলের সুপারিন্টেনডেন্ট’। পরের কয়েক মাস আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ওই বাড়িতেই কাটিয়েছেন। এখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন সেই কবিতা : ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’, যেটি পরবর্তীকালে আলতাফ মাহমুদের সুরে পরিণত হয় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রধান সঙ্গীতে।

খ্যাতিমান লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯ মে ২০২২ লন্ডনে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান। সাত দশকের বেশি সময় ধরে দুই হাতে লিখে গেছেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, দুর্নীতি, বাংলাদেশের সব ধরনের উত্থান-পতনকে বুকে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন এ প্রিয় লেখক। যতো দিন বাংলা ভাষা, শহিদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গান থাকবে ততোদিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালির মাঝে বেঁচে থাকবেন।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনে দীর্ঘদিনের প্রবাসজীবন ছিলো তাঁর। সেখানে বসেই কলম চালাতেন দেশের জন্যে। জেগে থাকতেন দেশের মানুষের কল্যাণ-ভাবনায়। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন এ লেখক। মেয়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভেঙ্গেও পড়েন। তবু চলেছে কলম। একজন মানুষের কর্মের লক্ষ্য থাকে সাফল্য। সেই সাফল্যের চেয়ে বেশিই হয়তো পেয়েছেন এ লেখক। সাফল্যই তাঁকে কিংবদন্তি করে তুলেছে। প্রবাদতুল্য এ মানুষটির জন্যে কত না ভালোবাসা মানুষের। তাঁর প্রয়াণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের সব বিশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেছেন। ভারতের শীর্ষ আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ‘প্রয়াত হলেন ঢাকার বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের নীলকণ্ঠ পাখি’। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক জ্ঞানের চর্চায় নিবিষ্ট থাকা এক মানুষ। তাঁর পুরো দেহটা ছিলো দেশপ্রেমে ভরা। বাংলাদেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি ছিলো তাঁর অকৃত্রিম ও শর্তহীন আনুগত্য, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। আমাদের অনন্ত ভালোবাসা শ্রদ্ধাও রইলো দেশপ্রেমী এ লেখকের প্রতি।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ার এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যখন রক্ষণশীল রাজনৈতিক বিশ্বাসের বাইরে আসতে নারাজ তখন অনুরূপ এক পারিবারিক পরম্পরার যে মানুষটি সেদিন দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে কলম ধরেছেন তিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বাঙালির ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রয়েছে গাফ্ফার চৌধুরীর নাম।

১৯৭৪ সাল থেকে গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডনপ্রবাসী। স্বাধীনতার পর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে বেছে নেন লন্ডনের স্থায়ী প্রবাসজীবন। অজানা এক ভাইরাসের আঘাতে তার স্ত্রীর শরীর অবশ হয়ে যায়, পরিশেষে তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। টানা চল্লিশ বছর তিনি হুইল চেয়ারেই কাটিয়েছেন। দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকার পর ২০১২ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। অসুস্থ স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে জীবননির্বাহ করতে গিয়ে তাঁকে লন্ডনের গ্রোসারি শপেও কাজ করতে হয়েছে। এখন জীবিত এক পুত্র ও তিন কন্যার সবাই উচ্চশিক্ষিত। মাত্র একমাস আগে তাঁর আরেক মেয়ে বিনীতার অকাল মৃত্যু হয়েছে। লন্ডনে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেও তিনি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। প্রবাসে থেকেও নিজের লেখনির মাধ্যমে তিনি মুক্তবুদ্ধি এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছেন কলাম-গল্প-কবিতা-উপন্যাস। বহুমাত্রিক কলমযোদ্ধা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

একজন লেখক বলেছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘কলম পেশা মজুর’ ছিলেন। শব্দটা বেশ ভালো লেগেছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জীবনটিই কেটেছে লেখালেখির মধ্য দিয়ে। তিনি তাঁর জীবন চালানোর মূল মাধ্যম হিসেবে কলমকেই বেছে নিয়েছিলেন। যেখানে অন্যকিছুর ধারের কাছেরও ছিলেন না গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৫০ সালেই গাফ্ফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। এ সময় তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফ্ফার চৌধুরী। এ সময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। তিনি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। একজন মানুষের জীবনে আর কী চাই।

১৯ মে বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো একজন খ্যাতিমান কলমযোদ্ধার জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে একটি জীবন্ত ইতিহাসেরও পরিসমাপ্তি ঘটলো। তিনি নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। চিকিৎসক আগাম মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন। চিকিৎসকের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই তিনি আমাদের সবাইকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গাফ্ফার চৌধুরী সর্বদা বস্তুনিষ্ঠ কলাম লিখতেন, যাতে জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকতো। আমরা এখন এই কলামগুলো থেকে বঞ্চিত হবো।

তাঁর হৃদয়জুড়ে বিরাজ করতো প্রিয় মাতৃভূমি, যা তাঁর লেখনিতে প্রকাশ পেয়েছে সবসময়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর লেখনী, তাঁর অবদানের কথা ‘আমরা কি কখনো ভুলিতে পারি’। বিশ্বখ্যাত একজন বরেণ্য সাংবাদিক হিসেবে তাঁর অবদান বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে সবসময়। ভালো থাকবেন প্রিয় লেখক। শ্রদ্ধা।

মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়