প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:৪৯
ওয়ারীতে বিষাদসিন্ধু: স্বামী-স্ত্রীর রহস্যমৃত্যু, পাশে বেদনাবহ চিরকুট

রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়ারী থানা এলাকার জমজম টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর রহস্যজনক মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃতরা হলেন মোহাম্মদ মুঈদ (৩২) ও তার স্ত্রী আইরিন আক্তার রত্না (৩৫)। শনিবার (১৯ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে ফ্ল্যাটটির কেচিগেট ভেঙে পুলিশ মরদেহ দুটি উদ্ধার করে।
|আরো খবর
ওয়ারী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাউছার আহম্মদ জানান, দম্পতির মরদেহ একই কক্ষে, একই বিছানায় পড়ে ছিল। স্বামী মুঈদের মরদেহে পচন ধরেছিল, ধারণা করা হচ্ছে তিনি চার-পাঁচদিন আগেই মারা যান। স্ত্রী রত্নার মরদেহ ছিল অপেক্ষাকৃত অক্ষত, সম্ভবত স্বামীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
ফ্ল্যাটের পাশে চিরকুট: “আমাদের মরদেহ ঢাকাতেই দাফন দিন”
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে, যেখানে লেখা রয়েছে: “বিয়ের পর আমার বাবা-মা স্বামীর পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। আমাদের মরদেহ ঢাকাতেই কোনো সরকারি কবরস্থানে দাফন দিন। বাড়িতে নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
পুলিশ বলছে, চিরকুটের লেখার ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটি রত্নার লেখা, তবে বিষয়টি নিশ্চিত হতে হস্তলিখন বিশ্লেষণ করা হবে।
দীর্ঘদিন একাকী জীবন, আর্থিক টানাপোড়েন
এসআই কাউছার জানান, দম্পতির কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। দুই মাস ধরে গৃহকর্মী বেতন পাননি। রোজার ঈদের পরে দেওয়ার কথা ছিল। গৃহকর্মী গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বেতন চাইতে গেলে বারবার কলিংবেল টিপেও কোনো সাড়া না পেয়ে ফিরে যান। শনিবার বাড়িওয়ালার সহায়তায় আবার যান এবং সাড়া না পেয়ে পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে মৃত অবস্থায় দম্পতিকে পায়।
মুঈদ ছিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত, স্ত্রীর ঘরবন্দি জীবন
পুলিশ জানিয়েছে, স্বামী মোহাম্মদ মুঈদ দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তবে বাস্তবায়ন হয়নি। স্ত্রী রত্না সবসময় বাসায় থাকতেন এবং বাইরে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
স্বজনদের মুখে বিচ্ছিন্নতার গল্প
মুঈদের বড় ভাই ডা. মুগলী সানি গণমাধ্যমকে বলেন, “২০২১ সালের পর ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ঢাকায় কোথায় থাকতেন তাও জানতাম না। পুলিশ ফোন দিয়ে মৃত্যুর খবর জানায়।”
তিনি জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার আড়াই কান্দি গ্রামে। তাদের বাবার নাম মো. মুসা।
মৃত রত্নার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার এক গ্রামে। তার বাবার নাম জয়নাল আবেদিন।
ক্রাইম সিনে সিআইডি, তদন্তে নেমেছে পুলিশ
পুলিশ সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে ডেকে মরদেহের পাশে ও ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। ফ্ল্যাটের দরজা ছিল ভেতর থেকে বন্ধ, জানালা ছিল সিল করা।
ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ দুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
প্রাথমিক ধারণা: আত্মহত্যা নয়তো হতাশার মৃত্যুর গল্প?
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “ফ্ল্যাটে প্রবেশের পর দৃশ্য দেখে আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে।”
সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে এমন ঘটনা
নগরজীবনের ব্যস্ততা ও একাকীত্ব যে কিভাবে মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তুলছে, এই ঘটনাটি তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, অসুস্থতা ও আর্থিক অনিশ্চয়তা মিলে কখনো কখনো ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।
ডিসিকে/এমজেডএইচ