প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৪৮
মেঘনায় সারবাহী জাহাজে ৭ জন খুন
রাতে কথা হয়েছে, সকালে কেউ ফোন ধরেননি, বললেন জাহাজের মালিক ॥ কাগজে যা লিখেছেন বেঁচে থাকা ব্যক্তি
|আরো খবর
মেঘনা নদীতে এমভি আল-বাখেরা নামে একটি পণ্যবাহী জাহাজে ৭জনকে হত্যা করেছে দুর্ধর্ষ ডাকাত দল। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। জেলা পুলিশ, নৌ পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড পাঁচজনের মরদেহ জাহাজ থেকে উদ্ধার করলেও মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আরো দুজন মারা যায়। অপর একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা রেফার করা হয়েছে।
লোমহর্ষক এমন ঘটনা রোববার দিবাগত ( ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪) গভীর রাতের কোনো এক সময় হাইমচরের ঈশানবালা মাঝির বাজারের নিকটস্থ মেঘনা নদীতে ঘটে। ভয়ঙ্কর এমন ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় জনমনে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সোমবার (২৩ ডিসেম্বর ২০২৪) দুপুরে ঘটনাস্থল থেকে জেলা পুলিশ, নৌ পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে এবং তিনজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালে আনার পর আরো দুজন মারা যান। অপর একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা পাঠানো হয়। নিহত সবাই ডাকাতি হওয়া জাহাজ এমভি আল-বাখেরার স্টাফ বলে জানা গেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় যাকে ঢাকা রেফার করা হয়েছে তার শ্বাসনালী কেটে গেছে।
জানা গেছে, হাইমচর উপজেলার মাঝির বাজার এলাকায় মেঘনা নদীর পাড়ে জাহাজটি নোঙ্গর করা অবস্থায় ছিলো। চট্টগ্রাম থেকে সার নিয়ে জাহাজটি সিরাজগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলো। ডাকাত দল স্পিডবোট নিয়ে জাহাজে উঠে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে সাতজনকে আহত করে। এদের মধ্যে পাঁচজন ঘটনাস্থলে এবং বাকি তিনজনের দুজন হাসপাতালে মারা যান। নিহতদের কারো কারো গলা কাটা ছিলো। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ ও জেলা পুলিশ।
এর পূর্বেও চাঁদপুর ঈদগাহ ফেরিঘাট সংলগ্ন আলু বাজার এলাকায় যাত্রীবাহী ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চাঁদপুরে কোস্ট গার্ডের স্টেশন এবং নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চল নামে আলাদা দুটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দপ্তর থাকার পরও চাঁদপুরের নদীপথ এতোটা অনিরাপদ হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ ও ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে চাঁদপুর কোস্ট গার্ড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক জানান, হাইমচর উপজেলায় মেঘনার ঈশানবালা এলাকায় মালবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখেরা থেকে ৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের শরীরে দেশিয় অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গলা ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জাহাজ থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় আরও তিনজনকে উদ্ধার করা হয়।
অন্যদিকে নৌ-পুলিশের চাঁদপুরের অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মোশফিকুর রহমান জানান, পণ্যবাহী নৌযানটির পাঁচ কক্ষ থেকে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের দেশিয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। নৌযানটিতে ছিলেন আটজন।
এদিকে জাহাজ থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করে সোমবার বিকেল ৪টার দিকে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তাদের মধ্যে দুজনকে কর্মরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আহত অপরজনের নাম জুয়েল (২৮)। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা পাঠানো হয়েছে। তবে তার অন্য পরিচয় জানা যায়নি।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক ডা. আনিসুর রহমান জানান, আহত অবস্থায় তিনজনকে হাসপাতালে আনা হয়। দুজন এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন রয়েছে।
নিহতরা হলেন : জাহাজের মাস্টার কিবরিয়া, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন, সুকানি আমিনুল মুন্সি, গ্রীজার সজিবুল, আজিজুল ও মাজেদুল ইসলাম। নিহত একজনের নাম জানা যায় নি। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের বাড়ি নড়াইল জেলায়।
মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের অপর জাহাজ মুগনি-৩-এর মাস্টার বাচ্চু মিয়া ও গ্রীজার মো. মাসুদ জানান, সার বহনকারী এমভি আল-বাখেরা রোববার (২২ ডিসেম্বর ২০২৪) সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসে। এরই মধ্যে কোম্পানির মালিক শিপন বাখেরা জাহাজে ফোন করে কাউকে পাননি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় মুগনি জাহাজ থেকে যোগাযোগ করার জন্যে বলেন। ওই সময় মুগনি জাহাজটি মাওয়া থেকে ঘটনাস্থল দিয়ে অতিক্রম করার সময় বাখেরা জাহাজটি ঘটনাস্থলে নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখতে পায়। তখন তারা জাহাজের কাছে গিয়ে ভেতরে রক্তাক্ত অবস্থায় লোকজন পড়ে থাকতে দেখে ৯৯৯ নাম্বারে কল দেয়।
৯৯৯ কলের সূত্র ধরে চাঁদপুর থেকে কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। নৌ পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মোশফিকুর রহমানের উপস্থিতিতে কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ জাহাজ থেকে প্রথমে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে এবং ৩জনকে আহত অবস্থায় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আনিসুর রহমান বলেন, জুয়েল নামে আহত একজনের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গলা ও শ্বাসনালী কাটা ছিলো। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। আর উদ্ধারকৃত সজিবুল ও মাজেদুলকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মাথায় ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র বলছে, মরদেহ ও আহত ব্যক্তিদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। কারও
কারও ছিল গলা কাটা। পুলিশের ধারণা, রোববার দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা জাহাজটির কর্মী।
নৌ এসপি সৈয়দ মোশফিকুর রহমান বলেন, জাহাজে ডাকাতি করতে বাধা দেয়ায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তিনি বলেন, আহত একজন হাতের ইশারায় জানিয়েছেন, তারা ৮জন ছিলেন। ঘটনাটি কীভাবে হয়েছে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। ডাকাতি কিংবা অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তদন্ত করার পরে জানা যাবে। নৌ পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের সাথে নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলেছি। কারণ এই রুটে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। যাতে করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) রাশেদুল হক চৌধুরী, হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা নাজনীন তৃষা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিরুপম মজুমদার, হাইমচর থানার অফিসার ইনচার্জ মহিউদ্দিন সুমনসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ।
রাতে কথা হয়েছে, সকালে কেউ ফোন ধরেননি, বললেন জাহাজের মালিক
মেঘনা নদীতে যে জাহাজে সাতজন হত্যার শিকার হয়েছেন, সেই জাহাজের মালিক দিপলু রানা বলেছেন, কর্মীদের সঙ্গে রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে কথা হয় তাঁর। সকালে কেউ ফোন ধরেননি। এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
ডাকাতি নাকি শত্রুতার কারণে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা নিয়ে জানতে চাইলে জাহাজটির মালিক দিপলু রানা বলেন, ‘আমি জানি না কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে আসল ঘটনা বের করতে পারবে।’
দিপলু রানা আরও বলেন, চট্টগ্রাম থেকে রওনা হওয়ার পর রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে জাহাজটির চালকের (মাস্টার) সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়। তখন চালক জানিয়েছিলেন, মেঘনা নদীতে তাঁরা জাহাজের বহরের মধ্যেই ছিলেন। তবে সকালে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউ সাড়া দেননি। তিনি বলেন, ‘বারবার যোগাযোগ না করে কাউকে না পেয়ে আমাদের আরেকটি জাহাজের (মুগনি-৩) নাবিকদের বিষয়টি জানাই। ওই জাহাজ এমভি আল বাখেরার কাছাকাছি ছিল। তারা আল-বাখেরার কাছাকাছি যাওয়ার পরই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারেন।’
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল জানায়, ১৯ ডিসেম্বর আল-বাখেরা নামের জাহাজটি ইউরিয়া সার পরিবহনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাহাজটির ধারণক্ষমতা ৮০০ মেট্রিক টন। জাহাজটির পণ্য পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স হামিদিয়া এন্টারপ্রাইজ। বরাদ্দ পাওয়ার পর জাহাজটিতে ২১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কাফকো জেটি থেকে ৭২০ টন ইউরিয়া সার বোঝাই করা হয়। রোববার ভোরে জাহাজটি সার নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। এই সার ছিল বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি)।
জাহাজটিতে বহন করা পণ্যের এজেন্ট হামিদিয়া এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক (পরিচালন) পারভেজ হোসাইন বলেন, জাহাজ গন্তব্যে রওনা হওয়ার পর তারা নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। সকাল থেকে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মূলত মুগনি-৩ জাহাজের নাবিকেরা এমভি আল-বাখেরার কাছাকাছি গিয়ে ঘটনা জানতে পারে।
জানতে চাইলে মুগনি-৩ জাহাজের চালক মোহাম্মদ বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘আমরা খালি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় মালিকের ফোন পেয়ে বেলা একটার দিকে আমরা এমভি আল-বাখেরা জাহাজের কাছাকাছি যাই। সেখানে গিয়ে এমভি আল-বাখেরা জাহাজে রক্তাক্ত অবস্থায় পাঁচজনকে পড়ে থাকতে দেখেন আমাদের সুকানি রবিউল। তারা জীবিত ছিলেন না।’ তিনি বলেন, ‘পাঁচজনের বাইরে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনজন জাহাজে পড়ে ছিলেন। দ্রুত বিষয়টি আমরা পুলিশকে জানাই। তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।’ তথ্যসূত্র : প্রথম আলো।