প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:১৪
বাশারের ‘আয়নাঘরে’ বন্দী ছিলেন প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার মানুষ
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের কারাগারে বন্দী ছিলেন লক্ষাধিক মানুষ। বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখল করার পর রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছেন ৫৯ বছর বয়সী এই শাসক। আসাদ সরকার পতনের পরপরই বিভিন্ন কারাগার থেকে হাজারো মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। মুক্ত হয়ে অনেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজেদের সঙ্গে ঘটা নির্যাতন ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। ওই বর্ণনা থেকে মনে হয়েছে-এ যেন আরেক আয়নাঘর।
|আরো খবর
মুক্তি পাওয়াদের একজন নারী এখনো ভয়ে তার আসল নাম প্রকাশ করেননি। ছদ্মনামের হালা আল-জাজিরাকে বলেন, ২০১৯ সালে হামার একটি চেকপয়েন্ট থেকে তাকে আটক করা হয়। পরে ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এই নারীকে। সে সময় হাজার হাজার সরকারবিরোধীদের ওপর একই অভিযোগ আরোপ করা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এরপর আলেপ্পোতে নিয়ে বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল হালাকে।
নিজের কারাবন্দী জীবনের নির্মম স্মৃতিচারণ করে এই নারী বলেন, ‘আমাকে আমার নাম ধরে ডাকা হতো না, স্রেফ নম্বর দিয়ে ডাকা হতো। তাই আমার নাম ছিল ১১০০। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, এটি (বাশারের পতন) সত্যি এবং আমরা কোনো আলোর মুখ দেখতে পাব।’
আসাদ বিরোধী আন্দোলনকারী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের আনন্দ ছিল সীমাহীন, আমরা উলু ধ্বনি দিচ্ছিলাম এবং চিৎকার করছিলাম।’ মুক্তিদাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে হালা বলেন, ‘ইচ্ছা করছিল, তাদের যদি আলিঙ্গন করে চুমু খেতে পারতাম! পরিবারের কাছে পৌঁছানোর পর আনন্দ আরও বেড়ে গেল। এটা যেন আমার নতুন জন্ম।’
এইচটিএস আলেপ্পোর যে কারাগার থেকে হালাকে মুক্তি দিয়েছে, সেটি বাশার আল-আসাদের সরকারের পরিচালিত কয়েকটি কারাগারের একটি মাত্র। মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, হালাসহ আল-আসাদের কারাগারে অন্তত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ জন বন্দী ছিলেন।
মূলত সিরিয়ার কারাগারগুলো ছিল বাশার আল-আসাদের রেজিমকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম মূল স্তম্ভ। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ২০১৩ সালে সিরিয়া থেকে গোপনে বের করে আনা অনেকে দেখিয়েছিল যে, সিরিয়ার সরকারি আটক কেন্দ্রে ব্যাপক নির্যাতন, অনাহার, প্রহার এবং রোগের ব্যাপক প্রমাণ আছে। একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
কারাবন্দী জীবনের স্মৃতি থেকে হালা জানান, তারই সঙ্গে বন্দী ছিলেন এক কিশোরী। যিনি বাশার আল-আসাদ বাহিনীর নির্যাতনের কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই মারা যান। হালা বলেন, ওই তরুণীকে তার বিয়ের মাত্র দুই মাস পরে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই তরুণী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী, এক বৃদ্ধা এবং দুজন চিকিৎসক বিপ্লবীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিল বলে পুলিশের অভিযোগ ছিল।
বাশার আল-আসাদের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরেক বন্দী ৪৯ বছর বয়সী সাফি আল-ইয়াসিন। তিনিও আলেপ্পোর কারাগার থেকেই মুক্তি পেয়েছেন। সাফি বলেন, ‘এটা যেন আমার জন্মদিনের মতো ছিল, যেন আমার জীবনের প্রথম দিন। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
সাফি আল-ইয়াসিন বলেন, গত ২৯ নভেম্বরের আগে কারাগারের কাছাকাছি গোলাগুলির শব্দ শুনে তারা সতর্ক হয়ে ছিলেন। তারপর হঠাৎ শান্তি নেমে এল এবং আমরা বিজয়ী বিদ্রোহীদের গানের শব্দ শুনতে পেলাম। প্রায় পাঁচ হাজার বন্দী ছিল। আমরা জানালা-দরজা ভাঙতে শুরু করি বেরোনোর জন্য। এমনকি কারাগারের কর্মকর্তা ও প্রহরীরা সাধারণ পোশাকে আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, যাতে বিদ্রোহীরা ধরতে না পারে।’
সাফি আল-ইয়াসিন বন্দী হওয়ার আগে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার উপকূলীয় শহর বানিয়াসে নৌকা তৈরির কাজ করতেন। তিনি বলেন, ২০১১ সালে সিরিয়ার বিপ্লবের সময়কার এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণের অভিযোগে ৩১ বছর সাজা হয়েছিল তার। এরই মধ্যে তিনি সেই সাজার অর্ধেক পার করে ফেলেছেন। বিগত ১৪ বছর ধরে তিনি সিরিয়ার বিস্তৃত কারাগার নেটওয়ার্কের বিভিন্ন স্থানে ‘তীব্র শারীরিক নির্যাতন এবং বছরের পর বছর মানসিক যন্ত্রণার’ শিকার হয়েছেন।
তথ্যসূত্র :চ্যানেল ২৪।