প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২২, ০০:০০
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা
শাওন মাহমুদ
একুশের গান। দীর্ঘ কবিতাটির প্রার্থনা, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, শোক, গর্ব, অশ্রু মাখানো শব্দগুলোতে যখন ঐশ্বরিক সুরের মূর্ছনায় বাতাসের গায়ে ভেসে বেড়ায় তখন মনে হয় এ তো গান নয়, আমাদের হৃদয়ে জমে থাকা শোকের পাহাড় পেরিয়ে তারুণ্যের হৃদয় ভরা আলোকিত চেতনার গীতিকাব্য শুনছি।
সেই ছেলেবেলা থেকে একুশের মিছিলে প্রভাতফেরিতে গাওয়া গান আমার জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বড় হতে হতে মায়ের কাছে, বাবার সহযাত্রীদের কাছ থেকে যত জেনেছি আর পড়েছি, ঠিক তারচেয়েও অনেক বেশি আপ্লুত হয়েছি দুইজন মানুষের জন্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং আলতাফ মাহমুদ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানোর দুইদিন পর বন্ধু শফিক রেহমানের সঙ্গে এক প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তখন তারা দুজনই ঢাকা কলেজের ছাত্র।
মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে দিয়ে যায়। এই সময় পুলিশের হামলায় আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান গাফ্ফার চৌধুরী। শফিক রেহমান তাকে উদ্ধার করে ৩৭ নম্বর বেচারাম দেউড়ির বাসায় নিয়ে আসেন।
পরের কয়েক মাস গাফ্ফার চৌধুরী শফিক রেহমানের বাড়িতেই অবস্থান করেন। সেখানে বসেই ভাষা শহীদদের নিয়ে লেখেন তার অমর কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’ এই কবিতাই পরবর্তীকালে আলতাফ মাহমুদের সুরে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রধান সংগীতে পরিণত হয়। ১৯৫৩ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর কবিতা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয়। এবং কবিতাটি প্রথম সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ।
সেই সময়ে আব্দুল লতিফ, গাজীউল হক, নিজামুল হক তাদের রচিত এবং সুরারোপিত গানগুলো আলতাফ মাহমুদকে দিয়ে পরিবেশন করাতে ভালোবাসতেন। ১৯৫৩ সালের শেষের দিকে আলতাফ মাহমুদ একুশের গানের নতুন করে সুর দেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নতুন সুরে করা গানটি শোনাবার পর আলতাফ মাহমুদকে সাথে করে আব্দুল লতিফের কাছে নিয়ে যান তিনি। অতি ভীত আলতাফ মাহমুদ অতি যতনে নিজের সৃষ্ট সুরে একুশের গানটি গেয়ে শোনান।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই গান শোনার পর আব্দুল লতিফ অশ্রুসিক্ত এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তোর সুর আমার চেয়েও অনেক সুন্দর হয়েছে, এখন থেকে এই সুরেই আমরা একুশের গান গাইব।’ একজন শিল্পীর প্রতি আর একজন শিল্পীর এই শ্রদ্ধাবোধ এখনকার সময়ে বিরল।
যতদূর তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে আলতাফ মাহমুদের সুরেই একুশের গান গাওয়া হয়েছিল। সেই অমর ভাষার গান, আমাদের গর্বের গান।
আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং আলতাফ মাহমুদ তখনো জানতেন না তারা আগামীর জন্য এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি তৈরি করে ফেলেছেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে একুশের গানের সুর আলতাফ মাহমুদকে জায়গা করে দিয়েছে এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে।
মায়ের কাছে শুনেছি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষে বা একদম আগস্টের প্রথম দিকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং জহির রায়হান আমাদের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডে এসেছিলেন, বাবাকে সাথে করে লন্ডনে নিয়ে যাবেন তাই।
সেই সময়ে যাওয়ার জন্য তিনি রাজি হননি ঠিক। হাতে অনেক কাজ ছিল। ‘আপনারা যান, আমি কাজ শেষ হলে রওনা দেবো,’ জানিয়েছিলেন তিনি। করোনাকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে লাইভ করার। সেই সময়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমি আত্মগ্লানিতে ভুগি। একাত্তরের সেই সময়ে আলতাফ মাহমুদকে আমি জোর করিনি আমাদের সাথে লন্ডনে যাওয়ার জন্য। জোর করলে আজ আলতাফ মাহমুদ বেঁচে থাকতেন।’
এরপরে আরেকটি লাইভ করেছিলেন মায়ের সাথে, সেখানেও তিনি বারবার তাঁর আত্মগ্লানির কথা উল্লেখ করছিলেন। মাকে বলেছিলেন, ‘আমার কবিতাটি সেই দীর্ঘ কাব্যই থেকে যেত, যদি না আলতাফ মাহমুদ সুর করতেন। তার জন্যই আজ এই গান পৃথিবীময় মানুষের কাছে বেঁচে আছে, থাকবে আজীবন। আমি সেদিন জোর করিনি ভাবী, তাকে জোর করলে আপনাকে বিধবা হতে হতো না। শাওন পিতৃহীন হতো না। যত বয়স বাড়ছে তত গ্লানির বোঝা এসে হানা দিচ্ছে আমায়।’
গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, দুর্নীতি, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, উত্থান-পতন, দেশপ্রেম, ভাষা এমন প্রতিটি চেতনাকে ছুঁয়ে তিনি আমাদের পাশে থেকেছেন।
একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠ হয়ে তিনি আমাদের কাছে আমাদের প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হয়ে থেকেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের সামনে এক গর্বিত এবং দৃঢ়চিত্তের অভিভাবকের পরিচয় করিয়ে দেয়।
আলতাফ মাহমুদ এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমার কাছে এক অনন্য এবং অনবদ্য মানিকজোড়ের উদাহরণ। তাদের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের জন্য চিরস্থায়ী এক কাব্য রচনা করে যাবে, অনন্তকাল ধরে। তারা দুজনও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, অনন্তকাল ধরে, বাংলার হৃদয় জুড়ে।
শাওন মাহমুদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা।