প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২২, ২১:২৪
চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং তাণ্ডব
বিদ্যুৎ সঞ্চালন লণ্ডভণ্ড ॥ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
মোঃ মিজানুর রহমান
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে চাঁদপুরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা বলতে গেলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ঘর-বাড়ি, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে এবং বিনষ্ট হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের ক্ষয়ক্ষতির অবস্থা এমন-কেনো কোনো উপজেলা টানা দুদিন পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাণহানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পুরো জেলায় কয়েকশ’ ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটিও পড়ে গেছে। ২৪ অক্টোবর সোমবার রাতে জোয়ারের পানি বাড়ায় জেলার নিম্নাঞ্চল ২ থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। দিন-রাত টানা বর্ষণে চাঁদপুরের দুটি সেচ প্রকল্পসহ বিস্তৃত জমির ফসল নষ্ট হবার আশঙ্কা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে তারা। ঝড়ো বাতাসে আমন ধান হেলে পড়েছে। জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে বিভিন্ন ফসল। বিশেষ করে শীতকালীন শাকসবজির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
|আরো খবর
এদিকে চাঁদপুরের আকাশে মঙ্গলবার স্বাভাবিক সূর্যের আলো দেখা যায়। আকাশ বেশ পরিস্কার। সকাল নয়টার দিকে রোদ উঠেছে চাঁদপুরের আকাশে। ফুটে উঠেছে ক্ষয়-ক্ষতির চিহ্ন। প্রবল বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাস্তা জুড়ে দেখা যাচ্ছে ছোট বড় অসংখ্য গর্ত। ঝড়ের আঘাতে বেশ কিছু জায়গায় গাছ ভেঙে পড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে বহু ঘর-বাড়ি। বড় বড় গাছ, গাছের ডাল বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের উপর পড়ায় এবং বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়ায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। সে সব জায়গায় গাছপালা সরানোর কাজ চলছে এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সচল করার কাজ চলছে। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত পুরো জেলায় তা সম্ভব হয়নি। গতকাল সকাল থেকেই দেখা গেছে সে সব গাছপালা ও ঘর-বাড়ি সরানোর কাজে লেগে পড়েন স্থানীয়রা। অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার টিনের চালা উড়ে গেছে।
জেলা বিদ্যুৎ অফিস সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল থেকে চাঁদপুর বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। কুমিল্লার মেইন সঞ্চালন লাইন থেকে চাঁদপুরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তার উপর বিভিন্ন জায়গায় গাছপালা উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে মূল শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা সম্ভব হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা সম্ভব হয়নি।
মঙ্গলবার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ঝড়ের পূর্বেই সতর্ক করে মাইকিং করা, চরাঞ্চলের পরিবারগুলো নিরাপদ আশ্রয়ে থাকায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছ ভেঙ্গে ও উপড়ে পড়ে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটের কিছু ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। কোনো কোনো স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি নষ্ট হয়েছে। জেলা প্রশাসন উপজেলা প্রশাসনকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে নির্দেশনা দিয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা (পূর্ব) ইউনিয়নসহ বেশ কিছু জায়গায় অনেক বাড়িঘর রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গাছপালা উপড়ে গেছে। ইউপি চেয়ারম্যান হারুনু রশিদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, গাছপালা ও মানুষের খোঁজ খবর নিতে বিভিন্ন গ্রাম তিনি পরিদর্শন করছেন। এছাড়া ফরিদগঞ্জ সাহেবগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ উপজেলায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা রাত পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি।
হাইমচর উপজেলার আলগী দূর্গাপুর উত্তর ইউপি চেয়ারম্যান আতিক পাটওয়ারী জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে তার ইউনিয়নের বহু কাঁচা ঘর-বাড়ি, গাছপালা এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই উপজেলায়ও বিদ্যুৎ নেই দু’দিন যাবত।
এদিকে বিদ্যুৎ কর্মীদের মাধ্যমে জানা যায়, সোমবার সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর ইউনিয়নের জাফরাবাদ আলম খানের বাড়ির সামনে রাস্তার উপর গাছ উপড়ে পড়ে।
শহরের বড় স্টেশন আক্কাছ আলী রেলওয়ে একাডেমিতে সিত্রাংয়ের আঘাতে প্রচুর ভেষজ ও ফল-ফলাদি গাছ পড়ে গেছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক গোফরান হোসেন।
পুরাণবাজার মধুসূদন হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফরিদ আহমেদ নাজিম (১৪) জানান, স্থানীয় মেরকাটিজ রোডের আজিজ ঢালীর বাড়ির একটি গাছ বিদ্যুৎ ও ওয়াইফাই লাইনের তারের উপর পড়ে।
পৌর ৯নং ওয়ার্ডের নদীরপাড়ের অসহায় মিজানের স্বপ্ন নিমিষেই নদীতে ভেসে যায়। ঝড় হবার কথা আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিলো সকলকে। কিন্তু ৪ মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে কোথাও যায়নি অসুস্থ দিনমজুর মিজান। নদী লাগোয়া তার মাটির ঘরটি। মিজান পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘরে বসেছিলেন। ঠিক রাত ১০টার সময় প্রচণ্ড বাতাস আর নদীর ঢেউয়ের তাণ্ডবে তার ঘরের ভিটে-মাটি ধুয়ে নিয়ে সুড়ঙ্গ করে ফেলে রাক্ষসী মেঘনা। কাঁত হয়ে পড়ে যায় তার ঘরটি। ঘরের মাটির সাথে ভেসে যায় সকল আসবাবপত্র। এর সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ছোট মেয়ে সুমিয়ার ৫ম শ্রেণির বইগুলোও। সারারাত সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে বসেছিলো খোলা আকাশের নিচে। অসহায় মিজানের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিত্তবানদের কাছে বিনীতভাবে আহ্বান জানান সাংবাদিক একে আজাদ।
অপরদিকে মতলব প্রতিনিধি জানিয়েছেন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মতলব বিদ্যুৎবিহীন থাকায় জনদুর্ভোগ চরম পর্যায় পৌঁছায়। মতলব দক্ষিণ উপজেলার পৌরসভা, ইউনিয়নসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল ছিলো বিদ্যুৎবিহীন। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গাছপালা, ঘর-বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২৪ অক্টোবর সকাল থেকে ২৫ অক্টোবর বেলা ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন ছিলো চাঁদপুরের কয়েকটি উপজেলা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ থেকে চাঁদপুর শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার চেষ্টা করা হলেও ঝড়ের প্রভাবে শেষ পর্যন্ত করতে পারেনি। দু’একটি লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাইন টেকাতে পারেনি। আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিল বিদ্যুৎ। আবার কোনো কোনো লাইনে সারাদিনে এক ঘন্টাও বিদ্যুৎ ছিলো না। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪ অক্টোবর সকাল থেকেই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকটা বিচ্ছিন্ন। সদর উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ। গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের পরে অনেক স্থান গাছ ভেঙে পড়েছে। যে কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত ডিভাইসগুলো। বিশেষ করে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার এবং আধুনিক অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিরা।